চীনের ‘নারিকেল প্রদেশ’ হাইনানে একদিন

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:৪৭ এএম, ২২ জানুয়ারি ২০২৩

ছাও ইয়ান হুয়া সুবর্ণা

নারিকেল বাংলাদেশের নাগরিকদের কাছে সুপরিচিত একটি ফল। তবে চীনের উত্তরাঞ্চলের লোকদের জন্য সেটি কেবল গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়। গত নভেম্বর মাসে আমি হাইনানে নারিকেল বাগান ঘুরে বেড়িয়েছি, বহু নারিকেল গাছ দেখেছি, আর নারিকেলের চাষাবাদ সম্পর্কে কিছু ধারণাও পেয়েছি। সেই মজার অভিজ্ঞতা আমার স্মৃতিতে গভীর দাগ কেটেছে। তাই, চীনের নারিকেল শিল্প নিয়ে কিছু বলতে চাই।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের ই-কমার্স দ্রুত উন্নত হয়েছে। যারা বিভিন্ন ধরনের ফল চাষ করেন, তারা বাগান থেকে লাইভ অনুষ্ঠান করে থাওবাও, তৌইন বা পিনতুওতুওসহ বিভিন্ন এপিপির মাধ্যমে অনলাইনে বিভিন্ন ফল ও কৃষিজাত দ্রব্য বিক্রি করেন। চীনা ক্রেতাদের জন্য এটি এখন খুব পরিচিত ও প্রচলিত একটি পদ্ধতি।

হাইনান প্রদেশের নারিকেলচাষীরাও এভাবে তাদের নারিকেল চীনের বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করেন। এক্সপ্রেস ডেলিভারি শিল্পের দ্রুত উন্নয়নের কারণে, হাইনান থেকে উত্তর চীনে নারিকেল পাঠানো এখন অনেক সহজ, মাত্র তিন দিনে প্যাকেজ গন্তব্যে পৌঁছে যায়।

বর্তমানে চীনের বিভিন্ন এলাকার মানুষরা অনলাইনে নারিকেল কিনতে এবং সে নারিকেলের পানি ও শাস খেতে বেশ পছন্দ করেন। কারণ, নারিকেলের পানি খুবই পুষ্টিকর, এতে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং অন্যান্য খনিজ উপাদান রয়েছে। এ পানি শরীরের বিভিন্ন ভিটামিনের অভাব পূরণ করে।

jagonews24

হাইনান ভ্রমণের সময় আমি হাইখৌর ওয়েনছাং আর থুনছাং জেলায় গেছি। হাইখৌ শহর হাইনান প্রদেশের রাজধানী। হাইখৌ থেকে গাড়িতে বসে দেড় ঘণ্টার মধ্যে থুনছাং জেলায় পৌঁছে যাই। দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার। সেখানে বিশাল নারিকেল বাগান দেখেছি। থুনছাং নারিকেল বাগানের মালিক ম্যাডাম কাও ওয়ে আমাকে বলছিলেন, তাদের বাগানে কেবল সোনার নারিকেল চাষ করা হয়, যা দেশীয় জাত নয়, বরং থাইল্যান্ড থেকে আমদানি করা জাত।

এ বাগানে সোনার নারিকেল গাছ আছে প্রায় ২৭ হেক্টর এলাকাজুড়ে। নারিকেল গাছের সংখ্যা ৪০ সহস্রাধিক। সোনার নারিকেল গাছ হাইনানের সবুজ নারিকেল গাছের চেয়ে কম উঁচু এবং এ গাছ চাষ করার ৬ থেকে ৭ বছরের মধ্যে নারিকেল পাওয়া যায়। প্রতিটি গাছে বছরে ১২০ থেকে ২০০টি নারিকেল ধরে।

সোনার নারিকেলের দাম সবুজ নারিকেলের চেয়ে বেশি। বাজারে একটি সোনার নারিকেলের দাম ২০ থেকে ৩০ ইউয়ান। তাই এ ফলের চাষ স্থানীয় গ্রামবাসীদের বার্ষিক আয় অনেক বাড়াবে। ম্যাডাম কাও বলেন, ৫ বছর আগে তাদের বাগানে সোনার নারিকেলের চাষ প্রথম শুরু হয় এবং বর্তমানে অল্প সংখ্যক গাছে নারিকেল হয়েছে।

চলতি বছর থেকে আগামী বছর পর্যন্ত সোনার নারিকেল গাছগুলো পরিপক্ক হবে। সেটি চীনা ভোক্তাদের জন্য সুখবর। তারা তখন সহজে ও দ্রুত নিজের দেশে উৎপন্ন সোনার নারিকেল কিনতে পারবেন।

আমি নারিকেল বাগানের শীর্ষস্থানে দাঁড়িয়ে পুরনো বাগানের দৃশ্য উপভোগ করেছি। আমার আশপাশে নীল আকাশ ছাড়া প্রচুর নারিকেল গাছ দেখা যাচ্ছিল। বিভিন্ন গাছের উচ্চতা আমার চেয়ে একটু বেশি। তাই মাটিতে দাঁড়িয়ে সোনার নারিকেল ধরতে পারি। প্রত্যেক ফলের ওজন ৩ কেজির মতো। তার খোসাও সবুজ রঙয়ের চেয়ে একটু হাল্কা।

এ থেকে সহজে মিষ্টি পানীয় পান করা যায়। বাগানের কর্মীরা আমাদের জন্য সোনার নারিকেল দিয়ে বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার রান্না করেন। এর মধ্যে নারিকেল ও মুরগীর সুপ এবং নারিকেলের খোসা দিয়ে মিষ্টি বেশ জনপ্রিয়। নারিকেল বাগানের কর্মীরা প্রতিদিন বাগানের হোস্টেলে থাকেন। তারা শুধু সাপ্তাহিক ছুটিতে বাড়িতে ফিরে যান।

তাই হোস্টেলের আশপাশে শাকসবজি ও মুরগী লালন-পালন করেন তারা। আমার সফরসঙ্গীরা একটি মুরগী ধরে নেন এবং সোনার নারিকেলের পানি বা রস দিয়ে মুরগির মাংস সিদ্ধ করে সুপ রান্না করেন। এর স্বাদ বেশ ভালো, নারিকেলের সুগন্ধ ও হাল্কা মিষ্টি স্বাদ মাংসের মধ্যে মিশেছে। অল্প লবণ দিয়ে সুপ খাওয়া যায়। নারিকেল দিয়ে তৈরি পিঠাকে হাইনানের বাসিন্দারা ‘ইবো’ বলে ডাকে।

jagonews24

বড় পাত্রে ২০ মিনিটের মতো স্টিম করার পর আঠালো নারিকেল পিঠা খাওয়া যায়। সেটি নারিকেলের পাতার সুগন্ধযুক্ত। আমি কারখানার খালার কাছ থেকে এ পিঠা তৈরির পদ্ধতি শিখেছি। আমার জন্য বেশ মজার ব্যাপার ছিল সেটা।

সবুজ রঙয়ের নারিকেল ওয়েনছাং জেলায় বেশি দেখা যায়। সেটি হাইনান প্রদেশের স্থানীয় জাতের নারিকেল। থুনছাং জেলা থেকে আরও দুই ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে ওয়েনছাংতে পৌঁছাই আমরা। ওয়েনছাং জেলার নারিকেল গাছগুলো সৈকত এলাকা থেকে গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত।

এ বাগানের মোট আয়তন ১৩ হাজার হেক্টরেরও বেশি। তুংচিয়াও নারিকেল দর্শনীয় এলাকা চীনাদের জন্য সুবিখ্যাত একটি দর্শনীয় স্থান। বর্তমানে সৈকত এলাকায় কেবল অল্পসংখ্যক নারিকেল গাছ রয়ে গেছে। এর আশপাশে হোটেল ও রিসোর্ট নির্মিত হয়েছে। পর্যটকরা এখানকার নারিকেল বাগান ও সমুদ্রের দৃশ্য উপভোগ করেন।

ওয়েনছাংয়ে পৌঁছানোর পর আমরা দর্শনীয় স্থানের কাছে একটি ছোট কারখানায় যাই। কারখানায় ১০ জনের মতো কর্মী রয়েছেন, যারা সবাই ব্যস্ততার মধ্যে নারিকেলের খোসা ফেলে প্যাকেট তৈরি করেন। প্রতিদিন একজন কর্মী কমপক্ষে ২০০টি নারিকেলের খোসা ছাড়াতে পারেন। সুশৃঙ্খলভাবে নারিকেলের সবুজ খোসা ফেলে

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী এবং চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি) এর বাংলা বিভাগের উপ-পরিচালক

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]