উজানজল-দেশভাগ, দাঙ্গা ও মুক্তিযুদ্ধের জাতিস্মর

শুরুতেই নজর দেওয়া যাক বইটার ফ্ল্যাপে। সেখানে লেখা আছে, মানবিক অনুভূতিগুলোকে অবিভাজ্য রেখে দেশে দেশে সীমানা বিভাজিত হয়। এই বিভাজনের খেলার ক্রীড়ক ও ক্রীড়নক থাকে মানুষ নিজে। যুগে যুগে মানুষের ইশারাতেই মানুষের রক্ত ঝরে, ভূখণ্ডের সীমানা নির্ধারিত হয়, দেশের প্রান্তসীমায় কাঁটাতার বসে, এক দেশ ছেড়ে আরেক দেশে ঠাঁই নেয় মানুষ।
দেশছাড়া আর দেশহারা যেভাবেই আখ্যায়িত করা হোক না কেন এই মানুষগুলোর হাহাকার যেন জলের রেখা ছাড়া আঁকা যায় না। আরও লেখা হয়েছে, কালের অভিঘাতে নিয়ত উজানে বহমান এসব হাহাকার আর বেদনাই মূর্ত হয়ে উঠেছে ‘উজানজল’ গল্প গ্রন্থের দশটি গল্পে।
গল্পগুলোতে দাঙ্গা ও দেশভাগের পরিণতিতে বাস্তুচ্যুত মানুষের অকথিত মর্মবেদনা যেমন উঠে এসেছে তেমনি উঠে এসেছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগ করা মানুষের আখ্যান।
ছোট কলেবরের দশটা গল্পের বই ‘উজানজল’। দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে দেশভাগ একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা যেটা নির্ধারণ করে দিয়েছিলো এই অঞ্চলের মানুষের ভবিষ্যৎ। ব্রিটিশদের নীতি ছিলো, ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ মানে প্রথমে বিভাজন তৈরি করো তারপর শাসন করো। কোন সম্মিলিত শক্তিকে মোকাবিলা করা অনেক কঠিন কিন্তু সেটাই বিভাজিত হয়ে গেলে তার শক্তি অনেকাংশে কমে যায়।
কথায় আছে ‘দশের লাঠি একের বোঝা’। ইংরেজদের এই বিভাজন নীতির বলি হয় ভারতবর্ষের আপামর মানুষ। এমনকি তারা যখন এই দেশ ছেড়ে চলে যায় তখন পেন্সিলের আঁচড়ে এমন একটা বিভাজন সৃষ্টি করে রেখে যায় যার ফল এখনো ভোগ করছে অত্র এলাকার মানুষ।
এখনো এসব অঞ্চলে ধর্মের নাম জাতপাতের নাম দাঙ্গা খুবই সাধারণ ঘটনা। এরপর একটা সময় খণ্ডিত রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে জন্ম নেয় নতুন এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ। সেই পথও রক্তে রঞ্জিত এক অধ্যায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিভৎস দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকেও হার মানায় কোনো কোনো ক্ষেত্রে।
মাত্র নয় মাসের ব্যবধানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশের ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করে, সম্ভ্রম নষ্ট করে তিন লাখ মা বোনের। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচার যারা সে সময় সামনাসামনি দেখেছেন তারাই শুধুমাত্র বিশ্বাস করেন। এখন এগুলো যে কাউকে বললে তার কাছে বাড়িয়ে বলা গল্প মনে হতে পারে। কিন্তু সেই অত্যাচার সত্যি সত্যিই বাংলাদেশের মানুষের জীবনে নেমে এসেছিলো। আর তার সুদুরপ্রসারী প্রভাব এখনো রয়ে গেছে বাংলাদেশের মানুষের জীবনে।
উজানজলের প্রতিটা গল্পে স্থান পেয়েছে মানুষের অব্যক্ত হাহাকার। স্বজন হারানোর বেদনা, নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে আসার বেদনা আবার কখনও উঠে এসেছে নিজের সম্ভ্রম হারানোর কষ্ট। গল্পগুলো পরিসরে ছোট হলেও পাঠকের মনে প্রভাব ফেলবে নিশ্চিত। পাঠক দিব্য চোখে সাক্ষী হয়ে যাবেন দেশভাগ এবং মুক্তিযুদ্ধের।
আর গল্পগুলোর চরিত্রের মুখের ভাষা একেবারে এই অঞ্চলের জনজীবন থেকে উঠে আসা কথ্য ভাষা পাশাপাশি আছে এই অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি ও জনজীবনের নিবিড় বিবরণ। যারফলে পাঠক নিজের অজান্তেই গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ফেলবেন। আমি এই বইয়ের গল্পগুলোতে এমন কিছু শব্দের প্রয়োগ খুঁজে পেয়েছি যেগুলো এখন শুধুমাত্র হয়তোবা অভিধানে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
যেমন ‘বিরিক্ষ’ গল্পের কয়েকটা লাইন এমন- ‘বেউড় বাঁশে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ফাতেমা মুচকি মুচকি হাসে আর জিভে চকাস চকাস শব্দ তুলে তেঁতুল ভর্তা খায়। প্রতিবেশী কাকির দিকে ধাঁধাভরা চোখে তাকিয়ে আবাগীর ব্যাটা মুটুরমুটুর হাসে আর গুটুরগুটুর গীত গায়। কাকা খালি আলাংফালাং করে, কথার গোমর ভাঙে না। স্বীকার করুক আর না করুক ভরপেট খেলে আহসানুল্লাহর হাতের তৈরি পানের জন্য তাদের প্রাণ আইঢাই করে। নিজের ল্যাতপ্যাতে শাখা-প্রশাখার বিস্তার ঘটিয়েছিল বাড়ির সীমানা ছাড়িয়েও।’
‘দাগমোচন’ গল্পের কয়েকটা লাইন এমন, খুঁজতে খুঁজতে মাটির দিকে দৃষ্টি দিতে ভুলে গিয়ে নাড়ায় পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এমন সময় কাঁখে এক বোঁচকা কচুর লতি নিয়ে ফরিদা সামনে এসে দাঁড়ায়। ‘যার নাম রেনুবালা’ গল্পের কয়েকটা লাইন এমন, দুই হাতে দুই লুচি আর রসে ডুবডুবা মিষ্টি দিত। শাপলা তুলবি অভি?
আমাকে কটা দিস তো, বেশ ডগডগে হয়েছে লতাগুলো, চিংড়ি কষা করলে বেশ স্বাদ হবে। মায়ের হাত থেকে শাপলার ডাঁটি নিয়ে ফুলকে লকেট করে মালা বানিয়ে গলায় পরত রেনু। আমাদের ছোট শহর ছিল নদীর কোচড়ের ভেতরে। ‘রূপসার জল’ গল্পের একটা লাইন এমন, এটা দেখেছ। এটা ঠাকুরদার বাড়ির চৌচালা ঘর, এটা সুখী গাই আর পুকুরপাড়ে এই যে ঘুড়ির নাটাই হাতে ‘আমার ঠাকুরদা। ‘স্মৃতিলেখা’ গল্পের একটা লাইন এমন, ‘আর সেই ঘিয়ে ভাজা নিম পাতা, বেতের কচি ডগা ভর্তা।’
‘চৌহদ্দি’ গল্পের কয়েকটা লাইন এমন, ‘অথচ সকালে ফুলকো লুচি আর কাউনের পায়েসের পাত ফেলে রেখে শম্ভু বাকশোখানা বগলদাবা করে কাউকে না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। অথচ রঘুনাথ দত্ত বাড়ির মাসকাবাড়ি বাজারের সঙ্গে মহিশলুঠির রুই আনলে মুড়োটা এক পাতে তুলে দুই ভাইয়ে ভাগজোক করে খেত। কাজলগৌরি ইলিশের পেটি সমান মাপে জায়গা নিত দুই ভাইয়ের কাঁসার থালায়।
‘জলের বিপরীতে’ গল্পের কয়েকটা লাইন এমন, ‘নাতির জন্য দিনমান নানিকে ঘিরে থাকা উৎকণ্ঠা, বিহ্নবেলায় মাওলানা নানার দরাজ কণ্ঠে কুরআন তেলওয়াত, ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে ঝুঁকে ঝুঁকে-দুলে দুলে আমপারা-সিপারা পাঠ, আলিফ যবর আ, বা যবর বা'র জাদুকরী সুর।... যাদব ওদের বাড়ির মালতি গাইয়ের সদ্য বিয়ানো বাছুরের মতো মায়ের পেটে ঘাঁই মারে।…বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে ঘৃণার তুষ।'
এইবার গল্পের বিষয়বস্তু গুলোর দিকে নজর দেয়া যাক। প্ৰত্যেকেটা গল্পে দেশভাগ, দাঙ্গা ও মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ দেয়া হয়েছে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে। সেখানে স্থান পেয়েছে ঘটনার প্রেক্ষিত থেকে শুরু করে বর্ণনা এবং ঘটনার ফলাফল পাশাপাশি এগুলোর সুদূরপ্রসারী প্রভাব। দেশভাগের প্রসঙ্গে 'জলের বিপরীতে' গল্পের বলা হয়েছে - 'তবে গল্পের মোচড়ে ছিল র্যাডক্লিফ রোয়েদাদ। নখের আঁচড়ে দুই দেশের মাটি ভাগ করে নেয়ার সময়কাল।… যমিন আমরার, আর তারা তারার খিয়াল কুশি মতো বাগ খরিলিলো। অখন আমরা আমরায় মাইর খরি মরি।…মাটি মাটি খরি অউতো হগল আলগা অইলো, খত রক্ত ফরলো। তারার কাছে দেশ হইলো খালি মাটি, আর আমরার কাছো হখলতা।' এই গল্পেই স্থান পেয়েছে দেশভাগের সময়কালের স্লোগানও -
'মুসলিম লীগের মার্কা কি
কুড়াল ছাড়া আবার কি
পাকিস্তান জিন্দাবাদ,
লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, কায়েদে আজম জিন্দাবাদ
আসামে থাকবো না
গুলি খেয়ে মরবো না
কংগ্রেস সরকার জুলুম করে
নামাজেতে গুলি করে'
দেশভাগ হলেও মানুষ নিজের মনের গহীনে রয়ে যায় ফেলে আসা ভিটেমাটির সব স্মৃতি। আর যখনই সেই দেশের কাউকে যখন খুঁজে পান তখন মেলে ধরে স্মৃতির ডালা। 'রূপসার জল' গল্পের ভুবন মিত্র নাতনি রূপসাকে বলেছেন - 'এখন সবই গল্পের মতো লাগে বুঝলি। নিজের সাতপুরুষের ভিটে ছেড়ে আসা, সে তো গল্পই এখন। ঝোলার মধ্যে ঢুকিয়ে রেখেছি। দম আটকে এলে বের করি।' শাফায়েতের মতে - 'কোন কালে ছেড়ে আসা এক দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য আত্মার ভেতরে এতটা জায়গা পুষে চলেছেন মানুষটা।…'কতবার যে বাড়িঘর বদলেছেন তবু বন্ধুর দেওয়া লাটিমটি তিনি হারাননি।'
ফেলে আসা দেশের কাউকে খুঁজে ফেলেই তার সাথে এক অদৃশ্য বন্ধনও তৈরি করে নেন সহজেই। দেশ ভাগের সময় ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন কিন্তু যখনই জানতে পারলেন শাফায়েত তার জন্মভুমি খুলনার মানুষ তখনই যেন খুঁজে পেলেন আত্মার আত্মীয়কে। ভুবন মিত্রের স্ত্রীর ভাষায় - 'ও মা এতটুকু করব না। তোমরা আমার শ্বশুরবাড়ির দেশের লোক।'
দেশ ভাগ ছাড়াও এই বইয়ের গল্পগুলোর অন্যতম উপজীব্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। গল্পগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতার পাশাপাশি উঠে এসেছে সমাজে এর পরবর্তি প্রভাবও। 'লাশটা খুঁজে পাওয়া যায়নি' গল্পে বলা হয়েছে - 'প্রকৃতপক্ষে গর্তে মানুষের স্তূপীকৃত লাশ দেখেছে রেজা। শত শত, হাজার হাজার লাশ। যাদের দুই হাত পিছমোড়া করে বাঁধা, শরীর দুমড়ানো। এসব লাশের উন্মুক্ত করোটির ছিদ্রপথে ঠোঁট দিয়ে খুঁচিয়ে চলছে কাক আর শকুন।
পেটের মাংস খুবলে খাচ্ছে শেয়াল। চারিদিকে উড়ছে মাংসপচা ঘ্রাণ।' মুক্তিযুদ্ধে মহিলাদের উপর অত্যাচারের বর্ণনাও উঠে এসেছে 'দাগমোচোন' গল্পে - 'বেয়নেটের চেরা দাগগুলো আগের মতো আর ভেসে নেই। স্তন, পেট আর উরুতে বসে যাওয়া দাঁতের দাগগুলোও মসৃণ হয়ে এসেছে। দুই পা ফাঁক করে নিজের আরও গভীরে যায় তারাবিবি। নেই, ওখানেও নেই। যোনিপথ চেরা দীর্ঘ দাগটাও মিলিয়ে গেছে।'
মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতার অন্যতম পরিনাম ছিলো যুদ্ধ শিশু। এইসব যুদ্ধশিশুরা পরবর্তিতে কখনোই সুস্থ্য স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। 'দাগমোচোন' গল্পের সবুজ তারা বিবির যুদ্ধ সন্তান। তাই সবুজকে তার স্ত্রী সুযোগ পেলেই খোটা দেয় - 'এহ হে রে আমার ভাতার আইছে, যা যা তোর মাগেরটা ভাঙ দেখি।' শিশুকাল থেকে যতবারই সবুজ এসব শব্দ শুনেছে ততবারই দিশেহারা হয়ে উঠেছে। যুদ্ধ শিশু বলেই 'বিরিক্ষ' গল্পের আহসানুল্লাহ কে শুনতে হয়ে 'আবাগীর ব্যাটা' খোঁটা। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের কথা এবং সমাজে তাদের প্রতিষ্ঠিত হবার কথাও উঠে এসেছে এই বইয়ে। 'স্মৃতিলেখা' গল্পে বিখ্যাৎ লেখক সুবিনয় সাহার বইয়ের প্রকাশক রাজাকার আব্দুল কাদের।
এতোকিছুরও পরও লেখক মা'কে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। 'বিরিক্ষ' গল্পের যুদ্ধ শিশু আহসানউল্লাহর মুখ দিয়ে বলিয়াছেন লতিফ সরকার ও মায়া রানির 'মা ফাতেমা ও হজরত আলীর পালা গান'র একটা অংশ -
'আমার নবীজির মা ফাতেমা
জননী মা জননী মা...
নবীজি কোথাও বসে থাকলে
মা ফাতেমা সেথায় গেলে
করতেন নবী ভাবের বিনিময়
মা ফাতেমাকে সালাম দিয়া
দরদি...উঠতেন নবী দাঁড়াইয়া।
জননী মা জননী মা...
,মা ফাতেমা...'
লেখক স্বপ্ন দেখিয়েছেন একটা তারকাঁটার বর্ডার ছাড়া এক পৃথিবীর। 'রূপসার জল' গল্পের রূপসার আঁকা ছবির বর্ণনায় লেখক লিখেছেনঃ 'এই ছবির পৃথিবীতে কোনো বর্ডার নেই। কোন রিফিউজি নেই। ছবিতে মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়ানো ডানা লাগানো মানুষের অপরূপ পৃথিবী দেখতে দেখতে ফৌজিয়া আক্তার ওআর শাফায়েতের ভেজা চোখ শত চেষ্টা করেও পানি ধরে রাখতে পারে না।'
এই বইয়ে লেখক সাদিয়া সুলতানা মানুষের জীবনের একেবারে গভীরে প্রবেশ করে নিখুঁত এবং বাস্তবসম্মত বর্ণনায় তুলে এনেছেন দেশভাগ, দাঙ্গা এবং মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা এবং পরিণতি পাশাপাশি স্বপ্ন দেখিয়েছেন একটা কাঁটাতারের সীমানাহীন পৃথিবীর। এই বই পড়তে পড়তে আমরাও লেখকের সাথে স্বপ্ন দেখি এমন একটা পৃথিবীর যেখানে কথায় কথায় নখের আঁচড়ে দেশ ভাগ হয়ে যাবে না। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে মানুষের উপর নেমে আসবে না অকথ্য অত্যাচার।
এমআরএম/এএসএম