এ যেন মনোমুগ্ধকর পড়ন্ত যৌবন

পুরো মেলবোর্ন শরৎ রঙে আচ্ছাদিত, চারপাশে রঙবেরঙের পাতার সমারোহ দেখতে বেশ লাগে। ঠিক মানবজীবন চক্রের পৌঢ় ভাগ যেন। ঝরে পরার আগ মুহূর্ত পাতাগুলো হলদেটে লাল, কিছুদিন পর মুচমুচে বাদামি হয়ে বুড়িয়ে যাবে এরপর সবার অলক্ষেই একদিন ঝরে যাবে গাছগুলোকে ন্যাড়া করে দিয়ে।
এই পাতার রং বদল দেখতে বহু মানুষ আসেন দূর দুরন্ত থেকে, মেলবোর্নবাসিরাও দেখতে যায় দল বেঁধে বা দলছুট হয়ে... সব সময়েই যে দূরেই যেতে হয় তাও নয়, ভাগ্য ভালো হলে কোনো নিদিষ্ট জায়গায় যাওয়ার আগেই বাড়ির কাছে দিয়ে রাস্তার দুধারে দেখা মিলে যায় রংবেরঙের পাতা অথবা বাড়ির ব্যাক ইয়ার্ড এ! মনোমুগ্ধকর স্নিগতা পড়ন্ত যৌবন এ...
গতকাল ৩ মে অস্ট্রেলিয়ায় ফেডারেল ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হলো। সকালে এলাকার প্রাইমারি স্কুলে ভোট দিয়ে গিয়ে স্থানীয় এলাকার এমপির সঙ্গে দেখা হলো, উনি একা লাইন এ দাঁড়ানো ভোটারদের কাছে গিয়ে গিয়ে খুবই স্বাভাবিক কণ্ঠে কুশলাদি বিনিময় করছিলেন, মাঝে মাঝে তার দলের বিগত বছরের দু’একটা সাফল্য বলছেন অথবা আগামীতে আবার ক্ষমতায় গেলে কি কি করতে চান সেগুলোও বলছেন কিন্তু সরাসরি ভোট চাইছেন না বা একটি বারের জন্য ও তার দলকে ভোট দিতে বলছেন না।
আমাকে হ্যালো বললেন, আমি জিজ্ঞাসা করলাম তুমি কেমন আছো, শরীর কেমন? হেসে উত্তর দিলো এখন অল্পতেই হাঁপিয়ে যাচ্ছি, যেহেতু সম্ভাব্য তারিখ বেশ কাছে, উত্তর দিলাম শুভকামনা রইলো অনাগত সন্তান ও তোমার জন্য। এরপর আমার পেছনে দাঁড়ানো অল্পবয়স্ক দুটো মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলেন কোনো ইউনিতে পড়ে তারা?
ইউনিভার্সিটির নাম শোনার পর উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ওই ইউনিভার্সিটিতে তারও একটি ডিগ্রি আছে। এখানে উল্লেখ্য যে অস্ট্রেলিয়ায় এমপি বা মন্ত্রী যারা হন তারা সবাই উচ্চশিক্ষিত এবং অপেক্ষাকৃত বেশি যোগ্যতা সম্পন্ন যার যার মন্ত্রণালয় অথবা দফতরে। এখানে পারিবারিক রেল লাইন বা বড় ভাইয়ের খুঁটির জোর নেই, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত যোগ্যতা।
লাইন পেরিয়ে কোনো রকম অমোচনীয়কালীর দাগ ছাড়াই ভোট দেয়া সম্পন্ন করলাম এরপর সারাদিন বিভিন্ন ব্যস্ততায় ভোটের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম। রাত্রিতে ভোটের খবরাখবর নিতে গিয়ে দেখি, ক্ষমতাশীন দল আবারো অনেক ভোটের ব্যবধান এ জয়লাভ করেছে। এই জয় অবশ্যই তাদের প্রাপ্য কারণ এই জয় যতটা না তাদের ভালো কাজের জন্য তার চেয়েও খানিকটা বেশি অন্যতম প্রধান বিরোধী দলের অতি রক্ষণশীল মনোভাব ও একগুঁয়ে নীতির জন্য। ফলাফল Anthony Albanese বিপুল ভোটে জয়ী অপর দিকে দাম্ভিক Peter Dutton শোচনীয়ভাবে ধরাশায়ী।
অস্ট্রেলিয়ায় ভোটে হারলেই, সুষ্ঠু ভোট গ্রহণ হয় নাই, ভোটে কারচুপি হয়েছে এ ধরনের বাতুলতা করার কোনো সুযোগ নেই। সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও পর্যাপ্ত যোগ্য লোকবলের উপস্থিতিতে এখানে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয় এবং তিন স্তর বিশিষ্ট নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝে ভোট গণনা সম্পন্ন হয় সুতরাং উল্টোপাল্টা কথা বলার কোনো অবকাশ যেমন নেই তেমন কেউ বলেনও না সেটাও সত্য।
অস্ট্রেলিয়ার ভোটগ্রহণ ও ফলাফল থেকে সব দেশের সচেতন ও বুদ্ধিমান রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় বিষয় আছে তবে জেগে ঘুমানো এবং আন্ধা, বয়রাদের জন্য শেখার কিছুই নেই। তাদের শিক্ষা বহু আগেই সমাপ্ত, এদের অন্তরে মোহর অঙ্কিত হয়ে গেছে, এদের অন্তর তালাবন্ধ এবং অতি অহংকার এ পরিপূর্ণ ঠিক যেমনটা কিছু মানুষ আমরা দৈনন্দিন জীবনে দেখি যাদের বারংবার সাবধান করার পরেও এদের কোনো পরিবর্তন আসে না। কিন্তু অহংকার যে পতনের মূল এটা কে না জানে।
সেই ছোট্ট বেলা থেকে আজ অবধি সমাজে চলতে ফিরতে আমরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনের মানুষের সংস্পর্শে আসি। এদের মাঝে কারো কারো সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়, বন্ধুত্ব হয়, কারো সঙ্গে হয় না, কারো সঙ্গে সম্পর্ক স্বল্পদিন স্থায়ী হয়, কারো সঙ্গে সম্পর্ক আজীবন চলমান। কারো সঙ্গে সম্পর্ক মাঝপথে থেমে যায় কারণ যেমনটা ভেবে আগানো হয়েছিল কিছু দিন পর দেখা যায় সে বা তারা তেমনটা না, পুরোটাই মুখোশ ছিল, আসলরূপ বেরিয়ে গেছে।
আবার কখনো বহুদিন পর চেনা কারো সঙ্গে দেখা হলে কথা শেষ হতে চায় না, ঠিক সেই আগের মতোই আপন উষ্ণ অনুভূতি আবার কখনো কারো সঙ্গে দেখা হলে কথা আগায় না আলগা আলগা লাগে কারণ সময়ের ব্যবধান দুটো মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি, আচরণ ও কথাবার্তা বদলে যাওয়ায় আর আগের মতো আর জমে ওঠে না।
ধরুন এই বয়সেই কারো সঙ্গে নতুন পরিচয় হলো, কথা বলতে ভালো লাগছে, কথা আগাচ্ছে...একটা ইতিবাচক সম্পর্ক হতে পারে আবার অন্যক্ষেত্রে কারও সঙ্গে নতুন পরিচয় হলো, কিন্তু কি বলবেন সেটাই খুঁজে পাচ্ছেন না। এ রকমটা প্রতিটা মানুষের জীবনেই হয়, প্রতিটা। কারণ প্রতিটা মানুষের জীবন দর্শন আলাদা, চিন্তা চেতনা, ভাবনা আলাদা। সবার সাথে সবার মিলবে না, কখনোই না।কেউ মনোযোগ পেতে পছন্দ করেন, কেউ বলতে পছন্দ করেন, কেউ খোঁচাতে পছন্দ করেন, কেউ হজম করতে পছন্দ করেন, কেউ সবখানে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেন, কেউ সবখানের সুবিধা দেবার চেষ্টা করেন, কেউ অন্যের উপকার করতে ভালোবাসেন, কেউ হিংসা হীনমন্যতায় অন্যের ক্ষতি করে বসেন, কেউ কথা না বলে ঝামেলা মুক্ত থাকতে পছন্দ করেন, কেউবা কথা বাড়িয়ে ঝামেলায় যুক্ত হতে পছন্দ করেন।
কেউ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, কেউ অন্যের জীবনে কি হচ্ছে সেটা জানতে উদগ্রীব থাকেন, কেউ ব্যক্তিগত জীবনকে ব্যক্তিগত রাখেন, কেউ ব্যক্তিগত জীবনকে উন্মুক্ত করে ফেলেন, কেউ দুই লাইন কথাকে দশ লাইন বাড়িয়ে বলেন গল্পের মতো আবার কেউ দশ লাইন কথাকে ছোট্ট করে এক-দুই লাইনে শেষ করেন সারাংশের মতো।
এখানে দুর্ভাগ্যজনক সত্য হচ্ছে আমি যেহেতু গল্প এবং সারাংশ দুটোই লিখি তাই দুটোই বুঝতে পারি যা হয়ত আমার মতো অনেকেই পারেন এবং এই অনুভূতি আর যাই হোক সুখ কর নয় কিন্তু পরে আমি বা তারা সেটা ঢাক ঢোল পিটিয়ে প্রকাশ করবেন নাকি জেনে বুঝে চুপ থাকবেন সেটা অবশ্যই আমার বা তাদের ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধি ও বিবেচনার ওপর নির্ভর করে।
জীবনে এ রকম নানান রকমের নানান বৈশিষ্ট্য বিশিষ্ট মানুষের মাঝে আমরা চলি, নিজেদের মানিয়ে নেই বা মানিয়ে নিতে চেষ্টা করি। কখনো কখনো খেই হারিয়ে ফেলি আবার কখনো লাগাম টেনে ধরি, কখনো সহ্য সীমার বাইরে চলে গেলে রুদ্রমূর্তি ধারণ করি। আবার কখনো বিরক্ত বা তীব্র মনোব্যথা নিয়ে সরে যাই। তবে সৃষ্ট ক্ষতটা রয়ে যায় আজীবন, চলমান জীবনের ব্যস্ততায় কিছুটা ঢাকা পরে হয়ত কিন্তু মুছে যায় না।
প্রতিটা মানুষের প্রতিটা কথা, প্রতিটা আচরণ যার যার ব্যক্তিত্বকেই প্রতিনিধিত্ব করে। ইসস... আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা যদি এটা বুঝতেন! আপনি যখন একা কোনো কথা বলেন সেই কথার দায় আপনার একার কিন্তু আপনি যখন কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে কথা বলেন তখন ওই বক্তব্যের দায় অবশ্যই পুরো রাজনৈতিক দলের।
সেক্ষেত্রে ‘তিনি বলেছেন, আমরা তো না’ এসব বলে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই এবং খুবই দুঃখজনক সত্য হচ্ছে এই একটা-দুটো বক্তব্যের জন্য পুরো রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে শোচনীয় হার হতে পারে বা দল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে গিয়ে পৌঁছাতে পারে সেটা বোঝার মতো সক্ষমতা সেসব রাজনৈতিক দলের নেই।
তিতা সত্য হলো সামষ্টিক নেতৃত্ব সবাই দিতে পারেন না অথবা নেতৃত্বের ভার সবাই বইতে পারেন না সুতরাং সামষ্টিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব অযোগ্য কারো হাতে তুলে দেওয়া যে কোনো রাজনৈতিক দলের জন্য ভয়ংকর ভুল সিদ্ধান্ত যার ফলাফল সেই দলকে এবং ভোগান্তি সেই দেশের সাধারণ জনগণকে পোহাতে হয়।
চিরন্তন নিয়মে একসময় ঝরে পরবে সব পাতাই, কিন্তু কয়টা পাতাকে সবাই মনে রেখেছে বা রাখবে?
সবাইকে শরৎ এর শুভেচ্ছা।
এমআরএম/এএসএম