বেঁচে থাকুক তামাশা

ড. মইনুর রহমান
অন্ধকার একটি জানালা, আলো আঁধারীর একঘর, জানালার কাছে একটা চেয়ার। জানালার এপাশে ছায়া অন্ধকারের হুটোপুটিতে গালে হাত দিয়ে বসে থাকা আমি। আমার রুম বেশিরভাগ সময় অন্ধকার থাকে। ছোট্ট একটি রুম। এর ভেতর আগের জনের জিনিসপত্র দিয়ে ঠাসা। মাঝে আমি একটা চাকাওয়ালা চেয়ারে বসে দোল খেয়ে খেয়ে দিনের বেশির ভাগ সময়টা কাটিয়ে দেই।
চাকাওয়ালা চেয়ার। হুম, ছোট থাকতে আমার খুব শখ ছিল এমন একটা চেয়ার থাকবে, আর আমি সেটাকে গাড়ি বানিয়ে সারা ঘরময় খেলে বেড়াবো। নাহ, ছোট থাকতে এই শখ পূরণ হয়নি। আব্বুর ধারণা ছিল আমি দুই দিনেই চেয়ারের নাড়ি-ভুঁড়ি সব বের করে দেবো। তার দোষ দিয়েও লাভ নাই, আমি এমনই ছিলাম। যাইহোক, সেই চাকাওয়ালা চেয়ারকে গাড়ি বানিয়ে ওই সময় খেলার সুযোগ না থাকলেও এখন খেলি।
মাঝে মাঝে অফিসে যখন আমাদের বসেরা থাকে না, কিংবা খবরদারির মানুষগুলো হয়তো পাশের দালানে মিটিংয়ে ব্যস্ত, এই সুযোগে ড্যান, আমি আর এলেক্স, সামনের লম্বা করিডোরে এই চাক্কাওয়ালা চেয়ার দিয়ে গাড়ি বানিয়ে হৈহুল্লোড় করে হটহুইল খেলি। ড্যান অনেক সিনিয়র, তবুও তার ভেতরের ছেলেমানুষি এতটুকু কমেনি। ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় আমার কোনো ছোট ভাই থাকলে বোধয় এমন শয়তানি করতে পারতাম দুইজনে মিলে।
ভালো থাকুক, ড্যান। ভালো থাকুক, ড্যানের মতো মানুষগুলো। বেঁচে থাকুক আজীবন এই ঠাট্টা তামাশায়। অন্ধকার জানালা, জানালার ওপাশে মরে যাওয়া শীতের আকাশ। এবার শীত অনেক তাড়াতাড়ি পালিয়ে গেলো। বাইরে শীত চলে গিয়ে বসন্তের দমকা হওয়ার দাপট। এই বাতাসের হলকায় গাছ থেকে ঝরে ঝরে পড়তে থাকে গাছের শুকনো পাতা।
বাতাসের দমকে গড়িয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে যেতে থাকে রাস্তাময়, রাস্তার চারপাশ, রাস্তার পাশে ফুটপাথ, আর অপরিচিত কোনো প্রতিবেশীর সারবাঁধানো আঙিনায়। গড়াতে গড়াতে সূর্যের আলোয় প্রতিফলিত হতে হতে একটা অদ্ভুত অবসন্ন অনুভূতির আবেশ তৈরি করে দিয়ে যায়। কি যেন মনে করে দিয়ে যায়।
মনে করিয়ে দিয়ে যেতে চায় সেই ছোটবেলা, গ্রামের মেঠোপথ, শীতের শুকনো আবহাওয়ায় শুকিয়ে যাওয়া মাটির রাস্তায় হয়তো এই সময় এমনি করে শুকনো পাতাগুলো পাক খেয়ে গড়িয়ে ছড়িয়ে যেতে থাকে চারপাশ। একটা গন্ধ নাকে আসতে থাকে। কেমন যেন গা গুলানো পেটে পাক দেওয়া গন্ধ। সর্ষে ফুলের গন্ধ। এখন হয়তো আমার গ্রামে সর্ষে ফুলের মৌসুম।
মাঠে মাঠে হলুদ হলুদ সর্ষে ফুলগুলো গন্ধ ছড়িয়ে ডেকে নিতে চাইছে মৌমাছির দলকে। পরাগরেণু ছড়িয়ে সর্ষে বীজ নিষিক্ত করতে। মৌমাছির ভালো লাগুক আর চাই না লাগুক, এই সর্ষে ফুলের গন্ধ আমার ভালো লাগতো না, গা গুলাতো। কিন্তু এই গা গুলানো ভাবটাই কেমন যেন খুব পেতে ইচ্ছে করছে।
মাঠে মাঠে হয়তো মটর, কলাই এর ঝোঁপ। ঝোঁপগুলো বেয়ে হয়তো বেরিয়ে আসছে ছোট্ট কচি মটর কলাইয়ের শিম। সকালের কুয়াশা সিক্ত শিশির ভেজা ক্ষেতের আইলের ঘাস বেয়ে বেয়ে হাটু পর্যন্ত কাঁদা কাঁদা করে এই খেত থেকে ওই খেতে গিয়ে কলাই শিম খুটে খুটে দেখা, কার ক্ষেতের মটর আগে ‘বতি’ হবে, আর কার ক্ষেতের শাক এখনো কচি, কেমন যেন একটা খেলার মতো ছিল।
সকালের সূর্য উঠে কুয়াশা কেটে গিয়ে যখন সূয্যিমামা বেরিয়ে আসতেন, তার আলোয় মটর গাছে জমে ওঠা শিশিরে শিশিরে ছেয়ে যাওয়া দিগন্ত বিস্তৃত সাদা চাদর গলে গলে ধোঁয়াশায় মিলিয়ে যেত। বেছে বেছে এর খেত ওর খেত থেকে তুলে আনতাম কচি শাক আর বতি হওয়া মটর। ওই সময় নামে খেত থাকলেও খেতের ফসল ছিল সবার। সবাই সবারটা নিতো, কেউ কিছু মনে করতো না। এখন কেমন, তা জানি না।
সেই কচি শাক নানি দুপুরে রান্না করে দিতো। গরম গরম মোটা চালের ধোঁয়া ওঠা ভাত, সঙ্গে কুচো চিংড়ি দিয়ে মটরের শাকভাজি, অদ্ভুত সেই স্বাদ বর্ণনার অতীত। দুপুরে মাটির দাওয়ায় সব পিচ্চি কাচ্চা গোল হয়ে বসে মাটির চুলোর কাঠকুটি পোড়া গন্ধ নিতে নিতে হুড়োহুড়ি করে এই শাক ভাজি আর ভাত, সময়টা অন্যরকম ছিল।
বতি হওয়া মটরগুলো উঠানের কোনায় জমতে থাকতো, শুকিয়ে ওঠার জন্য। কোনো এক ভরা পূর্ণিমার রাতে মা হয়তো সবাইকে ডেকে নিয়ে উঠানে বসিয়ে দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দিতেন সেই মটরের স্তুপে। শীতের রাতে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে আর মটরের আগুনে ভাপ নিতে নিতে অপেক্ষা করতে থাকতাম মটর পোড়া খাবার আশায়।
দু একটা মটর হুটহাট সশব্দে ফেটে গিয়ে অদ্ভুত একটা তামাশার মুহূর্ত তৈরি করে দিতো। সেই তামাশা হয়তো আজ আলো ঝলকানি বাজি পুড়িয়েও পাওয়া যাবে না। কি জানি, হয়তো যাবে। আমাদের অপেক্ষা বাড়তে থাকতো, সঙ্গে পোড়া মোটরের একটা সুস্বাদু গন্ধ ছেয়ে ফেলতো সেই কুয়াশায় মোড়া উঠোনের চারপাশ।
আমি গালে হাত দিয়ে অনেক আগ্রহ নিয়ে ধিকি ধিকি জ্বলে যাওয়া আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। আজ যেমন তাকিয়ে আছি ছোট্ট একচিলতে জানালা বেয়ে, দূরে, অনেক দূরে, আকাশের কোনায়, যেখানে ছেড়ে যাওয়া শীত এখনো হয়তো লুকোচুরি খেলে যাচ্ছে, শেষ বারের মতো।
লেখক: আমেরিকা প্রবাসী
ড. মইনুর রহমান, ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার, সিটি অব মবিল, অ্যালাবামা, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র।
এমআরএম/জেআইএম