বলকান অঞ্চলগুলো সত্যিই আজব

স্লোভেনিয়ার রাজধানী লুবলিয়ানা থেকে ভিয়েনার দূরত্ব চারশত কিলোমিটার। বাসে লুবলিয়ানা থেকে ভিয়েনা পৌঁছাতে পাঁচ ঘণ্টার মতো লাগে। অন্যান্য সময় লুবলিয়ানা থেকে ভিয়েনায় পৌঁছানোর জন্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর বাস কিংবা ট্রেন পরিষেবা চালু থাকলেও করোনার কারণে এখন সেটা অনেকটা সঙ্কুচিত করে আনা হয়েছে।
এখন দিনে একটি বাস কিংবা একটি ট্রেন ছেড়ে যায় ভিয়েনার উদ্দেশ্যে লুবলিয়ানা থেকে। ট্রেনে যাতায়াতের ক্ষেত্রে অনেক সময় নির্দিষ্ট স্টপেজ অন্তর অন্তর নেমে ট্রেন পরিবর্তন করতে হয় যেটি বিরক্তিকর। স্লোভেনিয়াতে সাধারণ মানুষ কার-রাইড শেয়ারিং সার্ভিসগুলোর ওপর বেশি নির্ভর করে বিশেষত দূরবর্তী কোনো গন্তব্যে যাতায়াতের ক্ষেত্রে। এখানকার গণপরিবহন সেবার মান সে অর্থে আশানুরূপ নয়।
২৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার দিকে রওয়ানা হলাম লুবলিয়ানা থেকে ভিয়েনার উদ্দেশ্যে। এ যাত্রায় ভিয়েনা পৌঁছানোর জন্য স্থানীয় একটি কার রাইড শেয়ারিং কোম্পানির ওপর নির্ভর করতে হয়েছিল। যাতায়াত ভাড়া পড়েছিল ৩০ ইউরোর মতো।
যে মাইক্রোবাসে করে আমরা ভিয়েনার অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেটি ছিল আটজনের বসার মতো কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে এক সাথে চারজনের অধিক যাত্রীকে যাতায়াতের অনুমতি দেওয়া হয়নি। পাশপাশি বসা দুইজন যাত্রীর মাঝে যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল এবং পুরো যাত্রাপথে সবাইকে মাস্ক পরিধান করতে হয়েছিল।
স্লোভেনিয়ার সঙ্গে অস্ট্রিয়ার সীমান্তের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৩০ কিলোমিটারের মতো, এ ৩৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সীমান্ত এলাকায় হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি পয়েন্ট হচ্ছে যে কোনো দেশের নাগরিকের জন্য উন্মুক্ত। বাকি পয়েন্টগুলো কেবলমাত্র স্লোভেনিয়া এবং অস্ট্রিয়ার নাগরিকেরা ব্যবহার করতে পারে। স্লোভেনিয়া থেকে অস্ট্রিয়াতে প্রবেশের সাথে সাথে বর্ডার চেকপোস্টে আমাদের গাড়ি থামাতে বলা হয়।
ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নতুন করে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ায় সীমান্তবর্তী চেক পয়েন্টগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিলও অত্যন্ত সুদৃঢ়। অস্ট্রিয়ার সীমানায় পা রাখার সাথে সাথে ইমিগ্রেশন পুলিশ আমাদের গাড়ি থামিয়ে সবাইকে জিজ্ঞেস করে আলাদাভাবে কেনও এ রকম একটি মুহূর্তে আমরা অস্ট্রিয়া যেতে চাচ্ছি।
এরপর আমাদের সবার পাসপোর্টসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট চেক করে এবং আমরা যারা অস্ট্রিয়াতে প্রবেশ করেছি আমাদের সকলের নাম ও আইডি নম্বর তাদের ডাটাবেইজে লিপিবদ্ধ করে। স্লোভেনিয়া, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া এ সকল দেশে করোনার সেকেন্ড ওয়েভ শুরু হয় বলকান রাষ্ট্র বিশেষ করে সার্বিয়া, বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা, মেসিডোনিয়া, ক্রোয়েশিয়ার অভিবাসীদের মাধ্যমে।
আমাদের গাড়িতে দুইজন যাত্রী ছিলেন বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনার অধিবাসী। অস্ট্রিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদেরকে কোনোভাবে অস্ট্রিয়ায়ে প্রবেশ করতে দিতে চাচ্ছিলেন না। বিশেষ করে তাদের কাছে করোনার নেগেটিভ সনদ না থাকায় সমগ্র পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করেছিল। পরে অবশ্য দশদিনের কোয়ারেন্টাইনের শর্ত দিয়ে তাদেরকে অস্ট্রিয়াতে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়।
ভিয়েনা পৌঁছাতে আমাদের প্রায় রাত বারোটা বাজে। বুধবারের সে রাতটা আমার এক বড় ভাই পারভেজ মাহফুজের বাসায় কাঁটানোর সিদ্ধান্ত নেই। বৃহস্পতিবার (২৫ শে সেপ্টেম্বর) থেসালুনিকির উদ্দেশে আমার ফ্লাইট।
স্লোভেনিয়ায় বাংলাদেশের কোনও দূতাবাস নেই। যে কোনও রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের সাথে আমাদেরকে যোগাযোগ করতে হয়। এ কারণে স্লোভেনিয়াতে পা রাখার পর বেশ কয়েকবার আমার ভিয়েনাতে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে এবং এভাবে ভিয়েনাতে যাতায়াতের সুবাদে সেখানে বসবাসরত অনেক বাংলাদেশির সাথে আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছে।
এমন একজন হচ্ছে মাহবুবুর রহমান। তিনি অস্ট্রিয়াতে পাড়ি জমানো প্রথম দিককার বাংলাদেশিদের মাঝে একজন। তার আরও একটি পরিচয় আছে, তিনি হচ্ছেন আমাদের দেশের সূর্য-সন্তানদের একজন অর্থাৎ তিনি আমাদের দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেওয়া এক মুক্তিযোদ্ধা।
পরের দিন তিনি আমাকে তার সঙ্গে সকালের জলখাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানান। মাহবুব ভাই সত্যিকার অর্থে অমায়িক একজন ব্যক্তিত্ব। আমাকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করেন। তাই তার আমন্ত্রণ পাওয়ার পর আমি সেটা গ্রহণ না করে পারলাম না।
আমাকে তিনি তার গাড়িতে করে পরের দিন সকালে ওয়েস্টব্যানহফে নিয়ে গেলেন। ওয়েস্টব্যানহফ হচ্ছে ভিয়েনার পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলগুলোর প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। সকালের জলখাবার আমরা একসাথে সেরে নিলাম। এরপর তিনি আমাকে ওয়েস্টব্যানহফ থেকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিলেন।
বেলা সাড়ে বারোটায় আমার ফ্লাইট। দুই ঘণ্টা হাতে রেখেই এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। গ্রিসে ভ্রমণের জন্য সবাইকে travel.gov.gr ওয়েবসাইটে গিয়ে একটা পিএলফএফ ফরম পূরণ করতে হয়। সেখানে সবাইকে নাম, আইডি নম্বর, যোগাযোগের ঠিকানা, ফ্লাইট নাম্বার, গ্রিসে অবস্থানকালীন ঠিকানা ও সেদেশে বসবাসরত কোনও একজন ব্যক্তি কিংবা কোনও প্রতিষ্ঠানের রেফারেন্সসহ বেশ কিছু তথ্য জিজ্ঞেস করা হয়।
সঠিকভাবে পিএলএফ ফরমটি পূরণ করা হয়ে গেলে তারা আপনাকে ই-মেইল পাঠাবে। এরপর যেদিনকে ফ্লাইট সেদিন দিবাগত রাত বারোটায় গ্রিসের ইমিগ্রেশনের পক্ষ থেকে একই কিউআর কোড পাঠানো হবে আপনার ই-মেইলে।
এ কিউআর কোড ছাড়া কাউকে গ্রিসে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয় না। এছাড়াও গ্রিসের সরকারি তালিকায় করোনা মহামারি পরিস্থিতিতে রেড জোন হিসেবে যে সকল দেশকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে সে সকল দেশের থেকে কেউ গ্রিসে আসতে চাইলে সবাইকে বাধ্যতামূলকভাবে কোভিড-১৯ এর নেগেটিভ সনদ বহন করতে হবে।
সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অবশেষে ফ্লাইটে উঠলাম। ভিয়েনার পাবলিক ট্রান্সপোর্ট থেকে শুরু করে এয়ারপোর্টের ভেতর সর্বত্র মাস্ক পরিধান করা ছিল বাধ্যতামূলক। এমনকি ফ্লাইটেও সর্বক্ষণ আমাদেরকে মাস্ক পরিধান করা বাধ্যতামূলক ছিল। করোনা পরিস্থিতিতে ভিয়েনা কিংবা লুবলিয়ানাতে মানুষের তেমন পদচারণা চোখে না পড়লেও এয়ারপোর্টের ভেতরের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
অস্ট্রিয়া যেহেতু স্থলবেষ্টিত একটি দেশ তাই অস্ট্রিয়ার অনেক অধিবাসী গ্রীষ্মকালসহ বছরের এ সময়টাকে উপভোগ করার জন্য আশপাশের কিছু দেশ বিশেষ করে ইতালি, ক্রোয়েশিয়া এবং গ্রিসের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলগুলোর প্রতি বিশেষভাবে সংবেদনশীল।
করোনা পরিস্থিতিতে যেখানে ভেবেছিলাম হয়তো বা ফ্লাইটে খুব বেশি মানুষের দেখা মিলবে না, ফ্লাইটে উঠার পর দেখা গেলো পুরো অ্যারোপ্লেন কানায় কানায় পূর্ণ। ফ্লাইটের সিংহভাগ যাত্রী অস্ট্রিয়ার। অল্প কিছু সংখ্যক যাত্রী ছিলো গ্রিস, স্লোভেনিয়া, বুলগেরিয়াসহ অন্যান্য দেশের নাগরিক।
প্রায় দেড় ঘণ্টার যাত্রা শেষে থেসালুনিকির নর্থ ম্যাকাডোনিয়া এয়ারপোর্টে আমাদের ফ্লাইটটি অবতারণা করল। বিমান থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হলো করোনার পিসিআর টেস্টের জন্য। গ্রিসের সরকারের এ উদ্যোগটি আমার কাছে ভালো লেগেছে। বাহিরের দেশ থেকে কেউ গ্রিসে প্রবেশ করলে সে দেশের সরকারি খরচে তার জন্য করোনার পিসিআর টেস্টের ব্যবস্থা করা হয়।
ফ্লাইট থেকে নামার পর এয়ারপোর্টে প্রবেশের সাথে সাথে সেখানকার ইমিগ্রেশন ডেস্কে আমাদের সাথে গ্রিসে পা রাখা সকল যাত্রীর মুখের থেকে লালা নিয়ে করোনার টেস্ট করা হয়েছিল। পাশাপাশি আমাদের সবাইকে একদিনের জন্য আইসোলেশনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। ভিয়েনার মতো গ্রিসেও এয়ারপোর্ট থেকে শুরু করে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট অর্থাৎ যেখানে এক সাথে অধিক মানুষ একত্রিত হন এমন জায়গাগুলোতে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। তবে থেসালুনিকির এয়ারপোর্টে সেভাবে মানুষের পদচারণা ছিল না বললেই চলে।
এয়ারপোর্টে সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বাহিরে বের হতে হতে বিকেল চারটা বেজে গেল। গ্রিসের সাথে স্লোভেনিয়ার সময়ের পার্থক্য এক ঘণ্টা। গ্রিস যে সময়ের দিক থেকে স্লোভেনিয়াসহ মধ্য ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় এক ঘণ্টা এগিয়ে সেটা ভুলেই গিয়েছিলাম।
এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি থেসালুনিকির সিটি সেন্টারে পৌঁছানোর জন্য বাস সার্ভিস রয়েছে। বাস নম্বর হচ্ছে X1; এয়ারপোর্ট থেকে থেসালুনিকির সিটি সেন্টারে যেতে ১.৮০ ইউরোর মতো ভাড়া লাগে।
আপনাদের চোখে যদি ইউরোপের সংজ্ঞা হয় গ্রেট ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, অস্ট্রিয়া, সুইডেন, ডেনমার্ক কিংবা নরওয়ে তাহলে গ্রিসে আসলে আপনাকে হতাশ হতে হবে। অবকাঠামোগত দিক থেকে গ্রিসের সঙ্গে বলকান অন্যান্য দেশের পার্থক্য খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
গ্রিসের রাস্তাঘাট, দালানকোঠা কিংবা গণপরিবহনের দিকে তাকালে কোনোভাবে মনে হবে না যে এটি ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত কোনো রাষ্ট্র। জার্মানি, ডেনমার্ক, সুইডেন, নেদারল্যান্ডস, অস্ট্রিয়া এ সকল দেশের রাস্তাঘাঁট যেমনিভাবে প্রশস্ত তেমনিভাবে পরিকল্পিত ও পরিচ্ছন্ন।
এ সকল দেশের অধিবাসীরাও আইনের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল। বলকান রাষ্ট্রগুলোর অবস্থা একেবারে বিপরীত। এ সকল দেশের রাস্তাঘাঁটের চেহারা অনেকটা রুগ্ন প্রকৃতির, পরিচ্ছন্নতার বালাই সেখানে খুব একটা চোখে পড়বে না। মানুষও আইন মেনে চলার ব্যাপারে তেমন একটা সচেতন নয়।
গ্রিসের ক্ষেত্রেও দেখলাম বিষয়গুলো একই। গ্রিসে আরও একটি বিষয় আমার নজরে এসেছে যেটা আমার কাছে খুবই বিরক্তিকর লেগেছে। সেখানকার অধিবাসীরা ট্রাফিক আইন সেভাবে মেনে চলে না। গ্রিসে মাথাপিছু হিসেব করলে প্রায় সকলের নিজস্ব গাড়ি আছে এবং গ্রিসের বেশিরভাগ শহরগুলোতে গাড়ি পার্ক করতে চাইলে কোনও ধরনের পার্কিং ফি এর প্রয়োজন হয় না।
মানুষজন তাই যেখানে সেখানে গাড়ি পার্ক করে রাখে। অনেক সময় এ কারণে ঢাকা শহরের মতো এথেন্স কিংবা থেসালুনিকির মতো বড় শহরের বিভিন্ন এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়। থেসালুনিকিতে দেখলাম যে যার মতো পারছে গাড়ি ড্রাইভ করছে, ট্রাফিক সিগন্যালের দিকে কারও তেমন ভ্রূক্ষেপ নেই।
রাস্তা পারাপারের সময়ও দেখলাম পথচারীরাও ট্রাফিক সিগন্যাল কিংবা জেব্রা ক্রসিং কোনও কিছুর ধার ধারছে না। অনেকে দেখলাম আবার ফুটপাতের ওপর দিয়ে পারলে মোটরসাইকেল উঠিয়ে দেয়। গ্রিস কিংবা বলকান দেশগুলো সত্যি আজব! ইউরোপ মহাদেশের অন্তর্গত হওয়া স্বত্ত্বেও বলকান রাষ্ট্রগুলো কেনও জানি ইউরোপ নয়।
আবার গ্রিসে গণপরিবহনগুলোতে যাতায়াতের ক্ষেত্রে মাস্ক পরিধান করা সকলের জন্য বাধ্যতামূলক হলেও অনেকে দেখলাম সে বিষয়ে খুব বেশি একটা কর্ণপাত করছেন না। নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানি, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, ফ্রান্সসহ ইউরোপের প্রায় সকল দেশের মানুষের চেহারার গঠনে এক ধরনের সামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা যায়।
গ্রিসে তেমনটা লক্ষ্য করা যায় না। কেউ দেখতে তুর্কিদের মতো, কারও চেহারা আবার আরবদের মতো, কেউ আবার স্লাভিকদের মতো ফর্সা ও সোনালি চুলের অধিকারী, কেউবা দেখতে আবার ইতালিয়ান কিংবা স্প্যানিশদের মতো।
তবে একটা কারণে গ্রিস ইউরোপের অন্য সকল দেশের থেকে আলাদা। আমাদের দেশের শহরগুলোতে রাস্তার দুই ধারে যেমন ঘন ঘন দোকানের দেখা মেলে, গ্রিসেও দেখলাম অনেকটা তেমন। বিশেষ করে এথেন্স আর থেসালুনিকি এ দুইটি শহরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অবস্থায় প্রচুর খাবারের দোকানের দেখা মিলে।
গ্রিসের রন্ধনশৈলীর কদর বিশ্বব্যাপী। ইয়োগার্ট থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের চীজ বা পনির, অলিভ ওয়েল, সালাদ, বিভিন্ন ধরণের সসেজ এবং বাকলাভাসহ বিভিন্ন ধরনের মিষ্টিজাতীয় খাবারের জন্য গ্রিস বিখ্যাত। গ্রিসের জনপ্রিয় দুইটি খাবারের আইটেমের মধ্যে রয়েছে গিরোস এবং সুভ্লাকি।
গাইরোর সঙ্গে আমাদের দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ফাস্টফুড আইটেম শর্মার কিছুটা মিল পাওয়া যায়। অনেকটা শর্মার আদলে গাইরোতে ব্যবহৃত মাংসের প্রক্রিয়াজাত করা হয়। তবে আমাদের পরিচিত রুটির পরিবর্তে পিটা নাম এক বিশেষ ধরনের রুটি এবং ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও বিভিন্ন ধরনের সালাদ এবং এক ধরনের বিশেষ সস সহযোগে তৈরি হয় গাইরো।
প্রত্যেক কামড়ে হারিয়ে যেতে চাইবেন। কোনও কারণে গ্রিসে বেড়াতে গেলে অবশ্যই গাইরো এবং সুভ্লাকির স্বাদ নেওয়ার চেষ্টা করবেন। এছাড়াও সামুদ্রিক মাছ দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবারের জন্যও গ্রিসের খ্যাতি পুরো দুনিয়া জুড়ে। এছাড়াও গ্রিসের আবহাওয়া অনেকটা উপভোগ করার মতো। ভূ-মধ্যসাগরের তীরবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ায় গ্রীষ্মকাল কিংবা শীতকালের কোনোটি সেখানে খুব বেশি একটা চরমভাবাপন্ন নয়।
গ্রীষ্মকালে তেমন একটা বৃষ্টিপাত না হলেও শীতকালে হরহামেশাই বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। গ্রিসের সঙ্গে প্রতিবেশী রাষ্ট্র তুরস্কের বৈরিতার অন্যতম কারণ হচ্ছে এ দুই দেশের খাবার। দীর্ঘদিন তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্যের অধীনে থাকার কারণে গ্রিস এবং তুরস্ক এ দুই দেশের সাধারণ মানুষের খাদ্যাভাস থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সামঞ্জস্য খুঁজে পাওয়া যায়। আবার বর্তমান তুরস্কের অনেক অংশ ছিলও প্রাচীন গ্রিক সাম্রাজ্যের অধীনে।
বুকিং ডট কম ব্যবহার করে থেসালুনিকিতে এক রাত থাকার জন্য হোটেল বুক দিয়ে রেখেছিলাম আগেভাগেই। এক রাতের জন্য ভাড়া পড়েছিল ৫৯ ইউরোর মতো। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কারণে বিশেষত গুগল ম্যাপের কল্যাণে হোটেলের অবস্থান খুঁজে পেতে খুব সমস্যা হয়নি। থেসালুনিকির সেন্টারের কাছে হওয়ায় প্রয়োজনীয় সবকিছু ছিল হাতের নাগালে।
চেক-ইন করার পরপর আমার পিঠের ব্যাগটা রেখে একটু ফ্রেশ হয়েই হোটেলের পাশের এক রেস্টুরেন্ট থেকে সুভ্লাকি দিয়ে দুপুরের খাবার সেরে নিলাম। দাম মাত্র ৩.৮০ ইউরো। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় গ্রিসে খাবারের খরচ তুলনামূলক কম। যেহেতু গ্রিসে পা রাখার সাথে সাথে আমাদের সকলকে একদিনের কোয়ারেন্টাইনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল তাই সেদিনকে আর কোথাও বের হলাম না।
পরের দিন তাই সময় নষ্ট না করে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করলাম। এরপর গোসল সেরে হোটেলের রুমে বসে সময় অতিবাহিত করতে থাকলাম। করোনার কারণে এ বছর গ্রিসে বাহিরের দেশগুলো থেকে খুব একটা পর্যটক আসতে পারেনি, ফলে হোটেলগুলোতে বলতে গেলে পর্যটকের উপস্থিতি তেমনটা চোখে পড়েনি।
হোটেলের পক্ষ থেকে সকালের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। চটজলদি সকালের খাবার শেষ করে একেবারে চেক আউট করে হোটেলের রিসিপশন থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম পুরো শহরটা দেখার জন্য।
এ পর্যায়ে এসে খানিকটা বিরক্তি লাগছিল। একা একা ঘোরার জন্য মন সাঁয় দিচ্ছিল না। অল্প একটু হাঁটার পর হঠাৎ করে যেন পরিচিত একটা আওয়াজ ভেসে আসল। মনে হচ্ছিলো কেউ যেনও নিজের চিরচেনা ভাষায় কথা বলছে। এ সময় মনে খানিকটা আশার সঞ্চার হলো। অবশেষে সাহস করে এগিয়ে পড়লাম এ আওয়াজের সন্ধানে।
নিজ দেশের এক ভাইকে শেষ পর্যন্ত পেয়েও গেলাম। তার নাম মনিউর রহমান সুমন। তিনি সিলেটের অধিবাসী তবে প্রায় তেরো বছর ধরে তিনি থেসালুনিকিতে বসবাস করছেন। তিনি আমাকে সময় দিলেন এবং তার সাথে মূলত আমি থেসালুনিকি ঘুরে দেখলাম। এ মানুষটির আন্তরিকতা আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছে।
এমআরএম/পিআর