প্রোপাগান্ডা-গুজব ও কিছু কথা

‘সুইডেনে বজ্রপাত শুরু।’ ‘শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি।’ ‘বজ্রপাতে দুজনের মৃত্যু, আহত ৮।’ এগুলোকে বলা হয় গুজব। কারণ সুইডেনে এখন সকাল ১০টা বাজে, আবহাওয়া চমৎকার, সূর্য দেখা যাচ্ছে। এখানে শীতকালে প্রচণ্ড শিলাবৃষ্টি কখনও হয় না। এখন যা জানালাম তা সত্য ঘটনা।
এখন ঘটনা হতে পারে সত্য বা মিথ্যা, যার ফলে দরকার তার যাচাই-বাছাই করা। আজ গুজব ও প্রোপাগান্ডা সম্বন্ধে কিছু কথা তুলে ধরতে চাই যেন প্রোপাগান্ডা ও গুজবের কারণে আমরা আমাদের সত্য-মিথ্যার ভারসাম্য একেবারে হারিয়ে না ফেলি।
প্রোপাগান্ডা ছড়ানো, গুজব রটানো, কথা চালানো, কথা লাগানো, কথাকে পরিবর্তন করা বা গুজবের ওপর ভিত্তি করে শেয়ার বাজারের বেচাকেনা করা কিংবা যুদ্ধ পরিচালনা করা হচ্ছে মানবজাতির এক চির প্রচলিত স্বভাব, যা হয়ে আসছে পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির শুরু থেকে। তিলকে তাল করা বা কিছু রটেছে তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আরেক রকম করে বর্ণনা করা হচ্ছে মানুষ জাতির একটি খাসলত।
প্রযুক্তির কারণে প্রোপাগান্ডা, গুজবের ধরণ ও তা দ্রুতগতিতে ছড়ানো যেমন বেড়েছে বেশি, তেমন এর পরিমাণও বেড়েছে প্রচুর। যা কিছুই ঘটছে সঙ্গে সঙ্গে তা রটছে, সত্য-মিথ্যার যাচাই-বাছাই ছাড়া।
প্রচার-প্রচারণার মিডিয়াগত পরিভাষা হচ্ছে প্রোপাগান্ডা। প্রোপাগান্ডা মূলত মনস্তাত্বিক যুদ্ধের একটি অস্ত্র। শত্রুর উদ্দেশ্য থাকে প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে ভীতি ও আতঙ্কের অবস্থা সৃষ্টি করে ব্যক্তি অথবা দলের আচরণে চাহিদামাফিক পরিবর্তন সাধন করা, যাকে বলা যেতে পারে সাইকোলোজিক্যাল ওয়ার। প্রোপাগান্ডার উদ্দেশ্যই থাকে অপরপক্ষকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে দিয়ে তার সাহস ভেঙে দেওয়া।
প্রোপাগান্ডার মধ্য দিয়ে আদর্শিক, অর্থনৈতিক স্বার্থ-সুবিধা আদায় করে নেওয়া হয়। হীনম্মন্যতা সৃষ্টির নানা কার্যকলাপকে সক্রিয় করে তোলা হয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ। কিন্তু আগুন ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ছাড়া যুদ্ধটি লড়ার কারণে একে বলা হয় ‘‘Cold War’’ বা ঠান্ডা লড়াই।
এবারের ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধে যে প্রোপাগান্ডার ঢেউ বয়ে চলেছে তার প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যাবে পুরোনো ইতিহাস ঘাটলে। যেমন কা’ব ইবনে আশরাফের প্রোপাগান্ডার সবচেয়ে মারাত্মক বিষয়টি ছিল এই যে, বদর যুদ্ধের আগুন তখনও ঠান্ডা হতে পারেনি তার আগেই সে নতুন আগুন জ্বালানোর প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র শুরু করে দেয়।
মক্কায় গিয়ে কুরাইশদের উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করে। গাযওয়া বনি মুস্তালিকের সময় উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা (রা.) ও হযরত সাফওয়ান (রা.)-কে জড়িয়ে ভয়ংকর মিথ্যা চারিত্রিক বিষাদগারের ধুঁয়া তুলে তারা মদিনার পরিবেশ ভারি করে তুলেছিল। মুনাফেকদের ছড়িয়ে দেওয়া এই তোহমতে কোনো কোনো মুখলেস সাহাবী পর্যন্ত কিছুটা প্রভাবিত ও দ্বিধান্বিত হয়ে পড়েছিলেন।
মাসজুড়ে চলেছিল এ কঠিন পরিস্থিতি। শেষ পর্যন্ত আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ওহী নাযিল হয় ও এ প্রচারণার অসারতা ফুটে উঠে ও হযরত আয়েশার পবিত্রতার কথা ঘোষিত হয়। সূরা আন-নূরের আয়াতসমূহে এ ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। জানতে হলে পড়তে হবে।
প্রোপাগান্ডা যেহেতু যুদ্ধ ও শান্তি উভয় সময়েই সমানভাবে সক্রিয় থাকে; তবে যুদ্ধের সময় প্রোপাগান্ডার মাত্রা থাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে তাই সে সময় প্রচারমাধ্যমের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। প্রোপাগান্ডার ফলে যেন স্বজন-স্বজাতির মাঝে ভীতি ও দ্বিধা না বেড়ে যায় ও শত্রুপক্ষ নিজেদের লক্ষ্যে সফল না হয়ে যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। একই সাথে গুজব সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে।
সব গুজবই যে মানব কল্যাণে ক্ষতিকর তা নয়, তবে বেশিরভাগ গুজবই নেগেটিভভাবে প্রভাব বিস্তার করছে বর্তমান যুগে। ইউরোপ বা বিশ্বের অন্যান্য দেশে গুজব কেমন ধরনের ও কী কী প্রতিক্রিয়া লক্ষণীয়? এখানে লোকের মাধ্যমে, লেখার মাধ্যমে ও খবরের মাধ্যমে নানা বিষয়ের ওপর গুজব ছড়ায়।
সুইডেনে আমার কর্মস্থলে এক সহকর্মী ছিল। বয়স হবে ২২-২৩ বছর। সে বেশ গুজব রটাতে ও মেয়ে বসে আনতে ছিল পাকা। আমরা সবাই তার সমবয়সী বিধায় স্বাভাবিকভাবে তার সেই কায়দা-কানুন দেখে বেশ আপ্লুত হতাম। সে যাই বলতো আমরা তাই বিশ্বাস করতাম। যেমন নতুন কোনো মেয়ের সঙ্গে পরিচয় এবং কিভাবে পরিচয় হলো সবই সে সুন্দর করে আমাদের বলতো।
দেখা গেলো সে আমাকে একভাবে বর্ণনা করেছে, পরে একই ঘটনা এক এক করে সবাইকে বলেছে তবে ভিন্নভাবে! তার একটাই অনুরোধ ছিল তা হলো সে যা আমাকে বলেছে অন্য কেউ যেন তা না জানে। তার ভাবভঙ্গি এমন যে সে শুধু আমাকেই তার সবকিছু শেয়ার করেছে। কোনো এক সময় ঘটনা ছড়িয়ে পড়ে। জানা যায় যে সে সবাইকে একই ঘটনা বলেছে তবে কিছুটা পরিবর্তন করে। যার কারণে পরবর্তীতে আমরা কেউ তাকে আর বিশ্বাস করতে পারিনি।
অনেকে লেখার মাধ্যমে গুজব ছড়ায়। যেমন শেয়ার মার্কেটের খবরে অনেক সময় ভুল তথ্য দেওয়া হয়ে থাকে। যার কারণে শেয়ার বাজারের বেচা-কেনাকে গ্যাম্বলিং বলা হয়ে থাকে। আবার কেউ কোনো নতুন প্রোডাক্ট বাজারে এনেছে দেখা গেলো সত্যি মিথ্যা প্রচার করে প্রোডাক্টের দাম উঠা-নামা করাতে সাহায্য করে।
কিছু কিছু খবর যেমন আকস্মিকভাবে প্রচার করা হয় যেমন কোথাও দুর্ঘটনা ঘটেছে, বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সূক্ষ্ম তদন্ত ছাড়াই বড় করে গুজব রটিয়ে দেওয়া হয়। গুজবের ধরণ ইউরোপ বা বিশ্বের অন্যান্য দেশে বলতে গেলে একই রকমের। গুজব অতীতে ছিল বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতে থাকবে।
অনেকেই কথাটির সঙ্গে পরিচিত ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী’ (A little knowledge is a dangerous thing) কথাটির একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য রয়েছে। বর্তমানে যোগাযোগের মাধ্যম বেড়েছে। লোক মুখে, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে যার যা খুশি লেখার সুযোগ পাচ্ছে। আমরা দেদারছে যার যা খুশি লিখছি। এখন প্রশ্ন, মুখে কিছু বলা ও সে কথার পরিবর্তন গুজবের মাধ্যমে নানাভাবে ছড়াতে পারে।
যখনই কিছু লেখা হয় তখন সেটা ডকুমেন্ট হয়ে যায়। লিখিত ডকুমেন্ট দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। এখন লিখিত তথ্য যদি সঠিক না হয় এবং তথ্যের সত্যতা না থাকে, এক্ষেত্রে বলা যেতে পারে ‘অল্পবিদ্যা ভয়ংকরী’। আমাদের মুখের কথা যখন লেখার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, যদি পরে দেখা যায় যে লেখার সত্যতা দুর্বল, তখন ব্যক্তির কথার দুর্বলতা, ব্যক্তির চরিত্রের দুর্বলতার ওপর প্রশ্ন আসে।
এক্ষেত্রে গুজব সমাজ বা দেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। আমরা কোনো কিছু লেখা বা বলার আগে যদি ১০০ শতভাগ নিশ্চিত না হই, সেক্ষেত্রে লেখা বা বলার শুরুটা হওয়া উচিত যেমন আমি যতটুকু জেনেছি বা শুনেছি ইত্যাদি। কিন্তু যদি বলি আমি যা দেখেছি এক্ষেত্রে দেখার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে ঘটনার বর্ণনা দেওয়া মানে সত্যকে তুলে ধরা। নিজের চোখে দেখা ঘটনা বিশ্বাস করা যত সহজ তত সহজ নয় যদি বলা হয় আমি যতটুকু শুনেছি বা জেনেছি।
সুইডিশরা এদের কথাবার্তায় পুরোপুরি শিওর না হয়ে সাধারণত কিছু বলতে চায় না। কিন্তু বাংলাদেশে গুজব ছড়াতে আমরা বেশ পণ্ডিত। আমি মনে করি আমাদের আচরণ এমন হওয়া উচিত যেন কিছু লেখার আগে স্টেটমেন্ট দেই যেমন আমার মতে, আমার বিশ্বাস, আমার ধারণা, আমি শুনেছি, আমি দেখেছি, আমি পড়েছি বা আমার ব্যক্তিগত অভিমত ইত্যাদি। তাহলে গুজবের ধরণ বর্তমানের চেয়ে আলাদা হবে। যা হয়তো সমাজে ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে না, যা করছে বর্তমানে।
মনে রাখা দরকার ময়লা নাড়ালে গন্ধ ছড়ায় বেশি তাই গুজব সমাজের জন্য কখনও ভালো কিছু দিতে পারেনি, পারবেও না। বহু পুরোনো দিনের একটি কবিতার কথা মনে পড়ে গেলো। ‘একটু খানি ভুলের তরে অনেক বিপদ ঘটে, ভুল করেছেন যারা সবাই ভুক্তভোগী বটে। একটু খানি ছোট্ট শিশুর একটু মুখের হাসি, মায়ের কানে সবার প্রাণে বাজায় সুখের বাঁশি।’
ভুলের কারণে অনেক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে যেমন মা তার ছোট্ট শিশুকে স্কুলে ভর্তি করার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়েছে। স্কুলে ঢুকতেই তাকে সন্দেহ করে গণপিটুনি দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এদিকে ছেলে ধরা এবং গলা কাটা বা শিশুর মাথা ব্যাগের ভেতর থেকে উদ্ধার করতে দেখা গেছে যা গুজব নয়। আবার ডেঙ্গুজ্বরে মানুষ মরছে এ খবরও গুজব নয়। তবে মাথা লাগবে পদ্মাসেতু তৈরি করতে এটা গুজব।
বাংলাদেশে বর্তমানে সত্য এবং মিথ্যার সমন্বয় ঘটে চলেছে ভয়ংকরভাবে। এর থেকে রেহাই পেতে অবশ্যই দরকার সবার সচেতনতার। সবার উচিত তার ন্যাশনাল আইডি কার্ড সঙ্গে রাখা, গণপিটুনির হাত থেকে রেহাই পেতে। সর্বোপরি যাচাই-বাছাই না করে, সত্য ঘটনা না জেনে, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ না হয়ে বা গুজবের কারণে, ভুল সিদ্ধান্তে, কারো জীবনে অন্ধকার যেন না নেমে আসে, সেদিকে খেয়াল রাখার জন্য সবাইকে অনুরোধ করছি।
‘ভুলের কারণে বিনা অপরাধে পিটিয়ে তোমরা মারিলে আমাকে তোমাদের দুহাত দিয়ে। আমার মাথাটা কেটে নিলে তুমি ওই ধারালো অস্ত্র দিয়ে। আমার জীবনে বেঁচে থাকার স্বপ্ন তাও তুমি নিলে কেড়ে। যে ভালোবাসা রয়েছে হৃদয়ে, দেখিতে যদি তুমি পারিতে, কখনও তুমি মারিতে না মোরে, তোমার দুহাত দিয়ে’।
সুতরাং প্রচারমাধ্যমের প্রতিনিধি ও মিডিয়া-ব্যবস্থাপকদের জন্য জরুরি হলো, তারা সংবাদ প্রোপাগান্ডা এবং গুজবের মাঝে পার্থক্য করবেন। মিডিয়া আসলে প্রচারকে ব্যাপক করা ও তথ্যকে বিকশিত করার মাধ্যম। যে মাধ্যমে নিত্য-নতুন টেকনোলজি ও নতুনত্ব এসে দুনিয়ার পরিধিকে যেমন ছোট করে দিয়েছে তেমন গ্লোবাল ভিলেজের ধারণাকে পোক্ত করে দিয়েছে।
সংবাদমাধ্যমের অবস্থান যেহেতু ইমেজ বৃদ্ধিকারীর হয়ে থাকে তাই তার সততা, ন্যায়পরায়ণতার দ্বারা সে গণমতকে প্রভাবিত করে সমাজের ইতিবাচক পথ নির্দেশনা দিতে পারে এবং নেতিবাচক প্রবণতা থেকে সমাজকে বাঁচাতে পারে। কেননা তথ্য হচ্ছে সেই শক্তি যা আমাদের কল্যাণ বা অকল্যাণ দুটোই দিতে পারে।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।rahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/এএসএম