ইসরায়েলের গণহত্যা ও শব্দের আধিপত্য ২

‘প্যালেস্টাইন হলোকাস্ট’

মুনতাসীর মামুন
মুনতাসীর মামুন মুনতাসীর মামুন
প্রকাশিত: ০৩:৩৮ পিএম, ১২ মে ২০২৪

শব্দের আধিপত্যের কথা বলছিলাম এবং গত ১১ মে-এর সংখ্যায় এ বিষয়ে আলোকপাত করেছিলাম। গত সংখ্যায় সেমাইট বিরোধিতা নিয়ে আলোচনা করেছিলাম।

কয়েকদিন আগে ‘হলোকাস্ট’ দিবস পালিত হলো। প্যালেস্টাইনে ব্যাপক গণহত্যা চালাতে থাকলেও ইসরায়েল সরকার বেশ আড়ম্বরের সঙ্গে ‘হলোকাস্ট’ দিবস পালন করেছে। এখন ইসরায়েল সরকার বারবার ‘হলোকাস্টে’র কথা বলছে একটি কারণে।

হলোকাস্টের বাংলা অর্থ করা হয়েছে ব্যাপক গণহত্যা। শব্দটির উৎস ও বিকাশ নিয়ে আলোচনা প্রাসঙ্গিক নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ইহুদিরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যাপক ইহুদী হত্যাকে হলোকাস্ট হিসেবে চিহ্নিত করে বলতে চেয়েছে হলোকাস্ট মানেই ইহুদী গণহত্যা। পরবর্তীকালে কবি, শিল্পী সাহিত্যিকরা শব্দটিকে আমাদের মননে গেঁথে দিয়েছেন। ইসরায়েল যে হলোকাস্ট দিবস ভালোভাবে পালন করল। তার উদ্দেশ্য একটাই, বিশ্বকে মনে করিয়ে দেওয়া যে জার্মানরা ৬০ লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করেছিল। বিশ্বের সমবেদনা আদায়।

ইহুদী ও তাদের মিত্ররা এই শব্দটিকে ইহুদীদের সমার্থক করার জন্য, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে আমেরিকা, জার্মানী, অস্ট্রিয়া, পোলান্ডে হলোকাস্ট মিউজিয়াম করেছে। বিভিন্ন জায়গায় নাজি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলি সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিয়েছে। প্রচুর ট্যুরিস্ট সেগুলি দেখতে যান। এবং এর একটি অভিঘাত তো আছেই। আমি ইউরোপ আমেরিকার কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলি দেখেছি, যাতনা বোধ করেছি এবং লিখেছি।

বছর দুয়েক আগে অসউইৎজ ও বার্লিনে হলোকাস্ট মিউজিয়াম দেখে এসেছি। ইহুদীরা প্রচুর বিনিয়োগ করেছে তাদের ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য। ইহুদিদের সঙ্গে বাঙালিদের তফাৎ এখানে যে, তারা সারা বিশ্বকে ইহুদী গণহত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চায়, সে ইতিহাস সংরক্ষণ করে। বাঙালি ৩০ লক্ষেরও বেশি শহিদের কথা ভুলিয়ে দিতে চায় এবং ঘাতকদের ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে।

জার্মানী আজ প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলি গণহত্যা সমর্থন করছে অপরাধবোধ থেকে। ইউরোপের অনেক রাষ্ট্র যেমন, ঐ সময় ইহুদিদের আশ্রয় দিয়েছে, নিপীড়নও করেছে। এক কথায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে গণহত্যা, জেনোসাইড বা হলোকাস্ট ইহুদী হত্যার সমার্থক।

এখন হলোকাস্ট বললে আমরা বুঝি শুধু ইহুদী হত্যা এবং ইহুদীরা এটিই চেয়েছিল। এই বোধ এমনভাবে প্রোথিত করা হয়েছে যাতে ইউরোপীয় বা যুক্তরাষ্ট্রের সংকারিয়াত ককেশিয়রা অপরাধ ভোগে। ইসরায়েল ও এর বাইরে যে সব ইহুদী বসবাস করেন তারা সংকারিয়াত ও ককেশিয়। এর মধ্যে ধর্মেরও একটা ব্যাপার আছে। তোরাহ্তে ওল্ড টেস্টামেন্টের ছায়া আছে। সুতরাং, অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের চেয়ে খৃস্টানরা ইহুদীদের কাছাকাছি পেতে ভালোবাসে।

 

ইহুদীদের বিশেষ ব্যবহৃত ‘শব্দ’ এখন প্যালেস্টাইনিদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। হিটলার অনেক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠিকে নিকেশ করতে চেয়েছিলেন, ইসরায়েল এখন প্যালেস্টাইনের সেমাইট গোষ্ঠিকে নিকেশ করতে চায় হত্যার মাধ্যমে, পিওর এথনিক ক্লিনজিং। সুতরাং, এর নাম দেয়া উচিত এখন ‘প্যালেস্টাইন হলোকাস্ট’।

 

প্রশ্ন হচ্ছে, হিটলার কি শুধু ইহুদী নিধন করেছিলেন? না করেন নি। তিনি কমিউনিস্ট, সোশ্যালিস্ট, লিবারেল, জিপসি, প্রতিবন্ধী, সমকামী- এ ধরনের প্রচুর মানুষকে হত্যা করেছেন। কিন্তু, তার এই গণহত্যা ‘হলোকাস্টে’ রূপান্তরিত হওয়ায় এটি শুধু ইহুদীদেরই বোঝায়। সংক্ষিপ্ত ব্রিটানিকা বিশ্বকোষে লেখা হয়েছে- ÒSystematic state sponsored killing of Jewish men, women and children and others by Nazi Germany…” ইহুদীরা এই ‘আদার্স’ শব্দটি বাদ দিতে চায় এবং দিয়েছেও।

অন্যদিকে থেকে দেখলে, ইহুদীদের বিশেষ ব্যবহৃত ‘শব্দ’ এখন প্যালেস্টাইনিদের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। হিটলার অনেক নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠিকে নিকেশ করতে চেয়েছিলেন, ইসরায়েল এখন প্যালেস্টাইনের সেমাইট গোষ্ঠিকে নিকেশ করতে চায় হত্যার মাধ্যমে, পিওর এথনিক ক্লিনজিং। সুতরাং, এর নাম দেয়া উচিত এখন ‘প্যালেস্টাইন হলোকাস্ট’। পরবর্তীকালে এই প্যালেস্টাইনি হলোকাস্ট সংরক্ষণ ও হলোকাস্ট মিউজিয়াম গড়ে তোলার জন্য এখনই উপাদান সংগ্রহ করে রাখা উচিত। এতে প্রমাণিত হবে, ইহুদীরা বিশেষ কোনো মর্যাদা ভোগ করতে পারে না। ওরাও ইউরোপীয় বা মার্কিনি গণহত্যাকারীদের মতো।

প্যালেস্টাইন হলোকাস্ট যারা সমর্থন করছে তারা, কোনো জায়গায় একজন মানুষ মারা গেলে মানবাধিকারের প্রশ্ন তুলে সে সরকারকে নাজেহাল করে কিন্তু লক্ষ মরলে তারা নিশ্চুপ থাকে। যেমন নিশ্চুপ ছিল ১৯৭১ সালে, আর এখন প্যালেস্টাইন হলোকাস্টের সময়।

লেখক: ইতিহাসবিদ, সাবেক অধ্যাপক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

এইচআর/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।