মহামারিতে নারীর মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা
মুরশিদুজ্জামান হিমু
নারীজীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ মাসিক বা পিরিয়ড। স্বাভাবিক জীবন প্রক্রিয়ারই অংশ এটি। অথচ এই বিষয়টি নিয়েই আমাদের কত লুকোচুরি। যেন এক অচ্ছুত বিষয়। আলোচনা করা যায় না প্রকাশ্যে। লুকিয়ে চাপাকণ্ঠে বলতে হয়। এখনও সামাজিক এই ট্যাবু ভাঙা যায়নি। এখনও সচেতন করা সম্ভব হয়নি অনেককে। অস্বাস্থ্যকর সেকেলে পন্থাই এখনও বেছে নেন অনেক নারী। বিশেষ করে গ্রামের যারা। আর শহুরে নারীরা হয়তো স্যানিটারি ন্যাপকিন বা আরও আধুনিক কিছু ব্যবহার করছেন; কিন্তু বিষয়টি নিয়ে পরিবারে কি কথা বলতে পারছেন প্রকাশ্যে? পিরিয়ডের ৩ থেকে ৫ দিন নারীর শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের খোঁজ পরিবারের ক’জন রাখছেন?
আসি মূল প্রসঙ্গে। করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক মহামারি চলছে। পুরো পৃথিবী একরকম লকডাউন। গাড়ি চলছে একেবারে কম, বিমান উড়ছে অল্পবিস্তর। রাস্তাঘাটে লোক কম, দোকানপাটও কম খুলছে। সবমিলিয়ে আমাদের জীবন হয়ে গেছে অন্যরকম। তিন মাস আগেও অনেকের চিন্তার বাইরে ছিল এমন জীবন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এমন জটিল লগ্নই পার করতে হচ্ছে আমাদের। এ পরিস্থিতিতে নারীর মাসিককালীন স্বাস্থ্য নিয়ে কে কতটা ভেবেছেন?
মহামারিতে অনেক মানুষ কাজ হারিয়েছেন। স্বল্প আয়ের লোকজন তো বটেই অনেক নিন্মমধ্যবিত্ত-ও গেল কয়েক মাসে জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় পার করে ফেলেছেন। তাদের কেউ কেউ হয়তো মুখে-পেটে পাথর বেঁধেছেন, কিন্তু বলতে পারেননি কাউকে। সেসব পরিবারে নারী স্বাস্থ্যের অবস্থাটা কী?
অনেকে ভাবছেন, এই দুঃসময়ে অন্নসংস্থান নিয়েই ভাবনার শেষ নেই, সেখানে নারীর মাসিক নিয়ে চিন্তা! হ্যাঁ, চিন্তাটা আপনাকে করতেই হবে। নারীরা তো করবেনই, পরিবারের পুরুষদেরও করতে হবে। কেন করতে হবে, এ সময়ে তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, একটু স্বাস্থ্যবিষয়ক জার্নালে কিছু লেখা ঘাটাঘাটি করলেই পরিষ্কার হবে বিষয়টি। সম্প্রতি ইউনিসেফ তো প্যানডেমিকে নারীর মাসিক সময়ের স্বাস্থ্য নিয়ে বেশ সোচ্চার। এ সময়ে কী কী করা উচিত, তার বিস্তারিত তুলে ধরে ক্যাম্পেইনও শুরু করেছে তারা।
আমাদের দেশের কথা যদি চিন্তা করি, তবে সমাজের বড় একটি অংশ স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন না। উচ্চবিত্তরা করেন, মধ্যবিত্তরা-নিন্ম মধ্যবিত্তরাও। কিন্তু করোনা মহামারিতে অনেক নিম্ন মধ্যবিত্তের কাজ নেই; কারও আবার রোজগার কমেছে। অনেকের কাছে প্রতিমাসে স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার বিষয়টি বাড়তি খরচ মনে হতে পারে। তাই যারা পিরিয়ডের সময়ে ন্যাপকিন ব্যবহার করছেন না, তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। বিশেষ করে করোনা মহামারির সময়ে তা আরও জটিল হতে পারে। চলুন দেখে নেই এ নিয়ে ইউনিসেফ আমাদের কী তথ্য দিচ্ছে।
তারা পুরোনো একটি কথা বারবার বলছে, পিরিয়ড কোনো অসুস্থতা নয়। এটা নারীজীবনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য নিয়ে তারা বলছে, অনেকে বলে থাকেন কোভিড-১৯ এর একটি লক্ষণ ‘মাসিক’। আর পিরিয়ডের সময় নারীরা এই রোগ অন্যদের মধ্যে ছড়ায় বেশি। পরিষ্কারভাবে ইউনিসেফ বলছে, এমন ধারণার কোনো ভিত্তিই নেই চিকিৎসা বিজ্ঞানে।
করোনায় অর্থনৈতিক মন্দার সাথে যে নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি জড়িত, তা বার বার বলা হয়েছে। তাই সহায়তা হিসেবে যেমন অনেকের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেয়া হচ্ছে, তেমনি প্রয়োজন অনুযায়ী স্যানিটারি ন্যাপকিন, মিন্সট্রুয়াল কাপ, রি-ইউজেবল ন্যাপকিন, ব্যথানাশক ওষুধ সরবরাহের ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।
করোনায় স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িত প্রায় ৭০ ভাগই নারী। আবার অনেক নারী আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাও নিচ্ছেন। তাদের জন্য মাসিকের সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে গুরুত্বসহকারে। পিরিয়ডের সময় প্রায় প্রতিটি নারী-ই মানসিকভাবে কিছুটা বিক্ষিপ্ত থাকেন। আর মহামারির সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ, মানসিকভাবে থাকতে হবে স্থির-প্রফুল্ল। এ জন্য নিজেকে নিজে কাউন্সেলিং করতে হবে; মানসিক সহায়তা দরকার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও।
একটি বিষয় স্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে, কোনো অসুস্থতা না হলেও মাসিকের সময়ে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং অপরিচ্ছন্ন থাকলে করোনা মহামারিতে তা ঝুঁকি ডেকে আনতে পারে। কারণ অপরিচ্ছন্নতা থেকে হয় নানা ধরনের ইনফেকশন। যা সবসময় তো বটেই, বিশেষ করে পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে হতে পারে অত্যন্ত ঝুঁকির কারণ। তাই ইউনিসেফ পরামর্শ দিচ্ছে, অবশ্যই ব্যবহার করতে হবে পরিষ্কার টয়লেট এবং পানি। মোটাদাগে করোনা মহামারিতে নারীদের মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা বোঝাতে চেয়েছে তারা।
নারীদের স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে লকডাউনের সময়ে আমাদের দেশেরও কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনসহ অন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন। খুলনার ‘উইথ সি’ নামের একটি সংগঠন তো এমন কর্মকাণ্ড চালিয়ে বেশ প্রশংসিত-ও। এসবই তো আশা জাগানিয়া। পরিস্থিতি নিশ্চয়ই পাল্টাবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী।
[email protected]
এইচআর/বিএ/এমকেএইচ