সাহস করে মোকাবিলাতেই মানুষের জয়
ঈদ আসছে শ্রমজীবী মানুষ আবার শহর থেকে গ্রামে ছুটছে। সরকার যত প্রকারের বাধা দিক- এ ছুটে চলা থামানো যাবে না। এরা মাইলের পর মাইল হেঁটে চলে যাবে। সুতরাং লকডাউনের মধ্যে এটাও মাথায় রাখতে হবে যে কারফিউ চালু হয়নি যে আপনি তার হাঁটাচলা বন্ধ করে দিতে পারবেন। ফেরিঘাট থেকে ফেরত পাঠানো কাজের কাজ না। ওদের কাউকে কারফিউ দিয়েও রোখা যাবে না।
হ্যাঁ, ইচ্ছে থাকলে ছুটে চলার আগেই তাদের থামানো যাবে, ফেরিঘাট থেকে নয়। বুঝাতে হবে- তারা যে ঝুঁকি নিচ্ছে সেটা অপরিহার্য কিনা। ভারত সরকারও মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্স বা অভিবাসী শ্রমিকদের যাতায়াত বন্ধ করে দিয়ে বিশ্রি অবস্থা তৈরি করেছিল। সমালোচনায় পড়ে, উপায় না পেয়ে এখন মাইগ্রেন্ট ওয়ার্কার্সদের স্ব স্ব রাজ্যে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। আমাদেরকেও সুশৃঙ্খলভাবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে দূরপাল্লায় চলাচলের উপায় বের করতে হবে।
জানি লকডাউন তুলে দেয়া এক জটিল ও কঠিন প্রক্রিয়া। কিন্তু মানুষের জীবন ও জীবিকার তাগিদে ধীরে ধীরে লকডাউন তুলে দিতে হবে। বাংলাদেশে করোনা ক্রমবর্ধমান তবুও আগামী দিনের অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবিলার মানসে শিল্পকারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের শিল্প সেক্টরে পোশাকশিল্পই মুখ্য। এই শিল্পে ৪১ লাখ শ্রমিক কাজ করে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে পোশাকশিল্প প্রধান ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্বে চীন, বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া মূলত প্রধান পোশাক প্রস্তুতকারক দেশ। চীন, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া তাদের লকডাউন শীতল করে পোশাক কারখানা চালু করেছে। সুতরাং বাংলাদেশ যদি তার কারখানা চালু না করে তবে বিশ্বে তার বাজার ধরে রাখা সম্ভব হবে না। বাজার হারালে বাজার ফিরে পাওয়া কঠিন।
লকডাউনের কারণে এখন পণ্যপ্রবাহ, অর্থপ্রবাহ প্রায় স্তব্ধ হয়ে গেছে। এমন করে বিশ্বকে সচল রাখা কখনও সম্ভব নয়। তাই বিকল্প উপায় খুঁজে নিচ্ছে সবাই। বিমানযাত্রা থেকে লঞ্চযাত্রা, প্রার্থনালয় খেকে কাঁচাবাজার- সর্বত্র প্রয়োজন হচ্ছে স্বাস্থ্যসম্মত চলাচল। বিশ্বকে সচল করতে হবে কারণ অনন্তকাল এভাবে চলবে না। বিশ্বের সবস্থানে এখন লকডাউন তোলার উপায় খোঁজা হচ্ছে, লকডাউন তুলে দেয়াও হচ্ছে। আমেরিকার মতো দেশে নতুনভাবে বেকার হয়েছে ৭০ লাখ লোক। তাদের তিন কোটি মানুষ বেকার ভাতার জন্য দরখাস্ত করেছে। আমেরিকার ২০ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি। যত বড় অর্থনীতি হোক না কেন- এত চাপ সহ্য করা কারও পক্ষে সম্ভব নয়।
করোনার তাণ্ডব এসেছে অল্প সময়ের মধ্যে। যেটুকু সময় পাওয়া গেছে সেটাও বাংলাদেশসহ অনেক দেশ কাজে লাগায়নি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও দুষছে আমেরিকাসহ কোনো কোনো দেশ। করোনা এত দ্রুত বিশ্বকে বিধ্বস্ত করছে যে চার মাসের মাথায় সুইজারল্যান্ডের জেনেভা শহরে হাজার হাজার মানুষকে ফ্রি খাবারের জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়াতে হচ্ছে। সে তুলনায় বাংলাদেশতো কিছুই না। বাংলাদেশ এ যাবত চার কোটি লোককে ত্রাণ দিয়েছে। কিন্তু ত্রাণের ওপর কোনো রাষ্ট্র চলতে পারে না। সুতরাং স্বাস্থ্যসুরক্ষার একটা ব্যবস্থা করে লকডাউন শীতল করা ছাড়া ভিন্ন কোনো উপায় নেই।
বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, করোনার কোনো ভ্যাকসিন হয়তো নাও আসতে পারে। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন এক বছরের মাথায় ভ্যাকসিন আসবে। ছোট-বড় এমন কোনো দেশ নেই যারা চেষ্টা করছে না প্রতিষেধক আবিষ্কারের। চীন বলেছে তারা ভ্যাকসিন যদি আবিষ্কার করতে পারে তাহলে সব দেশকে সেটা দেবে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে তার গবেষণায় করোনার জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ঘাটনের উপায় বের করেছে। চীন বা ইউরোপের সঙ্গে এই দেশে ভাইরাসের চরিত্রগত কোনো পরিবর্তন হয়েছে কিনা তার সব বিস্তারিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে জিনোম সিকোয়েন্সে।
সুতরাং বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী জনসনের হতাশাগ্রস্ত কথায় আমরা হতাশ নই। আল্লাহ চাহে তো অচিরেই করোনার প্রতিষেধক বের হবে- এই প্রত্যাশা বিশ্ববাসীর। বাংলাদেশের যেসব গবেষক জিনোম সিকোয়েন্স আবিষ্কার করেছেন তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ কারণ এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। করোনা যখন তার চরিত্র বদল করে তখন কোনো দেশ তার আক্রান্ত ভাইরাসটি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা না রাখলে প্রতিষেধক নির্ধারণে জটিলতা সৃষ্টি হয়। সুতরাং প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও বাংলাদেশের গবেষণালব্ধ বিষয়টি খুবই জরুরি এবং মৌলিক বিষয় ছিল।
করোনা শুধু এই বছরের পর বিদায় নিলেও সারাবিশ্ব মহামন্দা ও দুর্ভিক্ষ থেকে রেহাই পাবে বলে মনে হচ্ছে না। বেশিরভাগ দেশের অর্থনীতি দ্রুত নিম্নগামী হবে। আর শেষ প্রান্ত থেকে আবার ফিরে পূর্বের পর্যায়ে আসাটা কঠিন হবে। বিশ্বের সব সরকার সংকটে পড়েছে। স্বাস্থ্যঝুঁকি এড়িয়ে চলা আর অর্থপ্রবাহ সৃষ্টির জন্য লকডাউন শীতল করে কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য চালু করতেই হবে। বিশ্বের প্রায় দেশেই দরিদ্র এবং কর্মজীবী মানুষরা যদি কাজ না করে তাদের কিন্তু অন্য কোনো উৎস নেই জীবনধারণের। সুতরাং ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও ধনী-দরিদ্র সব দেশ স্বাভাবিক জীবনপ্রবাহ সৃষ্টির একটা উদ্যোগ নিয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করে পোশাক কারখানা খোলার ব্যবস্থা নিয়েছে। গত ২৮ এপ্রিল থেকে আজ পর্যন্ত শতাধিক শ্রমিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। আক্রান্ত হলেই যে মৃত্যু হচ্ছে তা নয়। মৃত্যুর সংখ্যা কিন্তু ব্যাপক নয়। আমার মনে হয় চিকিৎসা পেলে আক্রান্ত শ্রমিকরা সুস্থ হয়ে উঠবে। তবে মালিকরা দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিলে শ্রমিকরা কখনও কাজ এড়ানোর চেষ্টা করবে না। এখন সরকার এবং মালিকপক্ষ গার্মেন্টস খোলার যে উদ্যোগ নিয়েছে, ব্যাপক সংক্রমণের হাত থেকে শ্রমিকদের রক্ষা করতে পারলে তাদের উদ্যোগ সফল হবে।
এখনও পর্যন্ত বাংলাদেশে গত চার মাসে করোনায় যত লোক মারা গেছে পরিসংখ্যান বলে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পরিমাণ তার চেয়ে বেশি। তারপরও বারবার মালিকপক্ষকে সাবধান করব যদি কোনো কারণে ব্যাপক সংক্রমণ ও ব্যাপক কোনো মৃত্যুর অবস্থা সৃষ্টি হয় তবে গার্মেন্টস খোলার উদ্যোগ হতাশাগ্রস্ত হবে। তখন হায় হায় করা ছাড়া উপায় থাকবে না। শুধু সতর্ক হলেই বিপর্যয় এড়ানো যাবে।
সরকার উভয় সংকটে আছে। শুধু বাংলাদেশ সরকার নয় বিশ্বের সব সরকারের একই অবস্থা। জনজীবন অচল করে, সংক্রমণের ভয়ে সবকিছু লকডাউন করে রাখলে অর্থপ্রবাহ স্তব্ধ হয়ে দ্রুত অনাহারে সম্মুখীন হবে মানুষকে। মহামারি থেকে অনাহারের যন্ত্রণা কম নয়। এটা ঠিক মাস্ক লাগানো, দূরত্ব বজায় রেখে চলাসহ সব স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা প্রথম প্রথম অসুবিধা হতে পারে। কিন্তু সবাই সচেতন হলে অসুবিধা উত্তরণের পথও বের হয়ে আসবে। সাহস করে মোকাবিলাতে সবসময় মানুষের বিজয় এসেছে। সুতরাং এবারও মানুষের জয় হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]
এইচআর/বিএ