সচেতন জাতি অজুহাত নয়, খোঁজে সমাধান

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ১১:২২ এএম, ২৮ এপ্রিল ২০২৫

একটি জাতি নিজের ভুলে ধ্বংস হয় না, ধ্বংস হয় যখন সেই ভুল ঢেকে রাখে অজুহাত দিয়ে, আর প্রতিটি প্রশ্নের বদলে দাঁড় করায় ‘তুই তো আরও খারাপ’ নামের প্রতিযোগিতা। বাংলাদেশ আজ ভয়াবহ এক চক্রে ঘুরছে—যেখানে সমস্যা সমাধানের আগে চলে অজুহাতের প্রতিযোগিতা, নিষ্ঠার আগে চলে দলীয় পরিচয়ের অন্ধ মোহ, আর সত্যের আগে দাঁড়িয়ে থাকে ‘আমার দলের গর্ব’। আমরা যারা নিজের দেশকে ভালোবাসি, তাদের সামনে এখন আর কাঁদার সময় নেই—সময় এসেছে সত্য বলার, জবাব চাওয়ার, আর একটি সচেতন নাগরিক বিপ্লবের রূপরেখা নির্মাণ করার।

আমিও এক সময় আওয়ামী লীগের প্রশংসা করেছি—আমরা অনেকে বিএনপিকে বিকল্প ভাবতাম। কিন্তু আজ বাস্তবতা কী? যারা গত ১৫ বছর ধরে আওয়ামী লীগের বন্দনা করেছে, আজ তারা বিএনপির জয়গান গাইছে। দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখল, টেন্ডারবাজি—একই নাটক, শুধু মুখোশ বদল। আজ শেখ হাসিনা যখন ইতিহাসের দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন, তখন সেই ময়না পাখিরা নতুন মালিক খুঁজে নিচ্ছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে যারা ছিল, আজ বিরোধী হয়ে লুঠের ফাঁদ পাতছে। সমস্যা আসলে দল নয়, সমস্যা চরিত্র। এরা সবাই মিলে বাংলাদেশকে নিয়েছে জিম্মি করে। তারা চায় না শক্তিশালী নাগরিক সমাজ, তারা চায় বিভক্ত, বিভ্রান্ত, অজুহাতে মাতোয়ারা এক জনগোষ্ঠী।

বিজ্ঞাপন

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে ঋণ জালিয়াতির পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। প্রতি বছর সরকারি প্রকল্পে গড়পড়তা ২০-৩০ শতাংশ বাজেট লোপাট হয়। এলসি সংকট, রিজার্ভ সংকট, বিদ্যুৎ বিপর্যয়—সবই লুটপাট ও ব্যর্থতার সরাসরি ফলাফল। আমরা আজ একটি রাষ্ট্রকে মাতৃভূমি নয়, দলীয় ‘পাওনা আদায়ের’ কার্যালয় হিসেবে দেখছি। এই লজ্জা শুধু সরকারের নয়, এই লজ্জা আমাদেরও—যারা প্রশ্ন না করে সব মেনে নিচ্ছি।

আমরা যাদের ‘রেমিট্যান্সযোদ্ধা’ বলি—তারা হচ্ছে সেই নিঃশব্দ নায়ক, যাদের পাঠানো কষ্টার্জিত অর্থে এই দেশের রিজার্ভ গড়ে উঠেছে, যাদের ঘামে ভেজা টাকায় চলে সরকারের উন্নয়নের মোড়কধারী ভাষণ। কিন্তু আজ সেই অর্থ দুর্নীতির স্রোতে ধুয়ে যাচ্ছে, ব্যাংক লুটেরাদের পকেটে ঢুকে পড়ছে, অপচয় ও বিদেশে পাচারের মাধ্যমে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রবাসীরা একদিনে টাকা আয় করেন না— দিনে ১২–১৪ ঘণ্টা শ্রম, অপমান, নিরাপত্তাহীনতা আর সামাজিক বিচ্ছেদের বিনিময়ে তারা যে টাকা পাঠান, তা রাষ্ট্রের মূল চালিকাশক্তি হয়ে দাঁড়ায়। তবু রাষ্ট্রের চোখে তারা কেবল ‘টাকার মেশিন’—সম্মান নয়, সুরক্ষা নয় বরং অবহেলা আর প্রতারণা তাদের প্রাপ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অন্যায় শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি নৈতিক বিশ্বাসঘাতকতা। এদের পাশে না দাঁড়ালে, এই রাষ্ট্রের ভিত্তিই হবে লুণ্ঠনের উপর নির্মিত এক আত্মবিক্রয়।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

একটি জাতির বিবেক হলো শিক্ষা আর সংবাদমাধ্যম। কিন্তু আমাদের মিডিয়া আজ দলীয় বিজ্ঞাপনদাতার পোষা কণ্ঠে পরিণত হয়েছে। স্বাধীন মতপ্রকাশ আজ ‘রাষ্ট্রবিরোধিতা’র সমান। আর শিক্ষা? যেখানে ছাত্রলীগ আর ছাত্রদল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখল করে রাখে, যেখানে প্রশ্ন করার সাহস নেই, সেখানে ‘সচেতন নাগরিক’ নয়, তৈরি হয় কোচিং নির্ভর, লেজুড়বৃত্তির অভ্যস্ত এক মূর্খ প্রজন্ম।

বিপ্লব কেবল সরকারের পতনে নয়, বিপ্লব হয় নিজের চিন্তা বদলাতে। আমরা যদি নিজেদের না প্রশ্ন করি—আমার ভোট আমি কীভাবে দিই? আমি দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিই কেন? আমি একজন নৈতিক নেতাকে খুঁজে নিতে ব্যর্থ কেন? আমি ‘আমার দলের চোর ভালো’ বলে ভাবি কেন? তাহলে কোনো সরকারই পরিবর্তন এনে দিতে পারবে না। তাহলে হাজার বিপ্লবেও কোনো অর্থ থাকবে না।

রুয়ান্ডা, ১৯৯৪ সালের গণহত্যার পরেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। আজ তারা আফ্রিকার অন্যতম উদাহরণ—আইটি, প্রশাসন, মানবিক উন্নয়নে শীর্ষে। দক্ষিণ কোরিয়া, ১৯৭০-এর দশকে ছিল বাংলাদেশর মতোই গরিব। আজ তারা প্রযুক্তি, শিক্ষা ও স্বচ্ছতাকে রাষ্ট্রীয় ভিত্তিতে পরিণত করেছে। আমরা কেন পারবো না? আমাদের দরকার স্বচ্ছতা, শিক্ষা ও নাগরিক চেতনার উপর এক ঐতিহাসিক শ্রদ্ধাবোধ।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

আজকের তরুণ প্রজন্ম ইতিহাসের সবচেয়ে বিভ্রান্ত সময় পার করছে—একদিকে চাকরির অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে দলীয় দখলের নোংরা প্রলোভন। কিন্তু তারাই পারে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আনতে। তারা যদি—সত্য বলার সাহস রাখে, তথ্যের ভিত্তিতে প্রশ্ন করে, গোষ্ঠী নয়, নীতি দেখে চলতে শেখে, দলীয় সিল বাদ দিয়ে নৈতিক নেতৃত্ব খোঁজে—তবে এ জাতিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।

নিজেকে প্রশ্ন করা শুরু করো। ‘আমি কি সত্য বলছি, না সুবিধার পথে হাঁটছি?’ নৈতিক নেতৃত্বের জন্য সক্রিয় হও। দল নয়, আদর্শ দেখো। শিক্ষা ও মিডিয়া সংস্কারে আওয়াজ তুলো। যথাযথ পাঠ্যপুস্তক, ইতিহাসের সত্য, স্বাধীন সাংবাদিকতা নিশ্চিত করো। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ো। ঘুষখোরকে লজ্জা দাও, বাহবা নয়। তরুণদের নেতৃত্বে সত্যভিত্তিক প্ল্যাটফর্ম গড়ো। রাজনীতি নয়, মূল্যবোধে নেতৃত্ব গড়ে তোলো।

আমরা আর ‘অজুহাত’ খুঁজবো না—আমরা প্রশ্ন করবো, প্রতিরোধ করবো, পুনর্গঠন করবো। আমরা নিজেদের ভাঙবো, আবার নিজেরাই গড়বো। আমরা দল পাল্টাবো না—আমরা চিন্তা, চেতনা, চরিত্র পাল্টাবো। আমরা ক্ষমতার পদলেহন করবো না—আমরা ন্যায়ের দীপ্ত চিহ্ন হয়ে ইতিহাসে নিজেদের নাম লিখবো। এই লেখা কোনো রাজনৈতিক বিবৃতি নয়—এই লেখা একটি জাতির আত্মসমালোচনার গর্জন, একটি বিবেকবান বিপ্লবের ডাক। এই লেখা একটি নতুন নাগরিক যুগের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে সেই সাহসী মানুষের কণ্ঠস্বর—যে মানুষ নিজের চেয়ে দেশকে বড় ভাবতে শিখেছে। এই লেখা প্রতিজ্ঞা—যে বাংলাদেশ এখনো হারায়নি, বরং বেঁচে আছে প্রতিটি সচেতন হৃদয়ে—প্রতিটি সত্যভাষণে, প্রতিটি ন্যায়বিচার চাওয়ার আওয়াজে।

বিজ্ঞাপন

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com