মানুষের করোনাজ্ঞান এবং অভ্যাস পরিবর্তনের জটিলতা

সম্পাদকীয় ডেস্ক
সম্পাদকীয় ডেস্ক সম্পাদকীয় ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৫৭ পিএম, ৩১ মে ২০২০

মো. হারিছুর রহমান

আমরা আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে নিজস্ব অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের মধ্য দিয়ে যেমন চলি, আবার অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্য দিয়েও চারপাশের জগতে ঘটে যাওয়া বিষয়াদি সম্পর্কেও জেনে থাকি। যেহেতু প্রাত্যহিক জীবনে আমাদের গতিবিধির পরিধি সীমিত, তাই আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানের পরিসরও সীমিত। আমাদের এই সীমিত নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরে হাজারো অজানা বিষয়, হাজারো ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বিভিন্ন গণমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের সামনে হাজির করে। এই যে হাজারো বিষয় সম্পর্কে জ্ঞান, তথ্য, উপাত্ত মিডিয়া আমদের সামনে হাজির করে সেগুলো সবই কি আমরা বিশ্বাস করি? করে না থাকলে, কেন করি না? আমাদের এই যে নিজস্ব অভিজ্ঞতার বাইরে অন্যান্য মাধ্যমের মধ্য দিয়ে আমরা কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে যে জ্ঞান, তথ্য, উপাত্ত অর্জন করি, কিংবা অর্জিত জ্ঞান অন্যের সঙ্গে শেয়ার করি তাকে আমরা ডিসকোর্স বলতে পারি।

ডিসকোর্সের বাইরে কোনো কিছুর অর্থ বা মানে বিরাজ করে না। ধরা যাক, নোভেল করোনাভাইরাসের কথা, চার পাঁচমাস আগেও আমরা করোনাভাইরাস সম্পর্কে জানতাম না। কিন্তু চার-পাঁচ মাস পরে এসে আমরা এ নিয়ে কত জ্ঞানই না চর্চা করছি! করোনা সম্পর্কিত মিডিয়া-মেডিয়েটেড জ্ঞান এখন আমাদের চিন্তা, ভাবাভাবি এবং বলাবলিকে শাসন করে। করোনা সম্পর্কিত জ্ঞান যেমন- করোনার উৎপত্তি, করোনা আসার কারণ, লক্ষণ, প্রতিকার কিংবা সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি কিংবা ধর্ম বা শিক্ষার ওপর এর কী প্রভাব পড়েছে তা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের যুক্তিতর্ক চলমান।

এ যুক্তিতর্কে ব্যক্তি নিজেকে শামিল করে করোনা সম্পর্কিত জ্ঞান উৎপাদন করছে। সে জ্ঞান “বৈজ্ঞানিক” আর “অবৈজ্ঞানিক” বা “কুস্কংস্কারাচ্ছন্ন” যা হোক না কেন, তা কোনোভাবেই সর্বজনীন নয়। অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট প্রকার ব্যাখ্যা ব্যক্তি সম্পূর্ণভাবে মেনে নিতে পারেন বা সম্পূর্ণভাবে তার বিরোধিতা করতে পারেন বা কিছুটা মেনে নিয়ে আবার কিছুটার বিরোধিতাও করতে পারেন। অর্থাৎ যুক্তি, বিশ্বাস বা আবেগের ওপর ভর করা কোনো ডিসকোর্স, তথ্য, উপাত্ত বা জ্ঞানকে ব্যক্তি হয় সমর্থন করে বা বিরোধিতা করে অথবা তার সঙ্গে বোঝাপড়া করে।

কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর একাধিক প্রতিযোগিতামূলক সমান্তরাল বা বিপরীত ডিসকোর্স থাকতে পারে। যেমন- এখনই আমাদের দেশে গার্মেন্টস, দোকানপাট, অফিস-আদালত, পরিবহন পুরোমাত্রায় চালু করা উচিত কি না অথবা ভাইরাসের ওষুধ, টিকা আবিষ্কারে কারা এগিয়ে, কিংবা করোনাভাইরাস কি প্রাকৃতিকভাবে এসেছে নাকি ল্যাবরেটরিতে তৈরি ইত্যাদি নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে হাজারো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ রয়েছে। প্রতিটি ডিসকোর্স আবার যুগ্ম বৈপরীত্য তৈরির মধ্য দিয়ে অর্থ তৈরি করে। যেমন- করোনার থেকে বাঁচতে “বৈজ্ঞানিক” ব্যাখ্যা অর্থ তৈরি করে “অবৈজ্ঞানিক” বা “স্থানিক” জ্ঞাননির্ভর ব্যাখ্যার বিপরীতে। অর্থাৎ কেউ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা যেমন- হাত ধোয়ার বা মাস্ক পরার বিপরীতে ধর্মীয় ব্যাখ্যার কথা বলতে পারেন, যেখানে হয়তো করোনায় আক্রান্ত হওয়া বা না হওয়াকে ভাগ্য বা সৃষ্টিকর্তার ওপর ছেড়ে দিতে পারেন। কিন্তু এই দুই বিপরীত ডিসকোর্স কোনোভাবেই একই ক্ষমতা ধারণ করে না।

“বৈজ্ঞানিক জ্ঞান” “যুক্তি”, “সংখ্যাগরিষ্ঠতার” ওপর ভর করে কোনো ডিসকোর্স যেমন অধিক ক্ষমতায়িত হতে পারে একইসঙ্গে ওই ডিসকোর্সের সমান্তরাল বা বিপরীত ডিসকোর্স ততটাই “অবৈজ্ঞানিক”, “কুসংস্কারাচ্ছন্ন” বা “প্রান্তিক” হিসেবে আখ্যায়িত হতে পারে। করোনা সম্পর্কিত “বায়োমেডিকেল ও বৈজ্ঞানিক ডিসকোর্স” আমদেরকে চিন্তা, ভাবাভাবি এবং বলাবলিকে শাসন করে করোনাসংক্রান্ত জ্ঞান এবং সত্য নির্মাণের মধ্য দিয়ে। করোনা সম্পর্কিত এই “বৈজ্ঞানিক জ্ঞান” আবার ক্ষমতা পুনরুৎপাদনের সঙ্গে সম্পর্কিত। দার্শনিক মিশেল ফুঁকোর মতে, জ্ঞান যেভাবে ক্ষমতা উৎপাদন করে, তেমনি ক্ষমতাও বিপরীতভাবে জ্ঞান/সত্য তৈরি করে। কারণ ক্ষমতা নির্ধারণ করে কোনটিকে জ্ঞান/সত্য বলা যাবে, আর কোনটিকে বলা যাবে না।

করোনাভাইরাস অদৃশ্যমান কিন্তু মিডিয়া আমদের সামনে করোনার হাজারো আকারের, রঙয়ের প্রতিকৃতি হাজির করছে যা করোনার পরিচয় নির্মাণ করে, যার সঙ্গে বাস্তবের করোনার কোনো মিল নাও থাকতে পারে। করোনার বাস্তব রূপ এখানে কোনো বিষয় নয়, কম্পিউটারে নির্মিত প্রতিকৃতি আমাদের সামনে বাস্তবের চেয়েও অধিবাস্তব হিসেবে তুলে ধরতে পারে। মিডিয়ায় নির্মিত করোনার এই অধিবাস্তব চেহারা, কিংবা মিডিয়ায় পরিবেশিত রোগ সম্পর্কিত বিভিন্ন পরিসংখ্যান আমাদের মনে যে ভয়ের জন্ম দেয়, তা ব্যবহার করে মিডিয়াতে পণ্যের বিজ্ঞাপন দেয়া হয় নিরন্তর। বিভিন্ন পণ্যবিক্রেতা ভাইরাস সম্পর্কিত অধিবাস্তব জ্ঞান নির্মাণ এবং পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মানুষের মনে ভয়ের জন্ম দিয়ে শুধুমাত্র হ্যান্ড সানিটাইজারই যে বিক্রি করছে তা-ই নয়, অন্যান্য আর্থিকসেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান যেমন- ব্যাংক ও মোবাইল কোম্পানি তাদের সেবার গুণাগুণ সম্পর্কিত বিজ্ঞাপনের পরিবর্তে করোনা ডিসকোর্সকে ব্যবহার করছে।

করোনাকালে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মতো পণ্য বিক্রেতারাও বিভিন্ন মাধ্যমে নিরন্তর সচেতন করে যাচ্ছে, করোনাসংক্রান্ত জ্ঞান দিচ্ছে, জনস্বার্থমূলক প্রচারণার মধ্য দিয়ে। প্রশ্ন হচ্ছে- এত শতবার বলার পরও কেন মানুষ সচেতন হচ্ছে না, কিংবা সামাজিক/শারীরিক দূরত্ব মানছে না, কিংবা মাস্ক পরছে না বা মানুষের ভিড় এড়িয়ে চলছে না? প্রতিনিয়ত প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে মানুষের ছোটাছুটি, জমায়েতের চিত্র দেখে আমরা হতাশ হই এবং ভাবি- কেন তারা করোনা সংক্রান্ত নির্দেশনা মানছে না। এমন বাস্তবতায়, শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে করোনা সংক্রান্ত নির্দেশনাকে “নতুন স্বাভাবিক” হিসেবে মেনে নেয়ার কথা বলছেন অনেকে।

তাহলে প্রশ্ন আসে, ব্যক্তির আচার বা অভ্যাসের পরিবর্তন কিসের ওপর নির্ভর করে? জনস্বাস্থ্যবিদরা ব্যক্তির অভ্যাস বা আচার পরিবর্তনের জন্য জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেও সমাজবিজ্ঞানী যেমন- পিয়েরে বুর্দোরা তা মানতে নারাজ। ধরা যাক, করোনাভাইরাস সম্পর্কিত জ্ঞানে ব্যায়োমেডিকেল ডিসকোর্সে বারবার হাত ধোয়ার কথা বলা হয় কিংবা মাস্ক পরা বা সামাজিক/শারীরিক দূরত্ব রক্ষা, সোশ্যাল আইসোলেশন বা কোয়ারেন্টাইনের কথা বলা হয় এবং সে সম্পর্কে জ্ঞান দিলেই যে সব মানুষের অভ্যাস রাতারাতি পরিবর্তন হবে তেমনটি ভাবার অবকাশ নেই। কারণ বুর্দোর মতে, আমাদের আচার আচরণের পরিবর্তন আমাদের সামাজিক অবস্থান, সামাজিকীকরণ এবং শিক্ষার জটিল সমগ্রের ওপর নির্ভর করে।

বুর্দো ব্যক্তিক এজেন্সি বা অভ্যাসকে সমীকরণের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছেন। বুর্দোর মতে, ব্যক্তিকে অভ্যাস/চরিত্র=(হ্যাবিটাস X সাংস্কৃতিক পুঁজি)+সোশ্যাল ফিল্ড। এ সমীকরণে হ্যাবিটাস বলতে তিনি পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্য বা চরিত্রকে বুঝিয়েছেন। একইসঙ্গে কাঠামোগত কাঠামো এবং পুনঃকাঠামোকৃত কাঠামোকে বুঝিয়েছেন, যেখানে ব্যক্তির পরিবর্তনশীল বৈশিষ্ট্য অতীত ও বর্তমান সামাজিক কাঠামো এবং সাংস্কৃতিক পুঁজি বা শিক্ষা অর্জনের ওপর নির্ভর করে। ব্যক্তি একইসঙ্গে সোশ্যাল ফিল্ড বা সামাজিক ক্ষেত্র, যা আবার “সংগ্রামের স্থান” হিসেবেও পরিচিত, সেখানে তার অবস্থানকে পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করে নিজেকে অন্যের থেকে ভিন্ন করার মধ্য দিয়ে বা স্বতন্ত্রতা তৈরির করার মধ্য দিয়ে। যা তার বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ চরিত্রকে প্রভাবিত করে একইসঙ্গে সামাজিক কাঠামোকেও প্রভাবিত করে। ব্যক্তির ওপর সামাজিক কাঠামোর প্রভাব যেমন- সামাজিকীকরণ, ব্যক্তির অভ্যাসকে যেমনই বদলে দেয় তেমনই আবার ব্যক্তির প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাও ব্যক্তির বৈশিষ্ট্যকে পরিবর্তনের পাশাপাশি সামাজিক কাঠামোকেও প্রভাবিত করে। কাজেই, ব্যক্তির আচার-আচরণের পরিবর্তন সরলরৈখিকভাবে শুধুমাত্র শিক্ষা, জ্ঞানদান বা ক্ষমতা প্রয়োগের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

আমরা দেখি, বিভিন্ন গণমাধ্যম কিংবা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা একরৈখিকভাবে জ্ঞান প্রদানের মধ্য দিয়ে রাতারাতি মানুষের মনোভঙ্গি বা অভ্যাসের পরিবর্তনের কথা বলেন, কোনোভাবে ব্যক্তির শ্রেণিগত অবস্থান, সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়া এবং শিক্ষার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা অভ্যাসকে আমলে না নিয়েই। ফলে, হাজারো মানুষ করোনাকালে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, কিংবা মাস্ক পরা বা পাবলিক জমায়েত এড়িয়ে চলাকে থোড়াই পাত্তা দিচ্ছেন। শুধুমাত্র গণ-মাধ্যমে জ্ঞান দিলেই কিংবা শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন করা যাবে না। ব্যক্তির অভ্যাস বা আচার পরিবর্তনে আগে প্রয়োজন তার অর্জিত অভ্যাসগুলো কিভাবে গড়ে উঠছে সে সম্পর্কে জানা এবং অভ্যাস গড়ে ওঠার পেছনের কারণগুলো পরিবর্তনের মধ্য দিয়েই কেবল নতুন কোনো অভ্যাসে অভ্যস্ত করা যেতে পারে।

মো. হারিছুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক, পলিটিকাল সায়েন্স অ্যান্ড সোসিওলজি বিভাগ এবং গবেষক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি।

এফআর/এমকেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।