মিশরের রহস্যময় রাজধানী ম্যামফিসের ধ্বংসাবশেষ

প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে এক রাজা পুরো মিশরকে একত্রিত করে একটি নগর রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন। দক্ষিণ মিশরের ম্যামফিস ছিল এর রাজধানী। এভাবেই দেশটিতে রাজবংশের সূচনা হয়েছিল। অর্থাৎ মিশরের রাজবংশের উদ্ভবের সঙ্গে ম্যামফিস শহরটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
পুরোনো রাজবংশের আমলে (২৬৪৯ থেকে ২৫৭৫ খ্রিস্টপূর্ব) ম্যামফিস আর থিবস ছিল প্রাচীন মিশরের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বাণিজ্যিক এবং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্রাচীন মিশরীয় ফারাওদের দীর্ঘকালীন ইতিহাসের বেশিরভাগ সময় ম্যামফিসই ছিল প্রাচীন মিশরের প্রশাসনিক কেন্দ্র। কাজেই প্রাচীন রাজবংশগুলো আরাধ্য দেবতার উপাসনালয় ও সমাধিসৌধ এখানেই নির্মাণ করেছিল।
আজ আপনাদের দেখাবো সেই ঐতিহাসিক রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ
আধুনিক মিশরের রাজধানী কায়রো শহরের ১৫ কিমি দক্ষিণে নীলনদের তীরে এর অবস্থান। খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার বছরেরও আগে এই নগরী গড়ে উঠেছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে ম্যামফিস সমৃদ্ধ হয়ে উঠে খ্রিস্টপূর্ব তিন হাজার সালের দিকে, ফারাও রাজবংশের সূচনালগ্নে। ওই সময় এই নগরীতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বসবাস করতো।
পরে মিশরের রাজধানী থিবসে চলে গেলেও ম্যামফিসের গুরুত্ব কমেনি। এখানে আছে মিশরের সবচেয়ে প্রাচীন পিরামিড সাকারা বা স্টেপ পিরামিড। গত কয়দিন আগে ঘুরতে গিয়েছিলাম সেই প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ দেখতে।
ভিসা কার্ডের মাধ্যমে ১০০ মিশরীয় পাউন্ডের টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা দলবেঁধে এসেছে বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতার দেশটির রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ দেখতে।
ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয় ইব্রাহিম নোফাল নামের বিশাল দেহী একজন মিশরীর সঙ্গে। কথা প্রসঙ্গে নোফাল বলেন, আমার পূর্ব পুরুষেরা ফারাও ছিল, আমি রামসিস দ্বিতীয় (ফেরাউন) এর বর্তমান প্রজন্ম। আমি এখানেই থাকি, আমার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যুক্তরাষ্ট্রে ও যুক্তরাজ্যে বসবাস করে। এই যে ভাস্কর্যটা দেখছেন, সেটিও আমার পূর্ব পুরুষের। এটার উজন ৮০ টন। এই স্পিংস ভাস্কর্য বিশ্বে মাত্র দুটি আছে। একটি দ্য গ্রেট পিরামিডের সামনে আরেকটা এখানে। এটা আলা-বাস্টারের তৈরি।
ম্যামফিস নগরের প্রধান দেবতা ছিল ‘তাহ্’। তার স্ত্রী সেকমেত এবং ছেলে নেফাত-টম ও তাহের মতো পূজিত হতেন। দেবতা তাহের পরিচিত প্রতিকৃতি হলো- দাড়িওয়ালা ও মাথায় করোটির টুপি, হাতে রাজদণ্ড এবং জীবনের প্রতীকরূপে ‘আনখ’ এবং স্থায়ীত্বের চিহ্নের প্রতীক। দেবতা ‘তাহ’ দক্ষ কারিগর এবং স্থপতিদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
ফারাও দ্বিতীয় রামেসেস (প্রাচীন মিশরের এক বিখ্যাত ফারাও) এর শরীরও নাকি তিনিই খোদিত করেছিলেন। ইজিপ্ট নামটি উৎপত্তির ক্ষেত্রে ম্যামফিস শহর চমৎকার গুরুত্ব বহন করে। কারণ ম্যামফিসের পুরোনো নাম ছিল ‘‘Hikuptah’’। এর মানে: ‘তাহ্ -এর আত্মার ভবন’। শব্দটিকে রোমানরা বলত: ‘‘Aegyptvs’’।
এই শব্দটি থেকেই আধুনিক ইংরেজিতে Egypt শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে। দেবতা তাহের উপাসনালয়টিই ছিল প্রাচীন ম্যামফিস নগরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাঠামো । এর নামও ‘‘Hikuptah’’ (তাহ্ এর আত্মার ভবন) অবশ্য আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবে এককালে এটিই ছিল মিশরের সবচেয়ে বড় স্থাপত্য।
ম্যামফিস নগরের পুরোহিতরা তাহ্ কেই মনে করত সর্বেসর্বা, পৃথিবীর স্রষ্টা, দেবতাদের জনক, পৃথিবীর সব প্রাণির জীবনীশক্তির উৎস এবং প্রারম্ভের জনক (মানে যার দ্বারা সব কিছুর সূচনা হয়েছিল)। আস্তে আস্তে দেবতা তাহের প্রভাব ম্যামফিস থেকে সারা মিশরে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো। মিশরের এক একজন দেবতার উদ্ভব এবং এর বিস্তৃতি, সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠা মূলত মিশরের রাজনৈতিক উত্থান পতনের ওপর নির্ভর করতো। তেমনি দেবতা তাহ্ মিশরের মধ্যে সর্বশক্তিমান হয়ে ওঠে ম্যামফিসে প্রাচীন রাজবংশের উদ্ভবের ফলে।
রোমান যুগের শুরুতে ও ম্যামফিস মিশরের গুরুত্বপূর্ণ প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে বিবেচিত হত। খ্রিস্টধর্মের উত্থানের পর প্রাচীন শহরটির গুরুতর কমতে শুরু করে এবং সেই বিশ্বাসের উৎসাহীরা অবশিষ্ট পৌত্তলিক মন্দিরগুলোকে বিকৃত ও ধ্বংস করে দিয়েছিল।
৬৪০ খ্রিস্টাব্দে মুসলিমদের মিশর বিজয়ের সময় আরব সেনাপতি আমর ইবন আল-আস প্রাচীন এই নগরী দখল করে নেয় ও ম্যামফিসকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করে।
এমআরএম/জেআইএম