যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি: লাভ ক্ষতি কার?

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক
প্রকাশিত: ১১:০১ এএম, ০৩ জুন ২০২৩
মো: মাহমুদ হাসান

মো. মাহমুদ হাসান

গণতন্ত্রের ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশিদের জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। গণতন্ত্রের প্রতি পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্রের দরদ নতুন কিছু নয়। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতার মতো অতি আকর্ষণীয় অস্ত্রগুলোকে ব্যবহার করেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্বার্থসিদ্ধির কূটনীতিকে দুনিয়াব্যাপী সম্প্রসারিত করে। এ সম্প্রসারণবাদের সঙ্গে আধিপত্য আর আগ্রাসনবাদের সম্পর্কও বিদ্যমান, যার অন্তরালে থাকে অর্থনৈতিক কর্তৃত্ববাদের এক সুগভীর যোগসূত্র।

একটা সময় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক সরকারকে নানা অজুহাতে ক্ষমতাচ্যুত করে, সুশাসন প্রতিষ্ঠার কথা বলে সামরিক একনায়কদের শাসন প্রতিষ্ঠার রেওয়াত চালু হয়েছিল। পরে সেই সামরিক শাসকদের গণতন্ত্রের লেবাস পরিয়ে, যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থসিদ্ধির কূটনীতি তো নতুন কিছু নয়। ৭৫ পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুটো সামরিক সরকারের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সখ্যতাকে বিশ্লেষণ করলে আমাদের গণতন্ত্রের প্রতি মহা শক্তিধর এই রাষ্ট্রটির ভালোবাসার চিত্রটি বুঝতে খুব একটা কষ্ট হয় না।

স্বাধীনতার মাত্র তিন বছরের মাথায় ভয়াবহ বন্যায় ডুবেছিল বাংলাদেশ। পিএল ৪৮০ আওতায় দেওয়া দুই দশমিক দুই লাখ টন খাদ্য সহায়তা বন্ধ করে দিয়ে, কেন সেদিন মার্কিন সরকার বাংলাদেশকে মানবিক বিপর্যয়ের পথে ঠেলে দিয়েছিল? কেন মোশতাক গংদের সাথে রাত-বিরাতে ঘন ঘন কূটনীতিক পাড়ার ক্ষমতাধর অফিসটিতে দেখা সাক্ষাতের সুযোগ তৈরি করা হয়েছিল? কেন পনেরো আগস্টের এর কুশীলবদের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার খরগ নেমে আসেনি?

কেন মইনুদ্দিন ফখরুদ্দিনকে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে তিন মাসের অগণতান্ত্রিক সরকারকে সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় রাখা হয়েছিল? শিশু রাসেলের হত্যাকাণ্ডকেও কেন সেদিন তথাকথিত গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকদের নিকট মানবতাবিরোধী হত্যাকাণ্ড মনে হয়নি? এ শক্তিধর দেশের দূতরা কেন আগামসী লেনের বাড়িতে ঘন ঘন যাতায়াত করতেন? ৭১ থেকে ৭৫ অবধি তাদের ভূমিকা কি ছিলো, এর অনেক তথ্যই এখন উইকিলিকসের ফাঁস করা তথ্য ভান্ডারে সংরক্ষিত।

সিরিয়া, লেবানন, ফিলিস্তিন, মধ্যপ্রাচ্য এবং হাল আমলের ইউক্রেন সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের মানবিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের রীতিনীতিগুলো কোথায়? ইসরাইলিদের হাতে ফিলিস্তিনি শিশু, গর্ভবতী নারী, বয়োবৃদ্ধ মানুষগুলো যখন বোমা আর বেয়োনেটে ক্ষতবিক্ষত হয়, নিষেধাজ্ঞা নামক মারণাস্ত্রটি তখন কোথায় লুকিয়ে থাকে? গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা আর মানবতার স্লোগান, সবই তাদের ভেলকিবাজি!!

ক্ষমতার যথেচ্ছ ব্যবহার করে, রাজনৈতিক মোড়লীপনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিই তাদের মূল লক্ষ্য। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্যই ‘গণতন্ত্র’ নামক বহুকাঙ্খিত ইস্যুটিকে পুঁজি করে পিটার হাসের দৌড়ঝাপ এখন বাংলাদেশের প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু সচিবালয় থেকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়!! আর এ ইস্যুটিকে শিকার বানাতে আমাদের রাজনৈতিক শক্তির ভূমিকাটিও বা কম কিসে?

প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চয়ই বাঞ্জী (বন্ধ্যা) গাভীর গল্পটি জানেন। এক গরিব দিনমজুরের একটি গাভী ছিল। প্রতিবারই গাভীটি উতলা হলে, দিনমজুর সেটিকে শক্ত সামর্থ্য এক ষাঁড়ের কাছে নিয়ে যেতো। ত্রিশ দিন হাড় ভাঙা খাঁটুনি খেটে, দিনমজুর মাসে দশ টাকা জমাতে পারতেন। প্রতি মাসে ষাঁড় মালিকের হাতে দশ টাকা তুলে দিয়ে হতদরিদ্র দিনমজুর সাময়িক তৃপ্তি নিয়ে গাভীটি নিয়ে ঘরে ফিরতেন। আশায় দিন গুনতেন, এবার বুঝি তার পোষা প্রাণীটি সন্তান সম্ভবা হবে! মাস শেষে গাভিটি আবারো উতলা হতো।

এভাবে মাস যায়, বছর যায়। গাভিটি আর বাছুর সম্ভাবনা হয় না। অন্যদিকে ষাঁড় মালিক, নিঃস্ব দিনমজুরের অর্থে দিনে দিনে ফুলে ফেঁপে উঠে। ত্যক্তবিরক্ত দিনমজুর একদিন গাভীটিকে নামমাত্র মূল্যে ষাঁড় মালিকের হাতে তুলে দেয়। মনে মনে ভাবে এবার গাভী যাবে কোথায়? এভাবে গরিব দিনমজুর তার মনের জ্বালা মেটায়, আর ষাঁড় মালিক স্বল্পমূল্যে গাভী পেয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে!! অবস্থা দৃষ্টি মনে হচ্ছে, আমাদের গণতন্ত্র এখন ষাঁড় মালিকের হাতেই বন্দি হতে চলেছে!!

নাইজেরিয়া পৃথিবীর বারোতম তেল উৎপাদনকারী দেশ। খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ এ দেশটির অর্ধেকের বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাস করে। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৮ কোটি ৭০ লাখ মানুষের দৈনন্দিন আয় ১.৯০ ডলারের নিচে। মাদক, মানি লন্ডারিং এ পৃথিবীর শীর্ষতম স্থানে তাদের অবস্থান। উত্তর আমেরিকার মানুষ নাইজেরিয়ার নাম শুনলেই তাদের দৃশ্যপটে একদিকে ভেসে ওঠে মাদক, চোরা কারবারি, অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ী আর মানি লন্ডারিংয়ের দৃশ্যপট আর অন্যদিকে ভুখানাঙা কোটি কোটি মানুষের জীবন চিত্র।

দুর্নীতি, দুঃশাসন, মাদক, চোরাচালানে প্রজা থেকে রাজা সবার সংশ্লিষ্টতাই প্রমাণিত। পশ্চিমা দেশের মানুষ নাইজেরিয়ার নাম শুনলেই তাদের অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায়, একটি চরম নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ভেসে ওঠে। এই নাইজেরিয়ার জন্য গেল বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি স্বতন্ত্র ভিসা পলিসি করেছে। সময়ের পরিক্রমায় এ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, নাইজেরিয়ার মতো আমাদেরকেও একটি ভিসা পলিসি উপহার দিয়েছে!!

যুক্তরাষ্ট্রের উপহার ‘ভিসা পলিসি’ নিয়ে আমাদের দেশে যেন আনন্দের সীমা নেই। শাসক দল বলছে, এবার মাথা ন্যাড়া করে বিরোধীদের নির্বাচনে আসতে হবে। বিরোধীরা বলছে, শাসক দলের নেতা, সরকারের আমলারা এখন বেজায় বেকায়দায়! গণতান্ত্রিক শুদ্ধাচার চালু না করে শাসকরা এখন যাবে কোথায়? তাদের খুশির বন্যা দেখলে মনে হয়, পরীক্ষিত কোন বন্ধু যেন তাদের কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্রকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে!! এঁরা একবারও ভাবে না, মার্কিনীদের চোখে আমরা এখন নাইজেরিয়ার কাতারে।

তলাবিহীন ঝুড়ি খ্যাত দেশটি যখন সসম্মানে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে, তথাকথিত ভিসা নীতি আরোপ করে দেশটিকে নিয়ে কি বীভৎস খেলায় মেতে উঠেছে বিশ্ব মোড়লের দল!! আর এ খেলায় স্ট্রাইকারের ভূমিকা নিয়ে মাঠে নেমেছে, দেশপ্রেমিকের ছদ্মবেশী আমার প্রিয় দেশের রাজনীতিকরা। জাতিসংঘ বাহিনীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিষিদ্ধ করার দাবি সংবলিত কংগ্রেসমেনদের চিঠির ড্রাফট নাকি তৈরি হয়, আমার দেশের রাজধানী ঢাকায়!! এ কেমন আত্মহরণের পথে এগিয়ে যাচ্ছে আমার দেশের রাজনীতি?

গণতান্ত্রিক পদ্ধতি চালু থাকলেও, আমার দেশের প্রধান চাইলে আইনের পরিবর্তন করতে সময় লাগে না। পশ্চিমের চিত্রটি এক্ষেত্রে বড়ই নিষ্ঠুর। ২০২১ একুশ সালের ডিসেম্বরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অজুহাতে র্যাবের ডিজিসহ সাত কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্ট ও পররাষ্ট্র দপ্তর। গত দেড় বছরে আবেদন নিবেদন কম হয়নি, কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারে ন্যূনতম কোনো লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়নি।

২০১৩ সালে গার্মেন্টস শিল্পে যথোপযুক্ত কাজের পরিবেশ না থাকার অজুহাতে বাংলাদেশের জন্য জিএসপি সুবিধা বন্ধ করে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত এক দশকে বাংলাদেশের শিল্প পরিবেশে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে পরিবেশ সম্মত শিল্প কল-কারখানার অনেকগুলো এখন বাংলাদেশে। জিএসপি সুবিধা পুনর্বহালে শাসক সরকারের পক্ষ থেকে দেন দরবারও কম হয়নি, কিন্তু অগ্রগতি এখনো শূন্যের কৌটায়! আর ‘এ’ ভিসা নীতির নিষ্পেষণ যে কত যুগ চলবে বিধাতাই তা ভালো জানেন!

বন্ধুত্ব, রাগ-অনুরাগ, ভালোবাসার কোনো কিছুই পশ্চিমা দেশের আইন কানুন, রীতিনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কানাডার সরকারপ্রধান জাস্টিন ট্রুডো আর তার পরিবারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কটি ঐতিহাসিক। শেখ হাসিনার সঙ্গে ট্রুডোর অমলিন উষ্ণ সম্পর্কের কথা তো কারো অজানা নয়। তবু বঙ্গবন্ধুর খুনি নূর চৌধুরী কে ফিরিয়ে নিতে দেড় যুগের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলাফল তো শূন্য।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে নেওয়ার আবেদন নিবেদনেরও কোনো অগ্রগতি নেই। এর অন্তরালে রয়েছে আইনের কঠিন বেড়াজাল। শাসক দলের সরকার প্রধান চাইলেও, আইনের কঠিন বেড়াজাল টপকিয়ে বেরিয়ে আসার সুযোগ সেখানে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি নিয়ে আজ যারা চরম আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন, এদের সবাই যে একদিন ভিসা নীতির অক্টোপাসে হা হুতাশে নিমজ্জিত হবেন, তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের প্রধানসহ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, আর স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের বক্তব্য বিবৃতির সার সংক্ষেপ মোটেও ভিসা নীতিটির পূর্ণাঙ্গ রূপ নয়। কীভাবে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা হবে, এর কোনো ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ তাতে নেই। তবুও এ যাবত প্রকাশিত সংশ্লিষ্টদের মতামতের প্রেক্ষিতে ধরে নেওয়া যায়, যুক্তরাষ্ট্র গমনে ইচ্ছুক রাষ্ট্রের যে কোনো নাগরিক এই ভিসা নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। আজ এ নিয়ে যাদের মাঝে আনন্দ উন্মাদনা, খাল কেটে এঁরা, কত ভয়ংকর কুমির দেশে এনেছেন, সময়ই তা বলে দেবে!

স্বৈরাচারকে হটিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশের জনগণকে কতই না মূল্য দিতে হয়েছে। জেল, জুলুম, হুলিয়ার পাশাপাশি এদেশের ছাত্র/জনতা জীবন দিয়ে একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার পরিবেশ তৈরি করেছিল। ১৯৯০ সালে ১৫ দল ও সাত দলীয় ঐক্য জোট যৌথ রূপরেখা করে গণতন্ত্র নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেলুকাস, কি বিচিত্র আমাদের দেশ!! মাত্র পাঁচ বছরের মাথায় ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি, আমাদের গণতন্ত্রের প্রথম মৃত্যু ঘণ্টাটি বেজে যায়।

সময়ের পরিক্রমায় রাজনীতিকরাও আজকাল নির্বাচনে ভয় পায়, তাইতো চারদিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার হিরিক পড়ে যায়। এ যেন গণতন্ত্রের নামে এক তামাশা তন্ত্র!! দুটি রাজনৈতিক দলের এই তামাশাতন্ত্রের ফলাফল কি হবে সময়ই তা বলে দেবে। জাতি চায়, তামাশাবাজি বন্ধ হোক। জনতার রায়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সমৃদ্ধ, সুদৃঢ় নেতৃত্বে রাজনীতির নির্লজ্জ উপহার ‘ভিসা নীতি’র মতো কলঙ্ক থেকে জাতির মুক্তির সুগম হোক।

লেখক: কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]