বাংলাদেশের তরুণ শক্তি: সম্ভাবনার আগুন ও পথের বাধা

প্রসঙ্গ ও প্রেক্ষাপট: বিশ্ব যখন জনশক্তির খোঁজে, বাংলাদেশ তখন সম্ভাবনার রত্নভাণ্ডার। বিশ্বের বহু দেশে আজ শ্রমের সংকটে থমকে আছে উৎপাদন—খালি পড়ে আছে হাসপাতালের বেড, নিস্তরঙ্গ প্রযুক্তিখাত, শ্রমবাজারে হাহাকার। অথচ সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ যেন স্বর্গের দান—৬০ শতাংশ জনসংখ্যাই কর্মক্ষম, প্রাণবন্ত, স্বপ্নবাহী।
এই তরুণদের চোখে শুধু চাকরি নয়, সম্ভাবনার শিল্প দেখা যায়—যেখানে রক্তের সঙ্গে মিশে থাকে কল্পনা, হাতে থাকে উদ্ভাবন, আর কণ্ঠে বাজে ‘আমি পারি’–এর গান।
তারা কেবল সনদ নয়, গড়তে চায় নিজের জ্ঞান ও দক্ষতার মিনার। আর এভাবেই—যদি সঠিক পথে চালিত করা যায়—তারা বিশ্বমঞ্চে হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের নতুন পরিচয়: ‘ইন্ডাস্ট্রি প্রভাইডার’।
বাধার পাঁচ বুলেট: তরুণ শক্তিকে কে আটকে রাখছে?
এই উদ্যমী শক্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটি বড় বাধা, যেগুলো দূর না করলে সম্ভাবনা থেকে আমরা যাব অপচয়ের দিকে:
১. শিক্ষার মানহীনতা ও বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্নতা
শিক্ষা এখনো মুখস্থবিদ্যার বন্দি। বাস্তব সমস্যার সমাধান, টিমওয়ার্ক, প্রযুক্তির ব্যবহার—এই দক্ষতাগুলোর ঘাটতি তরুণদের বাজারে অদক্ষ করে তুলছে।
২. দক্ষতা উন্নয়নে অবহেলা
স্কুল-কলেজে হাতে-কলমে শেখা নেই। ‘টেকনিক্যাল স্কিল’ যেন কারিগরি শিক্ষার ভেতর বন্দি কিছু। অথচ ভবিষ্যতের চাকরির বাজার চায় প্র্যাকটিক্যাল সক্ষমতা।
৩. দুর্নীতি ও পৃষ্ঠপোষকতা
যোগ্যতার বদলে পরিচিতির জয়। শিক্ষক নিয়োগ, ভর্তি, এমনকি ফলাফলেও থাকে চাপের রাজনীতি। এতে পরিশ্রমী তরুণদের মধ্যে জন্ম নেয় হতাশা।
৪. চাকরি-নির্ভর মানসিকতা
চাকরিকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ভাবা তরুণদের সংকীর্ণ করে তোলে। উদ্যোক্তা হওয়া যেন সাহসিকতার কাজ নয়, এক রকম বিলাসিতা!
৫. আত্মবিশ্বাস ও অনুপ্রেরণার সংকট
সামাজিক তুলনা, ব্যর্থতার ভয়, পারিবারিক চাপ—এই সবকিছু মিলে তরুণদের মনে গেঁথে দেয়, ‘তুই পারবি না’। তারা নিজেরাই ভুলে যায়, তারা পারত।
সমাধানের প্রথম ধাপ: ভিত্তি বদলাও, ভবিষ্যৎ গড়ো
সমস্যা চিনতে পারা এক জিনিস, কিন্তু তার সমাধানে সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়া তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে চাই:
১. গুণগত, নৈতিক ও দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা
শিক্ষাকে বানাতে হবে চিন্তার মুক্ত ক্ষেত্র:
• ভর্তি ও মূল্যায়নে স্বচ্ছতা,
• টেকনিক্যাল ও উচ্চশিক্ষায় আধুনিক ও বাস্তবমুখী পাঠ্যক্রম,
• শিক্ষক নির্বাচনে মেধা ও নৈতিকতা নির্ভর নিয়োগ ব্যবস্থা।
এসব উদ্যোগ তরুণদের আত্মবিশ্বাস জোগাবে, আর শিক্ষাকে রূপান্তর করবে সত্যিকার বিকাশের মাধ্যম হিসেবে।
এখনই সময়—স্বপ্নের কথা থেকে কাজে ফেরা
যতদিন পর্যন্ত দুর্নীতিকে পেছনে ঠেলে আমরা শিক্ষা, শ্রম ও সৎ নীতিকে সম্মান না করবো, ততদিন উন্নয়ন হবে কল্পনা, বাস্তব নয়।
‘দুর্নীতি নয়, পরিশ্রমই হোক সাফল্যের মূলমন্ত্র।’
‘নির্ভরতাভিত্তিক নয়, হোক আত্মনির্ভরশীলতার বাংলাদেশ।’
২. কারিগরি ও পেশাগত প্রশিক্ষণে জোর: শিক্ষা হোক কর্মমুখী
বাজারের চাহিদার সঙ্গে শিক্ষার সেতুবন্ধন অপরিহার্য।
– কোডিং, রোবোটিক্স, ব্লকচেইন, ডেটা অ্যানালাইসিস,
– ডিজিটাল মার্কেটিং থেকে ই-কমার্স পরিচালনা,
– উদ্যোক্তা হবার ‘বুটক্যাম্প’ ও লাইভ-প্রজেক্ট প্রশিক্ষণ—
এইসবকে প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে দিতে হবে যেন মফস্বল থেকে শহর—সব জায়গা থেকে তরুণরা উঠে আসতে পারে দক্ষতায় ভরপুর হয়ে।
৩. সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্ব: কর্মসংস্থানের যৌথ চাবিকাঠি
উন্নয়নের দায়িত্ব শুধু সরকারের নয় বরং বেসরকারি খাতকে উপযুক্ত সুযোগ দিয়ে একত্রে এগিয়ে যেতে হবে।
– শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশিপ,
– সরকারি ভর্তুকিসহ যৌথভাবে ‘এমপ্লয়মেন্ট ক্রিয়েশন ফান্ড’,
– শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কোম্পানির সংযোগে বাস্তব প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা—
এসব উদ্যোগই তরুণদের চাকরি খোঁজার পরিবর্তে ‘কাজের জগতে অবদান’ রাখার পথ খুলে দেবে।
৪. প্রবাসীদের সম্পৃক্ততা: দক্ষতা ফেরত আনা, সম্ভাবনা বাড়ানো
বিদেশে অবস্থানরত লাখো বাংলাদেশি তরুণের অভিজ্ঞতা দেশের সম্পদ হতে পারে।
– সরকারিভাবে ‘মাইগ্রেশন লোন’ চালু করে, বিদেশগামীদের দক্ষ প্রশিক্ষণ দিন,
– দেশে ফিরে আসা কর্মীদের জন্য রিইন্টিগ্রেশন প্রোগ্রাম চালু করুন,
– প্রবাসীদের সঞ্চয় ও রেমিট্যান্সকে ‘ডায়াসপোরা ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড’-এ রূপ দিন।
বাংলাদেশের শ্রমশক্তি যেন শুধু সংখ্যা নয়, এক একটি ‘পোর্টেবল প্রতিভা’—এই নীতি মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।
৫. উদ্যোক্তা সম্প্রদায় গড়ে তোলা: স্বাধীনতা হোক প্রেরণা
উদ্যোক্তা হওয়া মানে কেবল ব্যবসা শুরু করা নয় বরং নতুন সমস্যার সমাধান খোঁজা।
– সহজশর্তে ক্ষুদ্রঋণ, ব্যবসা পরিচালনায় প্রশিক্ষণ ও আইনি সহায়তা,
– অভিজ্ঞ উদ্যোক্তাদের মাধ্যমে মেন্টরশিপ ও রোল মডেল তৈরি,
– ‘স্টার্ট-আপ হাব’ গঠন করে এক ছাতার নিচে সুযোগ ও সাপোর্ট নিশ্চিত করা।
তরুণেরা যেন বুঝতে পারে—‘ব্যর্থতা নয়, চেষ্টা করার সাহসই একজন উদ্যোক্তার আসল সাফল্য।’
‘শ্রমকে সম্মান করা মানে শুধু চাকরিদাতাকে নয়, সেই শ্রমজীবী তরুণকেও মর্যাদা দেওয়া।’
তাই রাষ্ট্র যদি চায় সত্যিকার উন্নয়ন, তবে তাকে শ্রম, মেধা ও স্বপ্নের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সেই শুরু হোক—আজ থেকেই, এই লেখাটি থেকে, আপনার-আমার প্রতিজ্ঞা থেকে।
মননবিলাস ছেড়ে উন্মুক্ত মনের ডাক: মানসিক বিপ্লবের সময় এখন
দেশ গঠনের ক্ষেত্রে অবকাঠামো, অর্থনীতি বা প্রযুক্তি যতটা গুরুত্বপূর্ণ, ততটাই জরুরি মানুষের মনন ও মানসিক কাঠামোর রূপান্তর। একটি জাতি তখনই সত্যিকারের অগ্রগতির পথে এগোয়, যখন তার মানুষ আত্মবিশ্বাসে দৃঢ়, মূল্যবোধে সুসংহত এবং সম্ভাবনার প্রতি আশাবাদী থাকে। বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যেও সেই আলো আছে—প্রয়োজন শুধু দিকনির্দেশনার, প্রেরণার, এবং মুক্তচিন্তার একটি জোরালো সামাজিক পরিবেশের।
১. আত্মবিশ্বাসের বিকাশ: ‘আমি পারি’ মানসিকতা গড়ে তুলুন
তরুণদের প্রথম শত্রু বাইরের নয়, তাদের নিজের ভেতরের সন্দেহ।
– ছোট ছোট সাফল্যকে উদযাপন করুন,
– ব্যর্থতাকে শেখার ধাপ হিসেবে গ্রহণ করুন,
– প্রতিটি তরুণ-তরুণীর মধ্যে এই বিশ্বাস জাগান যে ‘আমি পারি, আমিই পারব—আমার শ্রম ও সততাই হবে আমার পরিচয়।’
এই আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠে যখন পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র তাদের আস্থা দেয়, সুযোগ দেয় এবং শ্রদ্ধা জানায়।
২. পরিবার ও সমাজ: সাফল্যের গল্পে অনুপ্রেরণার জোয়ার আনুন
তরুণরা আশপাশের মানুষদের দেখেই শেখে। যদি তারা দেখে প্রতিবেশী বেকার, আর আত্মীয় ঘুস দিয়ে চাকরি পেয়েছে, তাহলে হতাশা জন্ম নেবে।
– সফল উদ্যোক্তা, বিজ্ঞানী, ক্রীড়াবিদ কিংবা কৃষকের গল্প তুলে ধরুন,
– স্কুল-কলেজে ‘হিরো অফ আওয়ার হুড’ প্রোগ্রাম চালু করুন,
– সোশ্যাল মিডিয়ায় নেগেটিভিটি নয়, ‘ইন্সপিরেশনাল অ্যাকশন’ প্রচার করুন।
এই সমাজই পারে তরুণদের মননে বিজয়ের বীজ বপন করতে।
৩. রাজনীতির প্রভাব: যোগ্যতার ভিত্তিতে সুযোগ নিশ্চিত করুন
রাজনৈতিক পরিচয় যেন আর চাকরি বা ব্যবসার টিকিট না হয়।
– সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগে কঠোর স্বচ্ছতা আনুন,
– ‘মেধা বনাম পরিচয়’—এই দ্বন্দ্বে মেধাকেই জয়ী করুন,
– চাকরি, ঋণ, প্রশিক্ষণ—সবকিছুতে যোগ্যতা ও কর্মদক্ষতাই একমাত্র মানদণ্ড হোক।
রাজনীতি যদি পৃষ্ঠপোষকতা থেকে বের হয়ে ‘সেবার রাজনীতি’তে পরিণত হয়, তাহলেই সমাজে ন্যায্যতার আলো পৌঁছাবে।
৪. শিক্ষা = দক্ষতা + নৈতিকতা: সার্টিফিকেট নয়, প্রমাণই পরিচয়
বর্তমানে শিক্ষা একটি কাগজের সার্টিফিকেটে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। এই মনোভাব বদলাতে হবে।
– ‘শিখছি যেন কাজ করতে পারি’—এই লক্ষ্যে পাঠ্যক্রম তৈরি করতে হবে,
– নৈতিকতা, সহানুভূতি, সততা—এসব মানবিক মূল্যবোধকেও পাঠ্যপুস্তকে জায়গা দিতে হবে,
– ‘ডিগ্রি থাকলেই যোগ্য’ নয়, বরং ‘দক্ষতা ও চরিত্র থাকলেই মর্যাদা’—এই চেতনা প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
একটি দেশ তখনই মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়, যখন তার নাগরিকেরা কেবল জ্ঞানী নয়, নৈতিকভাবে শক্তিশালী।
তরুণদের মধ্যে যদি আত্মবিশ্বাস জাগে, সমাজ যদি তাদের সহযাত্রী হয়, আর রাষ্ট্র যদি যোগ্যতাকে মর্যাদা দেয়—তবে বাংলাদেশের অগ্রগতি আর কল্পনা নয়, বাস্তবতা হবে। এটাই সময়—মননবিলাস ছেড়ে, গড়ে তোলা এক মুক্ত, সৎ ও সাহসী প্রজন্ম।
করণীয়: সম্ভাবনাকে সাফল্যে রূপ দেওয়ার রূপরেখা
বাংলাদেশের তরুণ সমাজ শুধু একটি বয়সভিত্তিক গোষ্ঠী নয়—এটি একটি শক্তি, একটি সম্ভাবনাময় মহাস্রোত, যাকে সঠিক দিকনির্দেশনা ও সামাজিক স্বীকৃতি দিলে একটি জাতির ভাগ্য বদলে যেতে পারে। তাই করণীয়গুলো আর বিলম্ব করার জন্য নয়—এগুলি এখনই বাস্তবায়নের জন্য।
১. জাতীয় ‘জনশক্তি পুনর্জাগরণ’ আন্দোলন শুরু করুন
এই আন্দোলন হতে হবে রাজনৈতিক নয়, প্রজন্মগত—যেখানে তরুণ মানেই শুধু ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমানের চালিকাশক্তি।
– সরকারি ও বেসরকারি খাতে যুব নেতৃত্বে বিনিয়োগ করুন
– ‘যুব শক্তি = জাতীয় শক্তি’—এই স্লোগানকে কর্মসূচিতে রূপ দিন
– সব জেলা-উপজেলায় দক্ষতা উন্নয়ন কেন্দ্র ও উদ্দীপনামূলক ক্যাম্প চালু করুন
২. ‘শ্রমকে সম্মান’—এই সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করুন
দেশে আজও যারা শ্রমিক, তাদের আমরা ‘কম মর্যাদার মানুষ’ হিসেবে দেখি। এই মানসিকতা বদলাতে না পারলে কোনও সমাজ এগোতে পারে না।
– শিক্ষা ও মিডিয়ায় ম্যানুয়াল শ্রমের মর্যাদা তুলে ধরুন
– পেশাভিত্তিক শ্রেণির প্রতি সম্মান নিশ্চিত করুন
– ‘হাত মাটি ছুঁয়েছে’ মানেই সে ছোট নয় বরং সে তো ভিত্তি গড়ছে
৩. মিডিয়া ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইতিবাচক সমন্বয় নিশ্চিত করুন
শুধু নায়ক, গ্ল্যামার আর বিতর্ক নয়—মিডিয়ায় আসুক বাস্তব জীবনের নায়করা, যারা উদ্যম, দক্ষতা ও সততার প্রতীক।
– সফল উদ্যোক্তা, কৃষক, প্রকৌশলী, কারিগরদের নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচার চালান
– শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘লাইফ স্কিলস ক্লাব’, ‘ইন্ডাস্ট্রি ইনসাইটস’ কার্যক্রম চালু করুন
– পাঠ্যবইতে অন্তর্ভুক্ত করুন বাস্তব জীবনের সংগ্রাম ও সাফল্যের গল্প
৪. নীতিনির্ধারণে তরুণদের কণ্ঠ সশক্ত করুন
নীতি নির্ধারণের কক্ষগুলো যেন ‘বয়স্কদের মনোপলি’ না থাকে।
– যুব পরামর্শক পরিষদ গঠন করুন জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে
– প্রকৃত অভিজ্ঞতা ও চাহিদার ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে তরুণদের অন্তর্ভুক্ত করুন
– ‘তরুণ মানেই অপরিপক্ব’ এই ধারণা বদলাতে হবে এখনই
৫. মেধা ও শ্রমের সুবিচারমূলক মূল্যায়ন নিশ্চিত করুন
যেখানে দক্ষতা ও নিষ্ঠা থাকবে, সেখানেই মূল্যায়ন—এটাই হওয়া উচিত জাতীয় মানদণ্ড।
– চাকরি, স্কলারশিপ ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে কঠোর স্বচ্ছতা আনুন
– অ্যাকাডেমিক ও কর্মক্ষেত্রে পারফর্মেন্স নির্ভর পুরস্কার ব্যবস্থা চালু করুন
– ‘যোগ্যতা’ যেন পরিচয়ের চেয়ে বড় হয়—এই নীতিকে প্রতিষ্ঠা করুন
সমস্যা বড়, কিন্তু তার চেয়ে বড় আমাদের সম্ভাবনা। এই করণীয়গুলো যদি জাতীয় ইচ্ছাশক্তি ও সামাজিক সংহতির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়—তাহলে বাংলাদেশ শুধু জনবহুল দেশ নয়, হয়ে উঠবে দক্ষ, মর্যাদাশীল ও ভবিষ্যতবান এক কর্মক্ষম জাতির প্রতিচ্ছবি।
নিষিদ্ধ: যেগুলো ভবিষ্যতের পথে দেয়াল তোলে
আমাদের সামনে যে বিশাল সম্ভাবনার দরজা উন্মুক্ত, তা আমরা নিজেদের হাতে বন্ধ করে দিচ্ছি—যখন আমরা ভুলকে প্রশ্রয় দিই, যোগ্যতাকে অবমূল্যায়ন করি, অথবা সততাকে পদদলিত করে রাখি। উন্নয়ন শুধু জানলে হবে না কী করতে হবে বরং জানতে হবে কী ‘করবেন না’। এখনই সময়, এই পাঁচটি বিষাক্ত প্রবণতা চিরতরে বর্জন করার।
১. অযোগ্যদের পৃষ্ঠপোষকতা—যোগ্যতার পিঠে ছুরি
যখন যোগ্যতা পরিচয় বা ক্ষমতার দাপটে সিদ্ধান্ত হয়, তখন হাজার তরুণের স্বপ্ন চুরমার হয়ে পড়ে।
– বন্ধ করুন ‘আমার লোক’ নামের অদৃশ্য কোটা
– পৃষ্ঠপোষকতায় নয়, প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাক প্রজন্ম
২. শ্রমকে হীন চোখে দেখা—অভিমান জমা করে রাখা দেশের শক্তি
যে সমাজে একজন মিস্ত্রি, কৃষক বা কারিগরকে অবহেলা করা হয়, সে সমাজ কখনও আত্মনির্ভর হতে পারে না।
– পরিশ্রমের পেশাকে ছোট করে দেখা মানেই দেশকেই ছোট করা
– সবাই যদি বসে ‘অফিসের চেয়ার’ খোঁজে, তবে কে গড়বে শিল্পের ভিত্তি?
৩. শিক্ষাকে সার্টিফিকেট বানানো—অদক্ষ জনপদ গঠনের রেসিপি
ডিগ্রি মানে দক্ষতা নয়—এ কথা যতদিন না আমরা মেনে নিচ্ছি, ততদিন কাগজে ডিগ্রি থাকবে, হাতে থাকবে শূন্যতা।
– বাস্তবমুখী শিক্ষা ও হাতে-কলমে দক্ষতা অর্জন নিশ্চিত করুন
– সার্টিফিকেটের পেছনে নয়, প্রকৃত সক্ষমতার দিকে নজর দিন
৪. রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে চাকরি-বাণিজ্য—সুযোগ নয়, লুটপাট
চাকরি বা ব্যবসার সুযোগ যদি দলীয় আনুগত্য বা লবিংয়ে নির্ধারিত হয়, তবে সত্যিকার উদ্ভাবকরা কোণঠাসা হয়।
– বন্ধ করুন পদ-পদবির রাজনৈতিক বেচাকেনা
– প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক খাতে যোগ্যতাকেই একমাত্র মানদণ্ড করুন
৫. মতপ্রকাশ ও উদ্ভাবনী শক্তি দমন—একটি জাতির মেরুদণ্ড ভেঙে ফেলার মতো অপরাধ
যে তরুণ নতুন ভাবনা আনে, প্রশ্ন তোলে, বিকল্প চিন্তা করে—তাকে দমন মানে আগামীকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া।
– মুক্ত চিন্তা ও সৃজনশীলতার নিরাপদ পরিসর তৈরি করুন
– মতপ্রকাশ মানেই বিদ্রোহ নয়—এটা এক প্রকার ভালোবাসা, জাতিকে এগিয়ে নিতে চাওয়ার আকুতি
নিষিদ্ধ হওয়া উচিত সেইসব অভ্যাস, সিদ্ধান্ত ও দৃষ্টিভঙ্গি—যেগুলো সম্ভাবনার জন্ম নয়, মৃত্যুই ঘটায়। একটি দেশের সবচেয়ে বড় পুঁজি তার মানুষ, তার মেধা, তার শ্রম। তাই এখনই সময়, নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সেইসব নীতিহীন চর্চা, যেগুলো এই পুঁজিকে ধ্বংস করছে।
শেষ কথা: জনশক্তিই জাতির প্রকৃত শক্তি
যে দেশে মানুষের হাতে কাজ আছে, মনে আশা আছে এবং চোখে স্বপ্ন আছে—সে দেশ কখনোই পিছিয়ে থাকে না।
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার কোটি কোটি তরুণ—যারা শুধু সংখ্যায় নয়, সম্ভাবনায়ও অনন্য।
তবে এই সম্ভাবনাকে যদি আমরা শুধু পরিসংখ্যানে আটকে রাখি, তাদের মনকে যদি অনুপ্রেরণার বদলে অনিশ্চয়তায় ভরিয়ে তুলি, তাহলে এই রত্নগুলো অমার্জিতই থেকে যাবে। এখন প্রয়োজন মৌলিক এক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন—নিজেকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে নতুন করে চিনে নেওয়ার।
যদি আমরা—
• নিজেদের সম্মান করি,
• পরিশ্রমকে মর্যাদা দিই,
• তরুণদের মেধা ও মননকে সঠিক সুযোগ দিই,
তাহলেই বিশ্ব দেখবে—বাংলাদেশ শুধু একটি উন্নয়নশীল দেশ নয় বরং ভবিষ্যতের ‘ইন্ডাস্ট্রি প্রভাইডার’ রাষ্ট্র।
এই প্রজন্ম প্রস্তুত—তাদের শুধু দরকার:
• দুর্নীতিমুক্ত শিক্ষা,
• কারিগরি ও বাস্তবমুখী দক্ষতা,
• স্বচ্ছ, পক্ষপাতহীন নিয়োগ ও মূল্যায়ন পদ্ধতি।
আজ সময় এসেছে একসাথে এগিয়ে যাওয়ার।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকার, শিল্পপতি, মিডিয়া—সবার সম্মিলিত প্রয়াসেই গড়ে উঠবে এক নতুন বাংলাদেশ,
যেখানে মেধা হারায় না, শ্রম অবহেলিত হয় না, আর তরুণেরা শুধু স্বপ্ন দেখেই নয়, সেই স্বপ্নের বাস্তব রূপকারও হয়ে ওঠে।
জনশক্তিকে ক্ষমতায়িত করলেই বিকশিত হয় সম্ভাবনা, আর সেই সম্ভাবনাই দাঁড় করায় এক জাতিকে প্রকৃত অর্থে অজেয় শক্তিতে।
— রহমান মৃধা
গবেষক ও লেখক
সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
Rahman.Mridha@gmail.com
এমআরএম/এএসএম