করোনার তাল-বেতাল, টিকা সংকট এবং চাকরির বয়সসীমা
লিখতে বসে বিষয় নির্বাচন করা একটি বড় সমস্যা হয়। কত কিছু যে ঘটে চলেছে দেশে এবং দেশের বাইরে। কোনোটা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা চলে, আবার কোনোটি থেকে যাচ্ছে আলোচনার বাইরে। তবে করোনাভাইরাসের দোর্দণ্ড প্রতাপের বিষয়টি কারও নজর এড়াচ্ছে না। এটা চলছে গত এক বছরের বেশি সময় ধরে, গোটা বিশ্বজুড়ে। এমন বৈশ্বিক মহামারি খুব বেশি হয় না। এর আগেও কিছু মহামারি অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছে। তবে সেগুলো বিশ্বজুড়ে এমন সংহার মূর্তি নিয়ে দাপিয়ে বেড়ায়নি। এখন পৃথিবীটা বিশ্বগ্রামে পরিণত হওয়ায় যা কিছুই হয় তা এগ্রাম থেকে ওগ্রামে ছড়িয়ে পড়তে সময় লাগে না। জীবন এবং মৃত্যু সবই যেন হাতের মুঠোয়।
বাংলাদেশে করোনার প্রথম আঘাত কিছুটা সহনীয় ছিল বলে এখন দ্বিতীয় ঢেউয়ের তোড় দেখে মনে হচ্ছে। প্রথমবার যেভাবে সামাল দেয়া হয়েছিল, দ্বিতীয় দফায় তা সম্ভব হবে কিনা সে প্রশ্ন আছে। দ্বিতীয় দফায় আক্রান্ত এবং মৃত্যুহার বেশি। এরমধ্যেই আবার তৃতীয় ঢেউয়ের শঙ্কার কথাও শোনা যাচ্ছে। করোনা নিয়ে চূড়ান্ত কথা বিশেষজ্ঞরাও বলতে পারছেম না। করোনা এক দেশ থেকে আরেক দেশে তার চরিত্র বদল করছে। এমনকি চরিত্র বদলের সময় দুর্বল না হয়ে আরও বেশি শক্তি অর্জন করছে। বাংলাদেশেও কয়েক ধরনের করোনাভাইরাসের হদিস পাওয়া গেছে। একবার শোনা গেল ইউকে ভেরিয়েন্ট বেশি মারাত্মক। তারপর আবার দক্ষিণ আফ্রিকান ধরন ভয় ছড়ালো। এখন আবার ভারতীয় ধরন লাল চোখ দেখাতে শুরু করেছে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সংক্রমণ এবং মৃত্যু এতটাই বেড়েছে যে, সবার মধ্যেই আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের নানাভাবে যোগাযোগ, যাতায়াত বেশি হওয়ায় ভয় বেশি। করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলে মনে করা হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে দুই সপ্তাহের জন্য সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে জরুরি পণ্য পরিবহন অব্যাহত থাকবে।
ভারত থেকে করোনার টিকা দ্রুত আনার ব্যবস্থা করায় সরকার প্রশংসা পেলেও এখন আবার সমালোচনা শুরু হয়েছে। তিন কোটি ডোজ টিকা দেয়ার কথা থাকলেও ভারতের সেরাম টিকা এক লাখ ডোজের কিছু বেশি আসার পর আর আসছে না। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ভারত পূর্বপ্রতিশ্রুতি মতো টিকা রফতানি করতে পারছে না। এতে বাংলাদেশে সংকট দেখা দিয়েছে। নতুন টিকা আসা অনিশ্চিত হওয়ায় যারা প্রথম ডোজ টিকা নিয়েছেন তাদের সবাই নির্দিষ্ট সময় দ্বিতীয় ডোজ টিকা নিতে পারা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। টিকা সংগ্রহে ভারতের ওপর অতিমাত্রায় সরকারের নির্ভরতা এখন সবমহল থেকেই সমালোচিত হচ্ছে। সংকট সমাধানের জন্য অন্য সূত্র থেকে টিকা পাওয়ার চেষ্টা সরকার করছে। রাশিয়া এবং চীনের সঙ্গে ইতিবাচক যোগাযোগ হলেও টিকা কবে নাগাদ পাওয়া যাবে তা এখনও নিশ্চিত নয়। ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকার চাপে আছে।
করোনার কারণে দিন এনে দিন খাওয়া শ্রমজীবী-কর্মজীবী মানুষের জীবনে নেমে এসেছে গভীর সমস্যা। খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা তাদের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়েছে। সরকার অসহায় মানুষের পাশে কীভাবে, কতটা দাঁড়াবে তা নিশ্চিত নয়। যারা সংগঠনশক্তির জোরে বলীয়ান তারা তাদের সুবিধা আদায়ের জন্য যেভাবে দেনদরবার করতে পারেন, অসংগঠিত সাধারণ গরিব মানুষ তা পারেন না। তাই সরকারকে অনেক ক্ষেত্রে তেলা মাথায় তেল দিতে দেখা যায়।
যাদের সত্যিকার অর্থে সাহায্য-সহযোগিতা দরকার তাদের প্রতি সরকারকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। কীভাবে প্রয়োজন যাদের বেশি তাদের কাছে সরকারি সহায়তা পৌঁছানো যায়, তার উপায় বের করতে হবে। সরকারি বরাদ্দের যথাযথ ব্যবহারের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। কেউ পাবে আর কেউ না খেয়ে থাকবে– সেটা যাতে না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। সব ধরনের অপচয়, অনিয়ম বন্ধ করে অগ্রাধিকার ঠিক করে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর সক্ষমতা সরকারকে দেখাতে হবে।
দুই.
করোনাকালে আরও একটি বিষয়ের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদয় মনোযোগ আকর্ষণ করছি। বিষয়টি আমাদের তরুণ প্রজন্মের জন্য অতিজরুরি। তাদের পক্ষ থেকে আমার কাছে যে আবেদনটি পাঠানো হয়েছে সেটাই আমি এখানে হুবহু তুলে ধরছি।
'আমরা শিক্ষিত চাকরিপ্রত্যাশী যুবপ্রজন্ম বর্তমান করোনাকালে অত্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত। প্রায় দেড় বছর হতে চলেছে অতিমারি করোনার জন্য তেমন কোনো সরকারি চাকরির সার্কুলার নেই, চাকরির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার মতো পরিবেশও নেই। সকল পর্যায়ের শিক্ষার্থী তাদের জীবন থেকে দুইটি বছর হারাতে চলেছে। সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩০ হওয়ায় কয়েক লক্ষ মানুষ চাকরির পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ না পেয়েই ৩০-এর গণ্ডি অতিক্রম করবে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরিমাণ ৮৭% কমে ১৩% -এ উপনীত হয়েছে; অন্যদিকে বেকারত্বের হার ২০% থেকে ৩৫% -এ উন্নীত হয়েছে৷ বর্তমান ভয়াবহ সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে চাকরিপ্রত্যাশী প্রজন্ম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নিকট এই হারিয়ে যাওয়া সময় ২ বছর ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে সকলের জন্য চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ বছর করার মানবিক আর্জি জানাই। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে সমতার নীতিও প্রতিষ্ঠিত হবে যেহেতু বিসিএস স্বাস্থ্য, জুডিশিয়ারিসহ বিভিন্ন কোটার ক্ষেত্রে ৩২ বছর অবধি আবেদনের সুযোগ দেয়া হয়। এছাড়া এর মাধ্যমে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখিত চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির বিষয়ে 'বাস্তবতার নিরিখে যুক্তিসংগত ব্যবস্থা গ্রহণ'-এর প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়িত হবে।
চাকরিতে প্রবেশের বয়স শেষবারের মতো বৃদ্ধি করে ২৭ থেকে ৩০ করা হয় ১৯৯১ সালে যখন গড় অায়ু ছিল ৫৭ বছর। এই ৩০ বছরে গড় অায়ু ১৬ বছর বৃদ্ধি পেলেও চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমার কোনো বৃদ্ধি হয়নি। অন্যদিকে ২০১১ সালে অবসরের বয়সসীমা ২ বছর বৃদ্ধি করে ৫৭ থেকে ৫৯ করা হয়েছে (বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৬০)।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনও উল্লেখযোগ্য সেশনজট বিদ্যমান যার অন্যতম উদাহরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সাত কলেজ। মাস্টার্স সম্পন্ন করতে যেখানে গড়ে ২৬ বছরের অধিক সময়ও লেগে যায় সেখানে করোনার জন্য অারও ২ বছর বয়স হারানো যুবপ্রজন্মের জন্য অশনিসংকেত বহন করে। অামাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অাসাম রাজ্যে করোনাকালীন ক্ষতিগ্রস্ততা বিবেচনা করে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ২ বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে।
এমতাবস্থায় আপনার/আপনাদের সহায়তা পেলে অামরা এই গণদাবি সকলের সামনে প্রকাশ তথা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টিগোচর করাতে চাই যেন তিনি পরিস্থিতির ভয়াবহতা উপলব্ধি করে দ্রুততম সময়ে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ করার প্রজ্ঞাপন জারি করেন'।
বক্তব্য যুক্তিপূর্ণ । তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করবেন - এ আশা আমরা নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে করতেই পারি।
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
এইচআর/এএসএম