ঢাকা-১৫

বৃষ্টি যেন মৃত্যুফাঁদ, মাদক-দখল-চাঁদাবাজি সমাধানে নেই মনোযোগ

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১২:৩২ পিএম, ২৪ অক্টোবর ২০২৩
বাঁ থেকে কামাল আহমেদ মজুমদার, গাজী মেসবাউল হোসেন সাচ্চু ও এম সাইফুল্লাহ সাইফুল

রাজধানীর কাফরুল ও মিরপুর থানার আংশিক নিয়ে ঢাকা-১৫ আসন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৪, ১৩, ১৪, ও ১৬ নম্বর ওয়ার্ড এই আসনে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ ভোটারের এ এলাকার বড় সমস্যা জলাবদ্ধতা। গত মাসে কয়েক ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় পুরো এলাকা। কোমর সমান পানি ওঠে সেনপাড়া, কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়াসহ কিছু এলাকায়। 

এর বাইরে আছে গ্যাস সংকট, খানাখন্দে ভরা অলিগলির রাস্তা, মাদক ও কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত, ফুটপাত দখল ও নানান উপায়ে চাঁদাবাজি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা এসব সংকট সমাধানে উদ্যোগী নন। বরং কাদা ছোড়াছুড়ির পাশাপাশি কিছু সংকট লালনও করেন তারা। যে কারণে ভোটারদের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ আছে তাদের ওপর।

আরও পড়ুন>>নৌকা নিয়ে ভোটে লড়ার প্রস্তুতি অর্ধশত আইনজীবীর

স্থানীয়রা বলেন, তারা যুগ যুগ ধরেই দেখে আসছেন এখানে বৃষ্টি হলে অতিমাত্রায় জলাবদ্ধতা হয়। কোমর সমান হয়ে যায় পানি। কোনো সরকারই এ সমস্যার সমাধান করেনি। গ্যাস সংকট তো দিন দিন প্রকট হচ্ছে। আর চাঁদাবাজি, ফুটপাত দখল, মাদক ও কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত এলাকাভেদে কমবেশি আছে। এগুলো রাজনীতির ছত্রছায়ায় হয়। রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা থাকলে এগুলো বন্ধ হবে।

প্রচারণায় হেভিওয়েট তিন প্রার্থী

এই এলাকা ঘুরে বর্তমান এমপি কামাল আহমেদ মজুমদারের পাশাপাশি আরও তিন প্রার্থীর প্রচারণা চোখে পড়েছে। তারা হলেন আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজী মেসবাউল হোসেন সাচ্চু, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা ও মিরপুর মুন্সিবাড়ির সন্তান এম সাইফুল্লাহ সাইফুল।

এলাকার সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে বর্তমান এমপি কামাল আহমেদ মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এলাকার জনগণ আমার পক্ষে। আমি শতভাগ নিশ্চিত, আমাকে আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে কেউ প্রতিযোগিতা করে টিকবে না।’

‘বর্তমান একজন এমপি আছেন, তার চেয়ে নিজেকে যোগ্য কেন মনে করেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবে গাজী মেসবাউল হোসেন সাচ্চু জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ এলাকায় আমার জন্ম, এখানেই ছোট থেকে বড় হয়েছি। ১৯৮৭ সালে থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলাম, এরপর মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলাম। এখন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি। দীর্ঘ ৩৭ বছর এ এলাকার রাজনীতিতে সক্রিয়। এখানকার সমস্যা আমি ভালো জানি। যদি প্রধানমন্ত্রী মনোনয়ন দেন, তাহলে এসব সমস্যা সমাধানে যথেষ্ট চেষ্টা করতে পারবো।’

একই প্রশ্নের জবাবে আরেকপ্রার্থী এম সাইফুল্লাহ সাইফুল জাগো নিউজকে বলেন, ‘বর্তমান একজন এমপি আছেন, চিরদিন তো কেউ থাকে না। ওনার বয়স হয়ে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনে আগামী প্রজন্মকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন নেতৃত্ব প্রয়োজন।’

আরও পড়ুন>>সংগঠন গোছানো-ভোটারদের কেন্দ্রে আনাই আওয়ামী লীগের বড় চ্যালেঞ্জ

তিনি বলেন, ‘এ জনপদটার সঙ্গে আমার নাড়ির সম্পর্ক। এখানে আমার রক্তের আত্মীয় ও আত্মার আত্মীয়-স্বজন বসবাস করে এবং তারাই নেতৃত্ব দেয়। কাউন্সিলরদের মধ্যে আমার আত্মীয়-স্বজনই বেশি। রাজনৈতিকভাবে এ সংগঠনের সঙ্গে ৩৫-৪০ বছর ধরে জড়িত। এমন কোনো আন্দোলন নেই, যে আন্দোলনে আমি অগ্রণী ভূমিকা পালন করিনি।’

‘ওয়ান/ইলেভেনেও আমি এখানে সম্মেলন করা এবং নেত্রীর মুক্তির জন্য মিছিল করা থেকে শুরু করে সবই করেছি। তখন কেউ ছিল না, আজ অনেক বড় বড় প্রার্থী, অনেক লোকজন আসছে, এটা সত্যি। কিন্তু আমি পালিয়ে যাইনি। আমি জীবনবাজি রেখে সংগঠন ও নেত্রীর জন্য কাজ করেছি। যেহেতু আমি এই মাটির সন্তান। এই মাটির সুখে-দুঃখে আমি জড়িত। সুতরাং, আমি আশা করি, নেত্রী আমার দিকটা বিবেচনা করবেন।’

তবে নগর আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নগণ্য কর্মী। নেত্রী যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই ‍চূড়ান্ত। সেটা মেনেই মাঠে কাজ করবো।’

ভোটারদের মধ্যে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ

এলাকার সমস্যা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে রয়েছে পুঞ্জীভূত ক্ষোভ। তারা মনে করেন, রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা থাকলে এলাকার দীর্ঘদিনের সমস্যাগুলো সহসা সমাধান করা সম্ভব। কিন্তু নেতাদের এদিকে মনোযোগ নেই।

jagonews24
সামান্য বৃষ্টিতেই এমন জলাবদ্ধ হয়ে পড়ে মিরপুর

ঢাকার এ আসনটির বাসিন্দা শাহনাজ বেগম বলেন, ‘ঢাকা-১৫ আসনের রাস্তার অবস্থা সারাবছরই খারাপ ছিল, খাদাখন্দে ভরা। জলাবদ্ধতা ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা, যার দিকে মনোযোগ দেওয়া অতি জরুরি ছিল সংসদ সদস্যের। এ এলাকার যে একজন এমপি আছেন, এটি কখনো মনেই হয়নি। যে জনপ্রতিনিধিকে দেখা যায় না, দৃশ্যমান না, প্রয়োজনে খুঁজে পাওয়া যায় না, সেই জনপ্রতিনিধি প্রয়োজন নেই। তরুণ নেতৃত্ব প্রয়োজন।’

একই আসনের পশ্চিম শেওড়াপাড়ার বাসিন্দা আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘ছয় বছর আগের যেমন রাস্তাঘাট দেখেছি, এখনো তেমনি। ভাঙা রাস্তা। অল্প কিছুদিন আগে বৃষ্টিতে কোমর সমান পানি ডিঙিয়ে বাসায় এসেছি। সাধারণ বৃষ্টি হলেও হাঁটু সমান পানি হয়। কোনো কোনো জায়গায় স্ট্রিট লাইট নেই। নাগরিক হিসেবে এই সেবাগুলো আমি আশা করতেই পারি। কিন্তু নেতা-জনপ্রতিনিধিদের এদিকে খেয়াল নেই।’

আরও পড়ুন>>ঢাকা ১০ আসন: কে ধরবে নৌকার হাল? 

রাফিয়া নামের একজন বলেন, ‘এলাকায় কিশোর গ্যাং আর মাদককারবারিদের উৎপাত আছে। এই তো কিছুদিন আগেও মোল্লাপাড়ায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা একটা ছেলেকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে। ছেলেটি ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন।’

সমস্যা নিয়ে দায় চাপাচ্ছেন জনপ্রতিনিধি

এলাকার সমস্যা নিয়ে ঢাকা-১৫ আসনের সংসদ সদস্য ও শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘বৃষ্টিতে সড়ক ডুবে যাওয়ার বিষয়টি স্থানীয় সরকারের কাজ, সিটি করপোরেশনের কাজ। এটা এমপি-মন্ত্রীর কাজ না। এলাকায় সমস্যা থাকলে আমরা সংসদে তুলে ধরতে পারি, মেয়রকে রিকোয়েস্ট করতে পারি। কিন্তু স্থানীয় সরকারের কাজে আমরা হস্তক্ষেপ করতে পারি না।’

জলাবদ্ধতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার এলাকায় জলাবদ্ধতা নেই বললেই চলে। তবে চাঁদাবাজি, মাদক, ফুটপাত দখল যেগুলো বলছেন এগুলো করে আমার ভাই সাচ্চু। আমার ভাই সাচ্চু ভাইয়ের মার্কা কী? চাঁদাবাজি, ফুটপাত দখল-ফেন্সিবাজি ছাড়া আর কী!’

এগুলো বন্ধে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন জানতে চাইলে সংসদ সদস্য বলেন, ‘এ এলাকায় সন্ত্রাসী ছিল। আমি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসছি। চাঁদাবাজ, ধান্ধাবাজ, টেন্ডারবাজদের গুনি না। এসব কোনো কিছুই করি না। এগুলোরে সকালে পুলিশ তুলে দিলে বিকালে গিয়ে আমার সাচ্চু ভাইয়েরা বসিয়ে দেয়।’

স্থানীয় সংসদ সদস্যের অভিযোগের জবাবে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজী মেসবাউল হোসেন সাচ্চু জাগো নিউজকে বলেন, ‘উনি মুরুব্বি। যখনই কেউ প্রার্থী হয়, তার বিরুদ্ধে এগুলো বলে। তার বিরুদ্ধে আপনারা খোঁজ-খবর নেন, অনেক কিছু জানতে পারবেন। আমি তার বিরুদ্ধে বলবো না, তিনি আমার দলের লোক, তার বিরুদ্ধে বলা মানে দলের বিরুদ্ধে বলা।’

তিনি বলেন, ‘চাঁদাবাজি তো দূরের কথা, আমি কোনো জায়গা থেকে কোনো টাকা নিয়েছি, কাউকে চাকরি দিয়ে টাকা নিয়েছি বা স্কুলে ভর্তি করে টাকা নিয়েছি, প্রমাণ করতে পারলে রাজনীতি ছেড়ে দেবো। আমার জানা মতে, ঢাকা-১৫ আসনে কোনো কিশোর গ্যাং নেই।’

জাতীয় সংসদের ১৮৮ নম্বর আসন ঢাকা-১৫। এখানে মোট ভোটার ৩ লাখ ৪০ হাজার ৫২৮। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৭৫ হাজার ১০৪ ও নারী ভোটার ১ লাখ ৬৫ হাজার ৪২৪ জন।

স্থানীয়ভাবে বেশ কিছু গার্মেন্টস কারখানা থাকায় শ্রমিক আছে বেশ এ এলাকায়। যার কারণে রাজনৈতিক নেতাদের মিছিলও সহজেই হয় দীর্ঘ। কিন্তু প্রকৃতার্থে ভোটের মাঠে কার অবস্থান কেমন, পরখ করতে অপেক্ষা করতে হবে ভোটের দিন পর্যন্ত।

এসইউজে/এএসএ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।