নহাটা থেকে সুইডেনে

আবার এসেছি ফিরে গ্রাম বাংলার কোলে, যেখানে কেটেছে শৈশব। পলো দিয়ে মাছ ধরে আর মসুরি, খেসারি, মুগ, কলাই তুলে। পাট, সরিষা ও ধানক্ষেতে কিষাণের খাবার নিয়ে যেতে যেতে। কেটেছি সাঁতার, দিয়েছি পাড়ি, নবগঙ্গা নদীর এপার থেকে ওপারে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীতে গোসল করেছি, চোখ রাঙা করে ফিরেছি বাড়ি, খেয়েছি মায়ের হাতে পিটুনি।

মাঝে মধ্যে নদীতে মাছ ধরেছি খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে কুড়িয়েছি আম। খেজুর গাছের রস খেয়েছি মাঝে মধ্যে, হোক না তা নিজের বা পরের বলে কথা নেই, খেতে ইচ্ছে হয়েছে খেয়েছি। ধরা খেয়ে বকা খেয়েছি, পিটুনি খেয়েছি, মজার সঙ্গে সব বরণ করেছি।

আজ এত বছর পরে মনে পড়ে গেলো সেসব স্মৃতি, মনে পড়ে গেলো সেই নহাটা বাজার, স্কুল ও সেখানকার মানুষের কথা। ভাবছি একা বসে স্মৃতির জানালার পাশে, অতীতের স্মৃতিগুলো এসেছে ফিরে মোর হৃদয়ে, যারে আমি বেসেছি ভালো মনে প্রাণে। সে এক গভীর সম্পর্ক যা শুধু অনুভব করা যায় ভালোবাসার হৃদয় দিয়ে। আমি গড়ে উঠেছি তিলে তিলে সেই স্মৃতি ঝলমল সবুজে ভরা গ্রাম-বাংলার ইছামতি বিলের পাশে। সেই পানি টলটল নবগঙ্গা নদীর ধারে।

পড়াশোনা করেছি নহাটা স্কুল, গঙ্গারামপুর স্কুল, ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে শেষে ইউরোপ, জাপান এবং আমেরিকার খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। স্টকহোম স্কুল অফ ইকোনমিক্স থেকে এক্সিকিউটিভ এমবিএ করেছি। গ্লোবাল সাপ্লাই চেইন মানেজমেন্ট, ফাইজার ফার্মাসিউটিক্যালসের ডাইরেক্টর হয়েছি।

বিশ্ব নাগরিক হয়েছি। একজন আদর্শ স্বনামধন্য চাকরিজীবী ও রমণীর স্বামী হয়েছি। দুইজন উদীয়মান টেনিস তারকার বাবা হয়েছি। বাংলাদেশে আমার বাবা-মার পরিবার গঠনে অবদান রেখেছি, যেখানে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার নেপথ্যের কাহিনি উল্লেখযোগ্য। কিন্তু যে ইছামতি বিলের পাশে জন্মেছি ও গড়ে উঠেছি নবগঙ্গা নদীর তীরে, এর চেয়ে বড় পাওয়া পাইনি জীবনে এখনও।

কারণ বিশাল বিলের পাশে আর দেশখ্যাত নবগঙ্গা নদীর তীরে জন্ম। যেখানে কেটেছে ছোটবেলার দিনগুলো তার তুলনা অন্য কারো সাথে করার মতো জায়গা পৃথিবীর কোথাও দেখিনি আজও। গ্রামের কাছে, গ্রামের মানুষের কাছে, গ্রামের আলো বাতাসের কাছে, আমার যে অনেক ঋণ হয়ে আছে।

মনে হচ্ছে নহাটায় জন্মগ্রহণ করেছিলাম বলে মনপ্রাণ আজ এত বড় হয়েছে, জন্ম আমার ধন্য হয়েছে। তবে হ্যাঁ বিদেশে এসে কঠিন পরিশ্রম করতে হয়েছে, মনের মতো জায়গাটি দখল করে নিতে। তাইতো আজ নতুন প্রজন্মদের সঙ্গে মনের আনন্দে ভাগাভাগি করছি আমার জীবনের মূল্যবোধ, অভিজ্ঞতা আর সুশিক্ষা (যে শিক্ষায় দূর্নীতি নেই, আছে মানবতা ও মূল্যবোধ)। কারণ আমি আশা করি তোমরা অনুপ্রাণিত হবে আমাকে দেখে।

০-২১ বছর বাংলাদেশে কাটিয়েছি। এই ২১ বছরে বাংলাদেশ যা দিয়েছে পুরো পৃথিবী তার অর্ধেকও দিতে পারেনি গত ৩৭ বছরে। গ্রামের বাবা-মা, ভাই-বোন, শিক্ষক-স্কুল, সাথীরা, খেলার মাঠ-সাথী ও সেই সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলা পরিবেশ আমাকে তৈরি করেছে ভালোবাসার ছোঁয়ায়। সে ছোঁয়া অনুভব করি প্রতিটি মুহূর্তে, অনুভব করি প্রতিটি নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে আর বিশ্বাসে।

তাইতো মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, নহাটায় জন্মগ্রহণ করে যখন আমাকে মনের মতো করে গড়তে পেরেছি, তোমরা কেন পারবে না? মনে-প্রাণে ও ধ্যানে বিশ্বাস করি তোমরাও পারবে জীবনে বড় হতে। দরকার শুধু সাধনা, চেষ্টা, মোটিভেশন ও আত্মবিশ্বাস। বিশ্বাসে মেলায় বস্তু কর্মে সমাধান। আমাদের সময়ে যোগাযোগ ব্যবস্থা এত ভালো ছিল না। নহাটা থেকে ঢাকায় যেতে পুরো একটা দিন পার হয়ে যেত।

বাংলাদেশ থেকে বিদেশে চিঠি যেতে লাগত একমাস। উত্তর পেতে লাগত আরও একমাস! কিন্তু আজ যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটেছে। ইন্টারনেট আমাদের হাতে বিশ্বের জ্ঞান ভাণ্ডারকে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আমার বিশ্বাস ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেই জ্ঞান ভাণ্ডারকে তোমরা নিজেদের মতো করে আবিষ্কার করবে। সেই জ্ঞানের আলোয় নিজেদের আলোকিত করবে।

মনে রাখবে সমসাময়িক শিক্ষা ব্যবস্থা যদি তোমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে সাহায্য না করে, বা তোমাদের মধ্যে আত্মনির্ভরতা ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগিয়ে তুলতে সাহায্য না করে, তবে সে শিক্ষা সুশিক্ষা নয়। সুশিক্ষা পরিপূর্ণতার এক প্রকাশ।

এই মুহূর্তে দূর পরবাস থেকে নহাটার কথা ভাবছি, ৬৮ হাজার গ্রামের কথা ভাবছি। মাগুরার কথা ভাবছি, ভাবছি ৬৪টি জেলার কথা। নতুন প্রজন্মের কথা ভাবছি, সোনার বাংলার কথা ভাবছি। মানুষের কথা ভাবছি। ঐযে নবগঙ্গা নদী আর ইছামতির বিল, তার কথা ভাবছি। এর আশপাশে বসেই তোমরা কেউ হয়ত আমার এই লেখা পড়ছ! তোমাদের কথা ভাবছি। হয়তো তোমাদের মাঝে অনেকেই একদিন অনেক বড় হবে আর পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে আমার মতো করে এমনি আশার কথা লিখবে।

লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন।
rahman.mridha@gmail.com

এমআরএম/এএসএম