লকডাউন বাড়ছে বাড়ুক সচেতনতা
ড. প্রণব কুমার পান্ডে
করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ যখন বাংলাদেশে ব্যাপক আকার ধারণ করে তখন সরকার বাধ্য হয়েই গত এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখ থেকে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। এক সপ্তাহ কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নের পরে দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জনগণের জীবিকার কথা চিন্তা করে সুরক্ষা বিধি মানার শর্তে কল-কারখানা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহন করে সরকার। টানা দুই সপ্তাহ লকডাউন বাস্তবায়নের ফলে এর ইতিবাচক প্রভাব আমরা ইতিমধ্যেই লক্ষ্য করেছি করোনা সংক্রমণের হারের ওপর। আজ থেকে তিন সপ্তাহ আগে যখন প্রতিদিন ২২ থেকে ২৫ শতাংশ করোনা রোগী শনাক্ত হতো, গত কয়েকদিন যাবত শনাক্তের হার ৯-১০ শতাংশে নেমে এসেছে। একই সাথে মৃত্যুর হার ১০০ থেকে পঞ্চাশের কোটায় এসেছে। করোনা ভাইরাস ভারতে যেভাবে তাণ্ডব চালাচ্ছে সেই তুলনায় বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত ইতিবাচক একটি পরিবর্তন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে শুরু করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা প্রথম থেকেই করোনা মোকাবেলার ক্ষেত্রে সুরক্ষা বিধি মেনে চলার উপর গুরুত্ব দিয়ে আসছেন। সুরক্ষা বিধি মানার পাশাপাশি লকডাউন বাস্তবায়নের মাধ্যমে মানুষকে ঘরে রেখে এই সংক্রমণ হার কমানো যায়। এটি যেমন একটি বাস্তবতা, ঠিক তেমনি ভাবে আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতির ক্ষেত্রে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় এই দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন কতটা যৌক্তিক? আমরা জানি বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা বিশাল একটি অংশ দিন আনে দিন খায়। এই শ্রেণির মানুষের জন্য লকডাউন একটি অভিশাপ। কারণ একদিন যদি তারা কাজ না করে পরের দিনে তাদের সংসার কিভাবে চলবে এ বিষয়ে তাদের কাছে কোন সদুত্তর থাকেনা। এমন পরিস্থিতিতে সপ্তাহের পর সপ্তাহ কিংবা মাসের পর মাস লকডাউন বাস্তবায়ন করা সরকারের পক্ষে কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ।
বাংলাদেশে করোনার প্রথম ঢেউ এর সময় সাধারণ ছুটি ঘোষণার মাধ্যমে সরকার এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চেষ্টা করেছিল যা প্রায় দুই মাস কার্যকর ছিল। সেই সময়েও এই শ্রেণির মানুষরা অত্যন্ত দুর্বিষহ জীবন যাপন করেছে। তবে, সরকার সাধ্যমত চেষ্টা করেছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে তাদের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব করতে। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যার যার অবস্থান থেকে এই দরিদ্র মানুষদের সাহায্য করেছে। অন্যদিকে, সরকার বড় ধরনের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা করোনার প্রথম ঢেউ অত্যন্ত সফলতার সাথে উত্তরণ করেছিলাম। এই সার্বিক প্রক্রিয়ায় সামনে থেকে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যার দূরদর্শী নেতৃত্বে আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছিলাম।
দ্বিতীয় ঢেউ এর সময়ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্ভোগ আবার পূর্বের মতো একই রকম রয়েছে। এইবারও সরকার চেষ্টা করেছে যথেষ্ট সহায়তা প্রদান করার জন্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রায় ৩৬ লাখ পরিবারের জন্য ঈদের আগে সরাসরি অর্থ সাহায্য প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। উন্মুক্ত বাজারের মাধ্যমে স্বল্প আয়ের মানুষকে সস্তায় বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করা হচ্ছে এবং জীবন-জীবিকার মধ্যে এক ধরনের সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য কলকারখানা ও গার্মেন্টস খুলে দেওয়া হয়েছে লকডাউনের সময়। তবে, গণ-পরিবহন শ্রমিক, রিকশাচালক, এবং দৈনিক শ্রমিকরা দুঃসহ সময় অতিবাহিত করছে। আমরা জানি যে সামনে ঈদ আসছে এবং এই সময়টা তাদের জন্য আরো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে যতদূর সম্ভব সহায়তা প্রদান করা হবে। তারপরেও আমার মনে হয় যে সমাজের বিভিন্ন স্তরের এবং পেশার মানুষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মানুষকে সাহায্য করা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি।
এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সকলেই করোনা মহামারিকালীন সময়ে এবং বিশেষত লকডাউন চলাকালীন সময়ে দুর্বিষহ জীবন অতিবাহিত করছে। কিন্তু, আমাদের মনে রাখতে হবে যে সরকার লকডাউনের এর মতো সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র জনগণের জীবন রক্ষার জন্যই বাস্তবায়ন করছে। করোনা এমন এক ধরনের ভাইরাস যা মোকাবেলা করতে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোই হিমশিম খাচ্ছে। অতএব, যে কষ্ট আমরা সহ্য করছি সেটি আমাদের মেনে নেওয়া উচিত। করোনা মহামারীর প্রথম ঢেউ নিয়ন্ত্রিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরণের বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করেছিলাম। জনগণের বিশাল একটি অংশ স্বাস্থ্য বিধি না মেনে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছে। কক্সবাজারে এক সাথে আড়াই লক্ষ মানুষকে দেখা গেছে। বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছে হাজার হাজার মানুষ যেখানে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা কোন ভাবেই সম্ভব না। জনগণের এই অনিয়ন্ত্রিত আচরণের ফলে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ত্বরান্বিত হয়েছে আমাদের দেশে।
এই পরিস্থিতিতে সকলের মধ্যে এই আশঙ্কা কাজ করছে যে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে আসার ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে আবার যদি বেপরোয়া ভাব দেখা যায় তাহলে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই আমরা কি পুনরায় করোনার তৃতীয় ঢেউয়ের শিকার হবো? আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি সরকার গণ-পরিবহন শ্রমিকদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে ঈদের আগে গণ-পরিবহন খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ঈদকে সামনে রেখে সাধারণ মানুষের কেনাকাটা কিংবা গ্রামে যাওয়া একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় যদি আমরা স্বাস্থ্য বিধি না মানি, তাহলে আমাদের আবার গত এক মাস আগের অবস্থায় ফিরে যেতে হবে। সরকারের তরফ থেকে যে সিদ্ধান্তই নেয়া হোক না কেন সে সিদ্ধান্তের সঠিক বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।
আজ থেকে ২ সপ্তাহ আগে বাংলাদেশে করোনা রোগীরা সেবা পাবার জন্য হাহাকার করছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের হাসপাতালগুলোতে সাধারণ শয্যাসহ আইসিইউ এর সংকট ছিল। সেই অবস্থায় অনেক মুমূর্ষ রোগীর আত্মীয়-স্বজন হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরে বেড়িয়েছে একটি শয্যা কিংবা আইসিইউ এর জন্য। সংক্রমণের হার কমে যাওয়ার ফলে যদি নিকট অতীতের সেই স্মৃতিগুলো যদি আমরা ভুলে যায়, তাহলে আমাদের আবার সেই অবস্থার মোকাবেলা করতে হবে। আমরা অতি সহজেই আমাদের স্মৃতি ভুলে যাই। গত দুই মাসের করোনার তাণ্ডবের স্মৃতি ভুলে গিয়ে আমরা যদি আবার সুরক্ষা বিধি না মেনে চলাফেরা করি এবং নিজেদের বিলাসিতার জন্য ঘোরাঘুরি শুরু করি তাহলে সেদিন খুব দূরে নয় যেদিন আবার আমাদের করোনার তৃতীয় ঢেউ এর মোকাবেলার জন্য এক হাসপাতাল থেকে আর এক হাসপাতালে ঘুরে বেড়াতে হবে এবং সরকারকে পুনরায় লকডাউন বাস্তবায়ন করতে হবে।
এই পরিস্থিতিতে সরকার এবং জনগণ একই সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যদি কাজ না করে তাহলে করোনা মহামারির থেকে উত্তরণ সহসায় হবে বলে মনে হয় না। যদিও এখন পর্যন্ত বৈজ্ঞানিকভাবে এটি নিশ্চিত ভাবে বলা হয়নি যে করোনা ভাইরাস কতদিন আমাদের পৃথিবীতে তাণ্ডব চালাবে। কারণ এখন পর্যন্ত যে সমস্ত ভ্যাকসিন আবিষ্কৃত হয়েছে সেগুলো কোনোটাই স্থায়ী সুরক্ষা প্রদান করবে না করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের থেকে। কিন্তু আবার পাশাপাশি এটিও ঠিক মানুষের জীবন কখনো থেমে থাকে না। আমাদেরকে এই করোনা ভাইরাসকে সাথে নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। তবে সেই এগিয়ে যাওয়ার পথে আমরা যেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকার নির্ধারিত করোনা সুরক্ষা বিধি (যেমন বাইরে গেলে অবশ্যই মাক্স পড়া, ঘন ঘন হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, এবং ভিড় এড়িয়ে চলা) মেনে চলি। তাহলে করোনা ভাইরাসকে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে। পরিশেষে, আমার একটাই প্রত্যাশা করোনার দ্বিতীয় ধাপের সংক্রমণের হার কমে আসার ফলে আমরা যেন আবার বেপরোয়া আচরণ শুরু না করি।
লকডাউনের মেয়া ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ৬ মে থেকে গণপরিবহন চলাচল করবে। তবে এক জেলা থেকে অন্য জেলায় যেতে পারবে না। লঞ্চ এবং ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। লকডাইন বাড়ছে সচেতনতাও বাড়াতে হবে। নইলে আমরা একূল ও কূল দুকূলই হারাবো।
লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রফেসর।
এইচআর/এমকেএইচ