মন খারাপের গাড়ি : শব্দের বিন্যাসে শিল্পিত বোধের অভিব্যক্তি
এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত মাহবুবুল হক শাকিলের ‘মন খারাপের গাড়ি’ তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ। প্রথম প্রকাশিত ‘খেরোখাতার পাতা থেকে’ (২০১৫) কাব্যগ্রন্থের চেয়ে স্বতন্ত্র এটি; নতুন কণ্ঠস্বরের কবিতার বিন্যাসে ও গভীরতর বোধে উদ্ভাসিত কবির পঙক্তিমালা। কবি বাস্তবজীবনে নানাবিধ ভাবনায় উজ্জীবিত হয়েছেন, কোনো কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় তাঁর আবেগ ভিন্নতর গতিবেগে আবর্তিত হয়েছে। এভাবে ভাবনা-চিন্তা ও কল্পনার রূপান্তর কবিতার জন্ম দিয়েছে। কল্পনা ও ভাবাবেগে এবং মননশীলতা বোধের গভীরতায় তিনি পরিপূর্ণ এক কবি হয়ে উঠেছেন।
কবি বইটি উৎসর্গ করেছেন দগ্ধ সময়কে। উৎসর্গপত্রে কবি লিখেছেন ‘দগ্ধ সময়কে/ যাকে ধরতে চেয়েছিলাম/ আমারই রক্তে-কষ্টে কলমে।’ ১০২ পৃষ্ঠার এ বইয়ে মোট ৯২টি কবিতা রয়েছে। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মাহবুবুল হক শাকিল। তবে তিনি কবিতা-কল্পনা-লতার সাধনায় আত্মনিমগ্ন। তাঁর কবিতার পঙক্তিতে একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতি যেমন উঠে আসে, তেমনি উঠে আসে সমাজ ও প্রকৃতির কথা। এক সাক্ষাৎকারে মাহবুবুল হক শাকিল বলেছেন, ‘আমার মনে হয় কবি পরিচয় বা রাজনৈতিক কর্মী পরিচয়ের মধ্যে খুব একটা ভেদরেখা নেই। রাজনীতি যেমন একটি শিল্প, কবিতাও তেমনি একটি শিল্প। এবং কবিতা যদি হয় ব্যক্তিগত স্বপ্নের নির্মাণ, রাজনীতি হলো একটি সামগ্রিক বা সামষ্টিক স্বপ্নের নির্মাণ। স্বপ্নের সঙ্গে স্বপ্নের যেমন কোনো সংঘাত হয় না, কবি পরিচয়ের সঙ্গেও রাজনৈতিক পরিচয়ের কোনো সংঘাত হয় না।’
শেখ হাসিনা ও শেখ রেহেনা এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবিতা থাকলেও বিষয়বস্তুগত দিক থেকে ‘মন খারাপের গাড়ি’-এর অধিকাংশই ব্যক্তিগত অনুভূতির কবিতা। কবি নিজের সঙ্গে কথা বলেছেন। কবি তাঁর চারপাশে যা দেখেছেন তাকে নিজের করে নিয়েই প্রকাশ করেছেন। অনুভূতির তীব্রতা তাঁর কবিতার প্রধান প্রাণ। ‘স্বগত সংলাপ’-এ আছে : ‘ফিরে আসার নিয়ম মানেই ছেড়ে আসা;/ ছেড়েছি সব, জীবনের পুরনো কলরব।’ এজন্য কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেছেন, শাকিল ‘স্বীকারোক্তিমূলক ধারার কবি’। যিনি প্রথমে নিজের কাছে, পরে সমাজ বা জগতের কাছে স্বীকারোক্তি দেন। সমাজ বা জগৎ তার কথা শুনলো কি না তা নিয়ে কোন মাথাব্যথা নেই। তিনি নিজের কাছে স্বীকারোক্তি করেই যাচ্ছেন। প্রত্যেকটি কবিতা তার হৃদয় নিংড়ানো।’
মাহবুবুল হক শাকিলের কবিতায় শব্দের বিন্যাসে শিল্পিত বোধের অভিব্যক্তি আছে। বর্তমান সময়ের কবিদের চেয়ে তিনি কিছুটা আলাদা। তাঁর কবিতায় গীতিলতা, নস্টালজিয়া, বাংলাদেশ ও সমকাল পৃথিবীর চেহারা এবং মানবিকতার নানা বিষয় রয়েছে। যেমন, ‘ক্যাম্প-এক্সরে’ কবিতায় শব্দ ব্যবহার লক্ষ করুন- ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের ভুল প্রশ্নের মুখোমুখি/ ইহুদি যুবক, সংকুচিত হই পোল্যান্ডের ঠাণ্ডায়/ মাথা গুঁজে পড়ে থাকি পোল্যান্ডের দখলী স্থলে।’ এভাবে তাঁর কাব্যে শব্দ বিন্যাস মানবিক ও আন্তর্জাতিকতাবোধে সমন্বিত হয়েছে। তাঁর কবিতার অনেক জায়গায় আধুনিক বাংলা কবিদের মতো প্রকৃতির কথা এসেছে। যেমন- ‘মরা রোদ’ কবিতায় আছে- ‘ধূসর প্রহর জুড়ে অথৈ শূন্যতা, বিরান উঠান/ ধানশালিকের ক্লান্তি নিয়ে/ পুকুর জুড়ে ডানা মেলে বয়োবৃদ্ধ বট।’
মাহবুবুল হক শাকিলের মতে, ‘কবিতা একটি চলমান ক্যারাভান।’ কবিতা ক্যারাভান বলেই ‘মন খারাপের গাড়ি’র যাত্রা দুঃখবোধ, অতৃপ্তি ও বেদনাকে আলিঙ্গন করে। এ যাত্রা আমৃত্যু চলবে। কারণ একজন কবি কখনও থামেন না। তিনিও থামবেন না। তিনি তাঁর যাপিত সময়কে ধারণ করেছেন কবিতার চরণে। আর অতিক্রম করা সময়কে ধরার চেষ্টায় কবিতাগুলোকে বই আকারে প্রকাশ করেছেন। কবিতায় তাঁর কথোপকথন শুধু নিজের সাথে হলেও পাঠক হিসেবে আমরা কবির অনুভূতিতে অভিভূত।
মাহবুবুল হক শাকিলের ‘মন খারাপের গাড়ি’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশ করেছে অন্বেষা প্রকাশন। প্রচ্ছদ একেঁছেন ধ্রুব এষ। বইটির মূল্য ২০০ টাকা।
এইচআর/এমএস