বিষয়টা বিয়ের আগে ভাবা উচিত ছিল

প্রবাস ডেস্ক
প্রবাস ডেস্ক প্রবাস ডেস্ক যুক্তরাষ্ট্র
প্রকাশিত: ০১:১৬ পিএম, ০২ ডিসেম্বর ২০২৩
ছবি- শারমিন খান বাঁধন

অমিয় দাশ, যুক্তরাষ্ট্র

আমাদের সমাজে ঘটা করে একটা বিয়েতে অনেক পরিকল্পনা, আয়োজন, বিয়ের চিঠি ছাপানোর থেকে শুরু করে ফুলের মালা, গায়ে হলুদ, বরযাত্রীদের যানবাহন, বউভাত, ইত্যাদি অনেক বিষয় জড়িত। এখানে বিষয়টা ঝপ করে ব্যাঙ ধরার মতো হয়নি। সজীব আর কি কি বলেছে তোমাকে?’

‘বলেছে সে আমার সাথে ফিরে আসতে চায়, আমাকেই সে বিয়ে করবে’।
‘বাঃ বাঃ বাঃ। সে তো সেটা চাইবেই। কিন্তু বিষয়টা ওর বিয়ের আগে ভাবা উচিত ছিল না?’
‘সে হোক, আমি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি’।

‘ওদের ডিভোর্সের দরখাস্ত বা মামলার দরখাস্ত কখনো দেখেছ?’
মাথা নাড়িয়ে বাধঁন না সূচক জবাব দিলো।
‘তাহলে তুমি কি ওর সাথে দেখা করো?’

‘হ্যাঁ, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর প্রায়ই দেখা করতে আসতো। মামলা শেষ হলেই ও আমাকে বিয়ে করবে বলেছে’।
‘সেটা কতদিন লাগবে?’

‘তা’তো জানি না। বলেছে শিগগিরই হবে। তাও সে প্রায় দেড় বছর হয়ে গেলো। এসব নিয়ে প্রশ্ন করলে সজীব খুব রেগে যায় আর খুব খারাপ ব্যবহার করে। অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করে।

‘শেষ কবে দেখা হয়েছিল?’
‘এক মাস আগে। তারপর আমাকে ব্লক করে রেখেছে। তারপরেও আমি ওকে প্রতিদিন ফোন করার চেষ্টা করি। সেদিন হঠাৎ ওকে ফোনে পেয়েছিলাম’।
‘কি কথা হলো?’
‘আমাকে অনেক গালিগালাজ করলো। ওকে ফোন করতে নিষেধ করলো। আর বললো আমার মূল্য তার কাছে ৫ টাকার সমান’।

অংশু খানিক চিন্তা করলো। সে অনেক দ্বিধা-দ্বন্দের মধ্যে আছে মনে হলো। ভ্রু কুঁচকে আবার ঘূর্ণীয়মান ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকলো। তার মাথার মাঝে অনেক পাজল বা ধাঁধা ছুটে লাফিয়ে ভিডিওগেমের মতো ছোটাছুটি করতে লাগলো। প্রতিটা পাজল খণ্ড তার আকৃতির বা ডিজাইনের সাথে মেলে এরকম আর একটা ডিজাইনকে খুঁজছে। একটা খন্ডের সাথে আর একটা খন্ডের মিল নেই। কিন্তু তারা তাদের সাথে খাপ খায় এরকম অন্য খন্ড খুঁজছে।

যদি না মেলে, তবে একে অন্যকে চুম্বকের বিকর্ষণ এর মতো এক খণ্ড অন্য খণ্ডের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে বিপরীত দিকে সরে যাচ্ছে। অংশু যখন প্রাত্যাহিক জীবনের বিষয়গুলোর জটলা ছাড়াতে পারে না, তখন তার মাথার মধ্যে এ রকম হয়। মাথার মধ্যে অনেক রং বেরঙের আকৃতি, নম্বর, ইত্যাদি উড়ে বেড়ায়। এসব আকৃতি উড়ে বেড়ানোর সময় যদি একটা আকৃতি আর একটার সাথে ঠোকর খায়, তবে সে ভিডিও গেমের মতো ‘টিটিং’ একটা শব্দ মাথার মাঝে অনুভব করে বা শুনতে পায়’।

অনেক দিন আগে অংশু একবার তার মেডিকেল কলেজে পড়ুয়া অত্যাধিক স্মার্ট একটা বন্ধুকে জিজ্ঞেস করেছিল তার এই বিষয়টা কেন হয়।

বন্ধুটি বলেছিল যে এই বিষয়টা মানুষের অবচেতন মনের একটি অধ্যায়। যেখানে সে জেগেই তন্দ্রার মাঝে চলে যায়। এর নাম সাইনেসথেসিস। সাইনেসথেসিস হলো মানুষের একটি অবচেতন মনের ক্ষমতা বা অবস্থা যখন সে স্বাদ, গন্ধ, দৃশ্যমান রঙিন ইত্যাদি মিশ্রিত করে অদ্ভুত সুন্দর একটি দৃশ্য দেখে ও অনুভব করে। বন্ধুটি আরো বলেছিল যে পৃথিবীর প্রায় ৭ শতাংশ মানুষের এমন ক্ষমতা থাকে।অংশুর মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগে যে এটা কি ক্ষমতা নাকি অক্ষমতা কে যানে? সমাজে সাধারণ কে সাধারণ দেখতে না পারা এক ধরনের অক্ষমতা বৈকী।

‘হ্যালো আছেন?’
মুখের সামনে বাঁধনের হাত নাড়ানো আর ডাক শুনে অংশুর মাথার মধ্যের ডিজাইন আর রং বেরংয়ের নকশাগুলি মুহূর্তে পালিয়ে গেলো।

চতুর্থ পর্ব পড়ুন এখানে 

‘ও হ্যাঁ আছি’। বলে মুচকি হাস হেসে বলল, ‘হ্যাঁ শুনছি বলো’।
বলেই অংশু বাঁধনের দিকে তাকিয়ে থাকলো।
‘আমি বলছি নাতো! আরে আমি শুনছিলাম। আমার মূল্য ৫ টাকা কীভাবে হলো সেইটা বলছিলেন’।
‘Oh yes, that’s right’.

বাঁধন লক্ষ্য করেছে অংশু সিরিয়াস কিছু বললে ঠুস্ ঠাস্ আমেরিকানদের মতো করে ইংরেজী বলে। বাঙালিরা সাধারণতঃ ব্রিটিশ ইংরেজী শুনতে অভ্যস্ত। অংশু বিষয়টা সামলে নিয়ে বলে, ‘তোমাকে একটা দিক বলা হয়নি। কারণ, ঐ দিকটি আমি জানতাম না। এই মাত্র জানলাম’।

বিস্ময়ে বাঁধন জিজ্ঞেস করে, ‘কোন দিকটি?’
‘ক্রেতা বা দামদরকারীর দিকটি। এখানে সজীব হলো দামদরকারী। দেখো, পৃথিবীর প্রতিটি জিনিসের একটি মূল্য আছে। সেই মূল্য স্থান, কাল, পাত্র ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। আগেও বলেছি তোমাকে। তবে দামদরকারী ও জিনিস এ দুটোরই গুরুত্ব আছে। কারো গুরুত্ব কম বা বেশি নয়’।

‘কি রকম?’’
‘জিনিসের যেমন উপযোগিতা আছে, তেমনি জিনিসের দামকারীরও যোগ্যতার বিচার আছে। এই যোগ্যতা হলো শিক্ষা, সামাজিক অবস্থান, মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি, সামাজিক মূল্যবোধ, সামাজিক অবস্থান, জ্ঞান, আর অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা বা আর্থিক ক্ষমতা’।

‘সজীবতো এখন বেশ আয় করে, তাহলে তার ক্রয়ক্ষমতা কি মাত্র ৫ টাকা?’ অভিযোগের সুরে বাধঁন অংশুকে প্রশ্ন করে।
‘বিষয়টার সে রকম না’।
‘তাহলে কি’?
‘বিষয়টা বলতে একটু দ্বিধা হচ্ছে’।
‘আচ্ছা বাবা, বলুনতো। আমি কিছু মনে করবো না’।

অংশু সোজা হয়ে বসলো। ঘাড় সোজা করে বাঁধনের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বললো, ‘জানো, আমেরিকানদের মধ্যে একটি প্রচলিত উক্তি আছে, ‘‘Someone’s trash is someone else’s treasure’’ অর্থাৎ, এক ব্যক্তির কাছে যা অকেজো, মূল্যহীন তা অন্যের কাছে মূল্যবান’।

‘অনুবাদ করতে হবে না বুঝতে পেরেছি’।
‘আবার এমন ও হতে পারে যে তুমি বেশ সহজলভ্য। এখানে তোমার মুল্য ও সজীবের sacrifice ৫ টাকার সমতুল্য। সেক্ষেত্রে ৫ টাকার সমান অর্ঘ্য বা স্যাক্রিফাইস এ তোমাকে কেনা বা পাওয়া যাবে’।
বলেই বিষয়টাকে হালকা করার জন্য অংশু হেসে ফেলল।

‘কি বলেন? ৫ টাকা কোনো অর্ঘ্য হলো? আজকাল মানুষ ভিখারিকেও ৫ টাকার বেশী ভিক্ষা দেয়’। বলেই রেগে এদিক ওদিকে তাকালো।

‘আচ্ছা বিষয়টা তাহলে অন্যভাবে বলি। Say for example, if we turn the table, আমরা যদি টেবিলটা ঘুরিয়ে দেই তাহলে বিষয়টা কি দাঁড়াবে?’
‘মানে কি?’

‘মানে হলো, মনে করো, তোমার জায়গায় সজীব আর সজীবের যায়গায় তোমাকে বসালে কেমন হবে?’
‘কিন্তু আমি তো ওকে অনেক লভ করি। ওতো আমার এই পরিমাণ লভ কখনই করতে পারবে না’।

বাঁধন অবুঝের মতো বাধ সাধলো। অংশু বিষয়টা কীভাবে এই অসীম প্রেমে পড়া মেয়েটাকে বোঝাবে তার কূলকিনারা পেলো না। তবুও বলল, ‘আচ্ছা তোমার কথা বাদ দিলাম। মনে করো, একটি শিক্ষিত সাধারণের চেয়ে সুন্দরী অবিবাহিতা মেয়ে তোমার সবচেয়ে ভালো বান্ধবী। তোমার এই বেস্টির কাছে একটা ছেলে প্রেমের প্রস্তাব নিয়ে এলো।

ছেলেটা একবার বিয়ে করেছিল অন্য একটি অবিবাহিত মেয়েকে। আপাততঃ ছাড়াছাড়ি হয়েছে। সত্যি হোক বা মিথ্যে হোক ঐ স্ত্রী শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের অভিযোগ করেছিল তার স্বামীর বিরুদ্ধে। এই অভিযোগে ছেলেটার জেল হয়েছিল। এখন জামিনে মুক্ত আছে। তবে যখন তখন সে খোয়ারে ঢুকে যেতে পারে। ছেলেটার তেমন অর্থবিত্তও নেই।

তোমার বান্ধবী ছেলেটাকে কি বলবে? প্রেমের প্রস্তাব গ্রহণ করবে নাকি প্রত্যাখ্যান করবে? মেয়েটার কাছে ঐ জেল ফেরত ছেলেটার এক্সচেঞ্জ ভ্যালু বা, বিনিময় মূল্য কত? সোজা কথায়, ওই অবিবাহিতা সুন্দরী বান্ধবীর কাছে ঐ বিবাহিত জেল ফেরত বিচারাধীন ছেলেটির মূল্য কত?’

‘দ্যাখেন জেল ফেরা সব আসামিরাই খারাপ না’।
বলেই বাধঁন খুব গম্ভীর হয়ে গেলো ওর মুখ চোখের ওপর একটা মেঘলা ছাঁয়া ছাপিয়ে গেলো। আবার বললো,’ ‘প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে দোষী বলা যায় না’।

চলবে...

এমআরএম/এমএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]