বিষাক্ত বেদনার ২০২০, অর্থহীন লেখালেখি

আনিস আলমগীর
আনিস আলমগীর আনিস আলমগীর , সাংবাদিক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ০৯:৫৩ এএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২০

২০২০ আসার আগেই একরাশ পরিকল্পনা ছিল বাস্তবায়নের, ছিল কিছু স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছা, নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার চিন্তা। এই সাল সম্পর্কে আমার দুর্বলতা শুরু হয় মিলেনিয়াম বর্ষ থেকে। টোয়েন্টি টোয়েন্টি। সম্ভবত এর অনুপ্রাস বা অ্যালিটারেশনের জন্য দুর্বলতা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এই বিশ-বিশ সারা বিশ্বকে বিষাক্ত করে বিষ-বিষ হয়েছে। আমার ব্যক্তিগত জীবনকেও হুমকিতে ফেলেছে। তছনছ করে দেয়েছে মানসিক অবস্থা।

মা-বাবার পরে আমি পড়াশোনা এবং সাংবাদিকতা জীবনে যে দু’জন মানুষের অকাতর সহায়তা পেয়েছি- তার একজন আমার বড় বোন আঞ্জুমান আরা (৬২) এবং আমার চাচা কলামিস্ট, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, মুক্তিযোদ্ধা বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী (৭২) । গত ২৭ এপ্রিল বোন আর ২৫ ডিসেম্বর চাচা পরপারে চলে গেছেন। তারা অবশ্য করোনায় আক্রান্ত হননি, স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতি তাদের শারীরিক অবস্থার অবনতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে। এতো দুঃখের মধ্যে একটাই শুধু সান্ত্বনা খুঁজে পাই- আপা এবং চাচা দু’জনই বিছানায় পড়ে থাকার কষ্ট না করে শান্তিপূর্ণ মৃত্যু কামনা করতেন, আল্লাহ তাদের ইচ্ছা পূরণ করেছেন।

প্রিয়জন হারানো যে কারও জন্য বেদনার কিন্তু যেসব প্রিয়জন জীবনের বড় একটা অংশ দখল করে থাকে তাদের হারানোর ব্যথা সবাইকে উপলব্ধি করানো যায় না। প্রিয়জন হওয়ার জন্য রক্তের সম্পর্কও জরুরি হয় না। এমন পরিস্থিতিতে উপলব্ধি হয় পৃথিবীটা সত্যি অর্থহীন। এই যশ-খ্যাতি, অর্থ, ক্ষমতা- সবই অর্থহীন। সবাই আমরা অতিথি হিসেবে এসেছি এবং যিনি পাঠিয়েছেন তার কাছেই ফেরত যেতে হবে। আমাদের জন্মই হয়েছে মৃত্যুতে আলিঙ্গন করার জন্য। প্রতিদিন দু’পারেই বাড়ছে আমাদের স্বজনের সংখ্যা।

কিন্তু পৃথিবীর অতিথি হয়েও আমরা ভুলে যাই যে আমরা ক্ষণিকের অতিথি। পার্মানেন্ট ভেবে নেই সব কিছুকে। আমরা যে এই পৃথিবীর অতিথি মাত্র- সেটা ২০২০ সালও হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছে। আমরা চলে যাব, নতুনরা আসবে, এই পৃথিবী হয়তো হাজার কোটি বছর তার কক্ষপথে চলবে। অতিথি হয়ে এসে আমরা পৃথিবীকে নিজেদের ভেবে তার সঙ্গে যে আচরণ করছি, তার আলো এবং বাতাস কত মূল্যবান সেটা কোভিড-১৯ আমাদের নতুন করে শিক্ষা দিয়েছে। পুরো বিশ্বকে লকডাউনে রেখে ধরণী নিজের চিকিৎসা দিয়ে নিজেকে প্রাণীর বসবাসের উপযোগী করার পদক্ষেপ নিয়েছে। এ পদক্ষেপ আর কতদিন চলে সেটাও আমরা ঠাউর করতে পারছি না।

কোভিড-১৯ যখন শুরু হয় তখন মোটামুটি ধারণা করা হয়েছিল ডিসেম্বর নাগাদ পরিস্থিতি শান্ত হবে, আবার জমবে মেলা, জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হবে, কোলাহল মুখরিত জীবন ফিরে পাবে পৃথিবীর মানুষ। এর মধ্যে করোনার টিকা বের হয়ে যাবে। কিন্তু করোনার টিকা নেয়া স্বল্প মাত্রায় শুরু হলেও সমগ্র বিশ্ববাসীর জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হওয়ার গ্যারান্টি কারও কাছে নেই। বরং নতুনরূপে আবির্ভূত হচ্ছে এই ভাইরাস।

বাংলাদেশ করোনা মোকাবিলায় শুরুতে চরম ব্যর্থতা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি, গাফিলতির মধ্য দিয়ে এখন ধীরে ধীরে সংকট কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। লকডাউন অব্যাহত রাখবে নাকি অর্থনীতিকে চালু রেখেই করোনা মোকাবিলা করা হবে- এই নিয়ে নানা বিশ্লেষণ চলেছে। বেশির ভাগ মানুষ লকডাউন কড়া রাখার জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে বন্ধ রাখার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু আমাদের মতো অর্থনীতির দেশের জন্য সেটা মোটেও ভালো হতো না বলেই আমরা কিছু লোক ওই মতের পক্ষে ছিলাম না।

করোনা মোকাবিলায় সরকারকে পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দেয়ার পাশাপাশি জাগো নিউজে ৩০ এপ্রিল ২০২০ ‘কাজকর্ম চলুক, দুর্ভিক্ষ-করোনা ঠেকানোর কাজও অব্যাহত থাকুক’ ০৭ মে ২০২০ ‘গার্মেন্টস খোলা থাকুক, তবে…’ ২১ মে ২০২০ ‘সাহস করে মোকাবিলাতেই মানুষের জয় এবং ০৪ জুন ২০২০ ‘লকডাউন এখন জরুরি নয়, বিলাসিতা হবে’ শিরোনামে যেসব কলাম লিখেছিলাম তাতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ না করার পক্ষে বলেছিলাম।

আমার স্পষ্ট মনে আছে, গার্মেন্টস খোলা রাখা, লকডাউন বিলাসিতা হবে বলায় অনেকে ক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। কিন্তু দিন শেষে দেখা যাচ্ছে সরকার করোনা এবং অর্থনীতি- দুটিকে সমন্বয় করে পথ চলার সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা যারা এই মতের পক্ষে ছিলাম তারা ভুল করিনি। লকডাউনের মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি আশেপাশের দেশগুলোর মতো মুখ থুবড়ে পড়েনি। তবে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাধারণ মানুষ স্বস্তিতে নেই। কোভিডের কারণে আমাদের অনেকের ব্যক্তিগত সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। অনেকে চাকরিহারা, অনেকের ব্যবসা বন্ধ। আমরা উন্নত দেশ নই যে সরকার ভাতা দেবে। অবশ্য সরকার যেসব প্রণোদনা দিয়েছে সেসব সাধারণ মানুষকে কতটা বেনিফিট দিতে পেরেছে- এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত সহজলভ্য নয়।

নিজের বেদনার কাহিনিতে ফিরে আসি। কিছুদিন আগে ‘দর্শক-পাঠকদের ‘কনফারমেশন বায়াস’ সম্পর্কিত একটা কলামে বলেছিলাম পাঠক চায় তার চিন্তাধারায় কলামিস্ট চলুক। কিন্তু কলামিস্ট কী চায় পাঠক সেটার ধার ধারে না। যে কোনো কলামিস্ট চাইবে তার লেখার যথাযথ মূল্যায়ন, পারিশ্রমিক। যেটা কোভিডকালে সব ক্ষেত্রে হচ্ছে না। অনিয়মিত। অবশ্য করোনাকাল বেশকিছু শৌখিন কলামিস্টের জন্ম দিয়েছে, যাদের টাকা না হলেও লিখতে সমস্যা নেই। লেখা প্রকাশ হওয়াটাই বড় কথা। কলামিস্টের সবচেয়ে বড় চাওয়া লিখে নিজের চিত্তকে উৎফুল্ল করা। মনের শান্তির জন্যই লেখা। অর্থনীতি তখন প্রাধান্য পায় না। লিখে কি যথাযথ অর্থ ও প্রশান্তি পাচ্ছি? নিজের কাছে রাখা সেই প্রশ্নের জবাব না পেলে জানি না নতুন বছরে ধারাবাহিকভাবে আর লেখা চালিয়ে যাব কিনা। ২০২০ আমার জীবনে যে বিষাক্ত বেদনার জন্ম দিয়েছে, হয়তো এটা তারই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া। লেখালেখি অর্থহীন মনে হচ্ছে।

সবাইকে নতুন খ্রিস্টাব্দের শুভেচ্ছা।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। [email protected]

এইচআর/এমকেএইচ

কোভিডের কারণে আমাদের অনেকের ব্যক্তিগত সঞ্চয় শেষ হয়ে গেছে। অনেকে চাকরিহারা, অনেকের ব্যবসা বন্ধ। আমরা উন্নত দেশ নই যে সরকার ভাতা দিবে। অবশ্য সরকার যেসব প্রণোদনা দিয়েছে সেসব সাধারণ মানুষকে কতটা বেনিফিট দিতে পেরেছে- এই সংক্রান্ত কোনো তথ্য-উপাত্ত সহজলভ্য নয়

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।