ধর্ম সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়

মাহমুদ আহমদ
মাহমুদ আহমদ মাহমুদ আহমদ , ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট
প্রকাশিত: ১১:১৬ এএম, ১০ মার্চ ২০২৩

প্রতিটি ধর্মই শান্তি আর সম্প্রীতির শিক্ষা দেয়। শান্তির জনপদ পঞ্চগড় ঐতিহ্যগতভাবে শান্তি ও ধর্মীয় সম্প্রীতির প্রতীকরূপে বিবেচিত হয়ে আসছে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে কিছু উগ্রধর্মান্ধরা আহমদিয়াদের বার্ষিক জলসা বন্ধ করার দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল। এরই ধারাবাহিকতায় এবং গুজব ছড়িয়ে আহমদিয়াদের ওপর আক্রমণ চালায়। যেখানে বিগত ৭২ বছর যাবত এই অঞ্চলে আহমদিয়া কোন ইস্যুই ছিল না সেখানে গত কয়েক বছর ধরে এই ইস্যু তুলে এলাকায় অশান্তি এবং জনমনে আতংক সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রায় দু’শ বাড়িঘর লুটতরাজ ও অগ্নিসংযোগ করে পরিবারগুলোকে করা হয়েছে নিঃস্ব। বর্তমান পুরো গ্রাম যেন যুদ্ধবিধস্ত কোন এলাকা। সন্ধ্যা হতেই রাস্তাঘাট জনমানবশূন্য। সবার মাঝে এক আতংক বিরাজ করছে।

আমরা বরাবরই লক্ষ্য করে আসছি, একটি মহল বরাবরই শান্তিময় সমাজকে অশান্ত করে তোলার কাজে ব্যস্ত থাকে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে তারা থাকে সদা তৎপর। অথচ প্রত্যেক ধর্মের মূল মর্মবাণী হল-শান্তি ও মানুষের কল্যাণ। ধর্ম মানুষকে সম্প্রীতি ও পরমত সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়।

বিভিন্ন সময়ে ধর্মকে কেন্দ্র করে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীল ও সুযোগসন্ধানী একটি চক্র বরাবরই পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চালায়। সম্প্রতি একই অবস্থা আমরা লক্ষ্য করেছি পঞ্চগড়ে। ধর্মের নাম দিয়ে সেখানে যে নৈরাজ্য করা হয়েছে তা কখনই ধর্ম হতে পারে না।

কেননা ইসলাম এমন এক শান্তিপ্রিয় ধর্ম যেখানে সকল ধর্মের অনুসারীদের সম্মানের শিক্ষা দেয়। প্রেমপ্রীতি, সৌহার্দ্য আর শান্তি ও সম্প্রীতির এক পরিমণ্ডল বিশ্বজুড়ে প্রতিষ্ঠিত করাই ইসলামের মূল লক্ষ্য। অন্য কথায়, আল্লাহ তাআলার প্রতি বিশ্বস্ততার হক আদায়ে এবং তার সৃষ্টির প্রতি দায়বদ্ধ আচরণের মাধ্যমে এ বিশ্ব এক স্বর্গ রাজ্যে পরিণত করা।

ধর্মীয় বিষয়ে একে অপরের সাথে মতপার্থক্য থাকতেই পারে। তাই বলে তার বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়ে প্রমাণ করবো আমিই শ্রেষ্ঠ? অবশ্যই না। কেননা প্রকৃত ইসলামের আকর্ষণীয় শিক্ষার প্রচার ও প্রসার জোর-জবরদস্তি এবং বল প্রয়োগে নয় বরং সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির দ্বারা মানুষের হৃদয় জয় করার মাধ্যমে সম্ভব। বল প্রয়োগ করলে অন্যের অধিকার যেমন দেয়া যায় না, তেমনি আল্লাহ তাআলার নৈকট্য লাভও এর দ্বারা সম্ভব নয়।

ইসলামে মুসলমান ও অমুসলমানের সম-অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলাম শত্রুদের সাথেও দয়ার্দ্র আচরণ করে, তা শান্তিকালীন সময়েই হোক বা যুদ্ধাবস্থায়ই হোক। সর্বাবস্থায় ইসলাম অমুসলমানদের অধিকার মর্যাদার সাথে সংরক্ষণ করে। বিদ্বেষ ছড়ানো ও আক্রমণের অধিকার ইসলামে নেই। চড়াও হওয়া বা আক্রমণ করার অধিকার ইসলামে নেই। ইসলামের বাস্তব শিক্ষা হলো, কেবল আক্রান্ত হলেই তুমি যুদ্ধ করতে পার। অধিকন্তু, ইসলামে এ নির্দেশও রয়েছে যে, আক্রমণকারী বা আগ্রাসী হয়ো না, চুক্তি ভঙ্গকারী হয়ো না। আগ্রাসন বলতে কী বুঝায়? সে যুগে ইসলাম বিরোধীরা পরাজিত সৈন্যদের দেহ ছিন্নভিন্ন করে বিকৃত করতো, এটা সমর নীতির পরিপন্থী, জিঘাংসামূলক অত্যন্ত গর্হিত এক কর্ম। ইসলামে এটি নিষিদ্ধ। শিশু ও নারীদের হত্যা করাও নিষিদ্ধ। এছাড়া কোন ফলবান বৃক্ষ নষ্ট না করার শিক্ষাও ইসলাম প্রদান করেছে এবং ধমীর্য় নেতাদের পাদ্রী-পুরোহিত, রাব্বী, প্রমুখদেরকে তাদের উপসনালয়ে হত্যা করা সম্পূর্ণ অবৈধ করা হয়েছে। অন্য কথায়, যুদ্ধ কেবলমাত্র সমরক্ষেত্রেই সংঘটিত হতে পারে। অথবা অন্য কোন বিকল্প খুঁজে না পেয়ে যদি শহর বা নগরে যুদ্ধ করতে বাধ্যও হতে হয়, তবুও কেবল তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করা যেতে পারে, যারা বিরোধিতায় আগ বাড়িয়ে অস্ত্র ধারণ করে আক্রমণ চালিয়েছে।

আমরা আজ এটাই দেখছি যে, সুন্দর সাবলীল ও সুগঠিত এই সব ইসলামি শিক্ষার ওপর কেউ আমল করছে না। বিভিন্ন স্থানে নৈরাজ্যকারীরা ধর্মের নামে শিশু, নারী, বৃদ্ধ, নির্বিশেষে সবাইকে হত্যা করতেও পিছপা হচ্ছেনা।
আজ আমরা অনেক ক্ষেত্রে মহানবির শিক্ষা ভুলে ভিন্ন পথ বেছে নিয়েছি। মহানবির (সা.) মৃত্যুর অল্পদিন আগে বিদায় হজের সময় বিরাট ইসলামি সমাগমকে সম্বোধন করে তিনি (সা.) উদাত্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হে মানবমন্ডলী! তোমাদের আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয় এবং তোমাদের আদি পিতাও এক। একজন আরব একজন অনারব থেকে কোনো মতেই শ্রেষ্ঠ নয়। তেমনি একজন আরবের ওপরে একজন অনারবেরও কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। একজন সাদা চামড়ার মানুষ একজন কালো চামড়ার মানুষের চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়, কালোও সাদার চাইতে শ্রেষ্ঠ নয়। শ্রেষ্ঠত্বের মূল্যায়ন করতে বিচার্য বিষয় হবে, কে আল্লাহ ও বান্দার হক কতদূর আদায় করলো। এর দ্বারা আল্লাহর দৃষ্টিতে তোমাদের মধ্যে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী সেই ব্যক্তি, যিনি সর্বাপেক্ষা বেশি ধর্মপরায়ণ।’ (বায়হাকি) এই মহান শব্দগুলো ইসলামের উচ্চতম আদর্শ ও শ্রেষ্ঠতম নীতিমালার একটি দিক উজ্জলভাবে চিত্রায়িত করেছে। শতধা বিভক্ত একটি সমাজকে অত্যাধুনিক গণতন্ত্রের সমতা ভিত্তিক সমাজে ঐক্যবদ্ধ করার কী অসাধারণ উদাত্ত আহ্বান।

বিশ্বাসের স্বাধীনতা হচ্ছে সব মানুষের মৌলিক অধিকার। ইসলাম ধর্মের বিধান মতে ‘ধর্ম’ হচ্ছে নিজ, পছন্দের একটি বিষয়। এ ধর্ম একটি সুস্পষ্ট ধর্ম। এই ধর্ম গ্রহণের পরেও চাইলে কেউ এটা ত্যাগ করতে পারে, কোন জোর নেই, তবে এর বিচার সর্বশক্তিমান আল্লাহ নিজ হাতেই করেন। ধর্মে যদি বল প্রয়োগের বিধান থাকতো, তাহলে মহানবি (সা.) মক্কা বিজয়ের পর অমুসলমানদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য বাধ্য করতেন এবং মক্কায় বসবাসের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নাই। এতে প্রমাণিত হয়, ধর্মের জন্য বল প্রয়োগ ইসলামের শিক্ষা নয়। ইসলামের আদর্শ হল শত্রুর সাথেও বন্ধুসুলভ আচরণের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা।

আমার ধর্মের সাথে, আমার মতের সাথে, আমার ইবাদতের পদ্ধতির সাথে আরেকজন একমত নাও হতে পারেন, তাই বলে কি তার বিরুদ্ধে আমাকে অবস্থান নিতে হবে? ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন ধর্মীয় ফেরকাকে পছন্দ নাও করতে পারি তাই বলে এ নিয়ে সমাজে বিশৃঙ্খলার কোন অনুমতি ইসলাম কেন কোনো ধর্মই দেয় না।

আমাদের দেশেও একটি মহল বিভিন্ন সময় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার পাঁয়তারা করে আর বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠির ওপর আক্রমণ করে আসছে কিন্তু এদেশের সচেতন নাগরিক বরাবরই তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে।
আরেকটি বিষয় আমাদেরকে মাথায় রাখতে হবে, দেশের আইন আছে। কোনো পরিস্থিতিতেই আমরা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারি না। সমাজে যারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার চেষ্টা করবে তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আমাদের প্রতিহত করতে হবে। এটা আমাদের দেশে হোক বা ভিন্ন দেশে। আমরা কোনোভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের আশ্রয় বা প্রশ্রয় দিবনা। এদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। হাজার বছরের এই ঐতিহ্যকে কোনোভাবেই নষ্ট হতে দেয়া যায় না। আমাদের সংবিধান দেশের সকল নাগরিককে স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম পালনের অধিকার প্রদান করেছে। তাই আমরা আশা করবো সরকার ও প্রশাসন সকল ধর্মীয় অনুসারীদের সেই অধিকার সংরক্ষণে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিবেন।

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।