বিসর্গতে দুঃখ

বর্ণমালায় জীবনের পাঠ

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ১২:৩৭ পিএম, ১২ ডিসেম্বর ২০২৩

প্রথমেই এই বইয়ের বর্ণমালার শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়া যাক। শুরুতেই আছে স্বরবর্ণগুলো দিয়ে শব্দগঠন: অ-তে অন্যমনস্কতা, আ-তে আকাশ, ই-তে ইঁদুর, ঈ-তে ঈশ্বর, উ-তে উপর, ঊ-তে ঊন, ঋ-তে ঋষি, এ-তে একাকিত্ব, ঐ-তে ঐতিহ্য, ও-ওলাওঠা, ঔ-তে ঔষধ।

এরপর একে একে আছে ব্যঞ্জনবর্ণ দিয়ে শব্দগঠন: ক-তে কম্যুনিজম, খ-তে খাম, গ-তে গান, ঘ-তে ঘুম, ঙ-তে ব্যাঙ, চ-তে চাঁদ, ছ-তে ছলনা, জ-তে জীবন, ঝ-তে ঝড়, ঞ-তে মিঞ, ট-তে ট্রেন, ঠ-তে ঠিকানা, ড-তে ডায়েরি, ঢ-তে ঢাকা, ণ-তে বাণিজ্য, ত-তত্ত্ব, থ-তে থামা, দ-তে দ্বিধাদ্বন্দ্ব, ধ-তে ধ্যান, ন-তে নীরবতা, প-তে পুরুষ, ফ-তে ফসল, ব-তে বন্ধুত্ব, ভ-তে ভালোবাসা, ম-তে মুজিবুর, মুক্তিযুদ্ধ, শ-তে শৈশব, ষ-তে, ষড়যন্ত্র, স-তে স্তন, য-তে যুক্তি, র-তে রাজনীতি, ল-তে লেখালেখি, হ-তে হিসাব, ঢ়-আষাঢ়, য়-তে আয়না, ৎ-তে সৎ, ং-তে বিংশ শতাব্দী,ঃ-তে দুঃখ।

শব্দগুলো কি একটু ভাবনার মধ্যে ফেলে দিচ্ছে আপনাকে। এই বই পাঠ করা শেষ করে আপনিও নতুন করে জীবন নিয়ে ভাবতে শুরু করবেন। আপাতদৃষ্টিতে শব্দগুলোর একটির সঙ্গে অন্যটির কোন মিল না থাকলেও লেখকের বর্ণনাশৈলিতে মনে হয়েছে বর্ণগুলোর জন্য এগুলোই সবচেয়ে উপযুক্ত শব্দ। শফিক নামের একজন বেকার যুবকের জবানিতে বইটির গল্প এগিয়েছে।

শফিকের জীবনের অভিজ্ঞতা, প্রতিদিনের টানাপোড়েন যেন আমাদের প্রত্যেকের জীবনের প্রতিনিধিত্ব করেছে। শফিক হয়ে উঠেছে যেন বাংলাদেশের মানুষের প্রতিনিধি, বাংলাদেশের প্রতিনিধি। সবগুলো বর্ণ নিয়ে নিয়ে আলোচনা এই স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব হবে না। আমরা কিছু কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করবো। তবে পুরোপুরি স্বাদ নিতে হলে আপনাকে পড়তে হবে এই অনন্যা বইটি।

আমরা যা কিছু করি, যা কিছু বলি সবই তো জীবনের জন্য। তাই আমি জ-তে জীবন নিয়ে এখানে আলোচনা করবো। বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন- ‘এ জীবন লইয়া কী করিব, এ জীবন লইয়া কী করিতে হয়?’ জীবন আসলে কি? জীবন কি মৃত্যুর নিকটবর্তী হবার ঘটনাক্রমিক অভিজ্ঞতা মাত্র? না কি জীবন এক কাপ চায়ের মতো, একটু একটু করে চুমুক দিয়ে নিতে হবে এর স্বাদ। জীবনের মূল সত্যটাকে আমরা সারাজীবন জানবার চেষ্টা করে যাবো, কিন্তু কখনোই জীবনের মূল সত্য জানতে পারবো না, এটাই হলো জীবনের মূল সত্য।

আবার কেউ কেউ বলেন, নিজের ব্যক্তিগত জীবনকে অগণিত ভাগ্যাহত জীবনের কল্যাণে নিয়োজিত করাই জীবনের লক্ষ্য। আবার কেউ কেউ বলেন- ‘জীবন একটি বুঝিবার বিষয়, কিন্তু বুঝিল সে কি?’

জীবনকে উপলব্ধি করতে হলে থ-তে থামতে জানা জরুরি। প্রকৃতি থামতে জানে। এক-একটা গাছ এক-একটা উচ্চতায় এসে থেমে যায়, ঝড় থামে। কিন্তু মানুষ থামতে জানে না। তার আকাঙ্ক্ষার কোন সীমা নেই। প্রগতির, উন্নয়নের, জ্ঞানবিজ্ঞানের সীমাহীন আকাঙ্ক্ষা। একটা কোথাও থামতে পারলে জীবন কি সুস্থির হতো? মিছিলকে ভালো করে দেখতে হলে থামতে হয়, মিছিলের বাইরে এসে দাঁড়াতে হয়।

রুশো একবার লিখেছিলেন, ‘আমার তো মনে হচ্ছে মানুষের যত নষ্টের গোড়া এই শিল্প, সাহিত্য, আর বিজ্ঞান। জন্মসূত্রে মানুষ সরল, নিষ্পাপ কিন্তু যতই তার জ্ঞান বাড়ে ততই তার চরিত্র প্যাঁচালো হয়ে ওঠে। শিল্প তাকে করে বিলাসী, বিজ্ঞান তার বিবেকবোধকে করে দেয় দুর্বল। সাহিত্য তাকে শেখায় সহজ কথা ঘোরালো করে বলতে। সভ্যতার কাজ হলো মানুষের প্রয়োজন বৈচিত্র্য বাড়িয়ে স্বল্পে তার যে তৃপ্তি তাকে নষ্ট করা। সুতরাং সভ্যতার চাকা থামিয়ে দেয়া উচিৎ।’

মানুষের জীবনে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত ভাষা কোনটি। লেখকের ভাষায় ন-তে নীরবতা। পৃথিবীর সর্বাধিক ব্যবহৃত ভাষা ইংরেজি, আরবি, স্প্যানিশ নয় বরং নীরবতা এবং এ এ ভাষা সর্বাধিক ব্যবহার করে নারীরা। শুষ্ক, নিরর্থক, মিথ্যা কথামালার মরুভূমিতে নীরবতা যেন মরুদ্যান। নীরবতা স্বস্তির শীতলতা আনে। নীরব থাকলে চারপাশটা ভালো করে দেখা যায়, শোনা যায়। নীরবতা অভিজ্ঞতা বাড়ায়। আটটি ভাষায় কথা বলতে পৰ একজন বলেছিল, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষা হলো নীরবতা। কিন্তু নীরবতাও দুঃসহ হতে পারে। ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত মানুষকে শেষ দিন দেখতে গেলে যে নীরবতা নেমে আসে তা গুমোট, দুঃসহ, ভারী।

ইতিহাসে কি করে ঈ-তে ঈশ্বর কিভাবে ফায়দা লোটার হাতিয়ার হয়েছে সেই আলোচনাও এসেছে এই বইতে। সব ধর্মেই ঈশ্বর ভাবনার সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে একটা শয়তান তত্ত্ব। ব্যাপারটা এমন যে, জগতের সব ভালোর কৃতিত্ব ঈশ্বরের আর যা কিছু মন্দ তার দায় শয়তানের। আবার প্রশ্ন তোলা হয়েছে কি করে ধীমান বুদ্ধ ঈশ্বর বিষয়ে চুপ রইলেন। অন্যদিকে লালন প্রশ্ন করছেন -

‘আমি ভেবে পাইনে দিশে
সব জিনিস যে পয়দা করলো
সে পয়দা হইলো কিসে?’

এই বইতে এসেছে বাংলাদেশের ইতিহাস প্রসঙ্গও। ম-তে নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নেতা মুজিবুর আর নানামুখী মাত্রা নিয়ে বিরল মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে আলাপ করা হয়েছে। এই মাটির উপরে ঘটে যাওয়া হাজার বছরের আশ্চর্যতম ঘটনা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। আর যুদ্ধের অন্যতম কারিগর ছিলেন গ্রামীণ গৃহস্থের সন্তান মুজিবুর রহমান। এরই পাশাপাশি এসেছে ষ-তে ষড়যন্ত্র'র প্রসঙ্গও। আমাদের দেশের ইতিহাসের সাথে এই শব্দটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন স্বাধীন বাংলার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। বাংলাদেশ নাম এক নতুন ভূখন্ডে ১৯৭৫ সালের ১২ই আগস্ট সেনানিবাসে হয়েছিল আরেকটি ষড়যন্ত্র। পরের বছর জুলাইয়ের ২০ তারিখ একজন পঙ্গু কর্নেলকে জানানো হয় পরদিন তার ফাঁসি। পঙ্গু সেই কর্নেল আদালতে তার জবানবন্দিতে স্মরণ করেছিলেন আড়াইশো বছর আগের পলাশীর ষড়যন্ত্রের কথা।

ঢ-তে আছে জাদুর শহর ঢাকা। স্থপতি লুই কান নতুন ঢাকার নকশা করার সময় বলেছিলেন, 'আমি এমন এক শহরের পরিকল্পনা করতে চাই, যে শহরে হাঁটতে হাঁটতে তরুণেরা তাদের ভবিষ্যৎ স্বপ্নগুলো গুছিয়ে নিতে পারবে।' কিন্তু এখনকার রূঢ় বাস্তবতা হচ্ছে ঢাকা ক্রমশ কেবলই স্বপ্ন এলোমেলো করে দেবার জনপদে পরিণত হচ্ছে। শ-তে শৈশব। মানুষের সারা জীবনকে এক পাল্লায় আর শৈশবকে আরেক পাল্লায় রাখলে শৈশবের পাল্লাই ভারী হয়ে যায়। লোকে শৈশবকে বয়ে বেড়ায় আজীবন। কিন্তু ঢাকা শহরের ছেলেমেয়েগুলো কোনোদিন ঘসফড়িং দেখেনি, জোনাকি দেখেনি, ঝড়ে দুলতে থাকা বাবুই পাখির বাসা দেখেনি। তাদের পিঠে ঝোলানো বিকট স্কুলব্যাগে থাকে গাদা গাদা বই, আছে কার্টুন, ভিডিও গেমস কিন্তু তাদের যেন শৈশব নেই।

ল-তে আছে লেখালেখি'র প্রসঙ্গও। অন্য কোন পেশার মানুষকে তার কর্ম নিয়ে প্রশ্ন শুনতে না হলেও লেখকদেরকে হরহামেশাই শুনতে হয় লেখালেখি কেন করেন প্রশ্নটি। একবার এক লেখক বলেছিলেন, লেখালেখি করেন কারণ না লিখলে হাত ব্যাথা করে। লেখালেখি বিষয়টা আসলে রক্তের দোষ। ঃ-তে দুঃখ। দুঃখকে আমরা ডাকি না কিন্তু তবুও মেঘের মত দলবেঁধে দুঃখ আসে। আমরা সবাই দেখতে দেখতে জীবন পার করে দিচ্ছি। আমাদের জীবনে দিন হচ্ছে দিনের পুনরাবৃত্তি আর রাত রাতের।

এই বইয়ের আলোচনায় শহিদুল জহির লিখেছিলেন, 'শাহাদুজ্জামান যেন বাংলা ভাষায় মেটাফিকশন লিখেছেন।' আর শাহাদুজ্জামান লিখেছেন, 'মিলন কুন্ডেরার ব্যক্তিগত অভিধান থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি এই বই লিখতে উদ্যগী হয়েছিলেন। একে একটা বড়দের বর্ণমালা বইও বলা যেতে পারে।'

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]