একজন মায়াবতীর গল্প

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ১২:১০ পিএম, ১৩ মার্চ ২০২৪
লেখকের ভাগ্নি সেজুতি এবং সেমন্তি

আমার মায়েরা ছিলেন মোট এগারো বোন আর তিন ভাই। সেইসূত্রে আমার খালাদের আদরে আদরে বেড়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু বিবাহসূত্রে তারা বিভিন্ন জন বিভিন্ন জায়গায় অবস্থান করতেন। তাই আর তাদের আদর তেমন একটা পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তবে আমার ছোটবেলায় মায়েরা যখন সব বোন মিলে নানাবাড়িতে নায়রে যেতেন তখন সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হতো। আমি অবশ্য উনাদের সবাইকে চিনতামও না।

আমাদের গ্রামেই আমার মায়ের পরের বোনটার বিয়ে হয়েছিল। মা আমাকে প্রায়শই বিভিন্ন জিনিস আনতে উনাদের বাড়িতে পাঠাতেন। কিন্তু আমি লজ্জায় যেতে পারতাম না। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে ফিরে এসে বলতাম যে জিনিসটা উনাদের নেই। এমন না যে খালা আমাকে আদর করতেন না। খালা প্রচন্ড আদর করতেন এবং এখনও করেন। গতবছর দেশে গিয়ে উনাদের সাথে আবার দেখা হয়েছিল।

এরপর একটা সময় পড়াশোনার জন্য কুষ্টিয়া ছেড়ে ঢাকায় এসে বুয়েটের হলে বসবাস শুরু করলাম। এরপর চাকরিসূত্রে স্থায়ীভাবে ঢাকায় থাকা শুরু করলাম। তাই মা, খালা ডাকগুলো দেওয়ার মতো মানুষ খুঁজে পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব। সেই জায়গাগুলো পূরণ করলো বন্ধু-বান্ধবদের ভাই বোনের মেয়েরা। ছোট বাচ্চাগুলোকে দেখলেই আমার দুরন্ত শৈশবের কথা মনে পড়ে বিশেষ করে মেয়ে বাচ্চাগুলোকে মনে হয় ফুলের কুঁড়ি। তারা যখন একই রঙের স্কুলের পোশাক পরে স্কুলে যায় তখন আমার কাছে মনে হয় একঝাঁক পরী দলবেঁধে স্কুলে যাচ্ছে।

আমার বন্ধবান্ধবরা সবাই আমার কাছে নিজের পরিবারের সদস্যের মতো। তাই তাদের আত্মীয়-স্বজনও আমার নিজের আত্মীয়-স্বজনের মতো। বন্ধু-বান্ধবদের সাথে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় গেলে সবার আগে সেই বাড়ির শিশুদের সাথে আমার খাতির হয়ে যায়। হয়তোবা ওরা আমার আচার-আচরণে কথাবার্তায় ওদের সমকক্ষ কেউ মনে করে। এমনই একবার সাগর ভাইয়ের সাথে উনাদের এক বোনের বাসায় গিয়েছিলাম। সাগর ভাই আমার বন্ধু শিশিরের বড় ভাই। সেই সূত্রে আমাদের সবারই বড় ভাই হয়ে গিয়েছিলেন। এখনও তাই আছেন।

বিজ্ঞাপন

একজন মায়াবতীর গল্প সেজুতি সেমন্তিদের পরিবার

বাসাটা ছিল আজিমপুর কলোনিতে। বাসায় গিয়ে দেখি আপুর দুটো মেয়ে। কোনো ছেলে নেই। আমাদের পরিবারে আমরা তিন ভাই কোনো বোন নেই। তাই বরাবরই মেয়েরা আমাদের কাছে আদরণীয়। বাচ্চাদুটোর সাথে নিমেষেই খাতির হয়ে গেলো। বড়জন তখন মাধ্যমিকের ছাত্রী আর ছোটজন যতদূর মনে পড়ে তখনও স্কুলের আঙিনায় পা রাখেনি। এরপর ওদের দুবোনের সাথে চলল আমার গুটুর গুটুর ফুসুর ফুসুর অনেক গল্প। বড়জন (সেজুতি) একটু লাজুক প্রকৃতির কিন্তু সেই তুলনায় ছোটজন (সেমন্তি) অনেক চটপটে। তাদের সাথে কত যে গল্প হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। তবে এটুকু মনে আছে আসার আগে পর্যন্ত ছোটজনের সাথে আমার গল্প চলেছিল।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

সেদিনই আমি বড়জনের সাথে মা আর ছোটজনের সাথে খালা সম্পর্ক পাতিয়ে ফেললাম। একসময় বাংলাদেশে এমন পাতানো সম্পর্কের বিশাল কদর ছিল। আমার দাদির একজন পাতানো ভাই ছিলেন। উনি প্রায়শই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। আমার দাদিও নিয়মিত উনাদের ওখানে গিয়ে থাকতেন। বাড়িতে কোনোকিছু নিয়ে মনমালিন্য হলে সেই পাতানো ভাইয়ের বাসায় গিয়ে ডুব দিতেন। আমার কাছেও আমার এই মা খালার গুরুত্ব অপরিসীম। আমার মায়ের এখন বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের সংসার আলো করে এসেছে এক রাজকন্যা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে সবখবরই এখন হাতের মুঠোয়। যদিও আমার সাথে এখনও আমার নাতনীর অফিসিয়ালি দেখা হয়নি।

খালামণি না কি আমাকে প্রথম দেখে ভেবেছিল আমি কালো মেকাপ নিয়ে এসেছিলাম। সেই কথায় নাকি আপু আর দুলাভাইকে বলেছিল। সাগর ভাই খালামণির সাথে আমার একটা ছবি তুলেছিল। খালামণি আমাকে সেই ছবি পাঠালে নিজেকে অনেক তরুণ মনে হচ্ছিল। এরপর খালামণির সাথে আবার দেখা হয়েছিল বন্ধু শিশিরের বিয়েতে। তখন বুদ্ধি করে মা আর খালামণিকে আমার দুপাশে বসিয়ে ছবি তুলে রেখেছিলাম। আমি এখনও ঘুরেফিরে ছবিগুলো দেখি। আসলে সুখস্মৃতিগুলোই তো আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় সঞ্চয় এবং চালিকাশক্তি।

আমার মা এখন স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত তাই অন্তর্জালে সামান্য যে কথাবার্তা সেটা হয় খালামণির সাথেই। আমার সেই ছোট্ট খালামণি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। ছোটবেলায় দেখতে যেমন আদুরে ছিল এখনও তেমনি সুন্দরী আছে। খালামণির সাথে খন্ড খন্ড কত স্মৃতি। একবার খালামণি একটা দৈনিক পত্রিকার সাজগোজের ক্রোড়পত্রের জন্য মডেল হয়েছিল। বাচ্চাদের সাজগোজের সেই ছবিতে খালামণিকে কি সুন্দর লাগছিল। আমি তখন অনলাইন ভার্শন থেকে খালামণির ছবিগুলো সংরক্ষণ করে রেখেছিলাম। পরে কালের স্রোতে সেই ছবিগুলো হারিয়ে ফেলেছি।

আমি কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বিশাল ভক্ত অনেক কারণে। উনি বাংলাদেশের মানুষের মনস্তত্ব সবচেয়ে ভালো বুঝতেন বলেই আমার ধারণা। উনি আমাদের বই পড়া শিখিয়েছিলেন। উনি আমাদের সৌন্দর্যবোধও শিখিয়েছিলেন। উনার গল্পের সকল তরুণীই অসম্ভব সুন্দরী। এখন খালামণিকে দেখলে আমার তাই বেশি করে উনার কথা মনে পড়ে। আমার খালামণি প্রাকৃতিকভাবেই স্নিগ্ধ সুন্দর। মুখটার দিকে তাকালে মনে হয় কোন এক শান্ত নদীর দিকে চেয়ে আছি। আমি মাঝে মাঝে ভাবি উনি মনে হয় হিমু সিরিজের রূপা আমার খালামণিকে কল্পনা করেই লিখেছিলেন। যাইহোক আমি যদি কখনও উপন্যাস লিখি তবে আমার গল্পের নায়িকারা হবে আমার খালামণির মতো নিরহংকার সুন্দরী।

একজন মায়াবতীর গল্প সহপাঠিদের সাথে লেখকের ভাগ্নি সেমন্তি

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

অনেকদিন হয়ে গেলো ফেসবুক থেকে দূরে। সেই সাথে লেখালেখি থেকেও। একগাদা বই জমে গেছে। সেগুলো পড়ছি। তাই লিখে নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। খালামণির জন্মদিন সামনে আসাতে ভাবলাম আবার একটু লেখার চেষ্টা করা যাক। আমার খালামণি তার মায়ার জাদুতে পরিবারের সবাইকে যেমন বেঁধে রেখেছে ঠিক তেমনি বেঁধে রেখেছে সহপাঠিদের। আমি খালামণির চোখ দিয়ে নতুন প্রজন্মের ভাবনাকে দেখি। অনেকেই বলে থাকেন নতুন প্রজন্ম আদব কায়দা, পড়াশোনা কিছুই শিখছে না। কিন্তু আমি খালামণিদের বন্ধুদের দলটাকে দেখি আর আশান্বিত হই।

আমার খালামণি শতায়ু হোন। জন্মদিনে এমনটাই প্রত্যাশা। খালামণির মায়ার বাঁধনে একসময় পুরো বিশ্ব বাঁধা পরবে। এটাই আমার আশা। আমার খালামণি নিজগুণে আপন করে নিক তার চারপাশের সবকিছুই। তার মায়ার পরিধি দিনে দিনে বাড়তে থাকুক। যতটা মমতা নিয়ে সে তার চারপাশকে আপন করে নিবে তার চেয়ে বহুগুণ মায়া নিয়ে যেন তার চারপাশ তাকে আপন করে নেয়। এভাবে আমরা যদি সবাই সবাইকে আপন করে নিতে পারি তাহলে পুরো বিশ্বই একটা পরিবারের রূপ নেবে একসময়। বেঁচে থাকুক আমাদের মায়েরা, খালারা। আমার বেঁচে থাকি তাদের আদরে মায়ায়।

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

অনেকদিন হয়ে গেলো আমার মামণি এবং খালামণির সাথে দেখা নেই কিন্তু সেটা আমাদের সম্পর্কে কোনো দূরত্ব তৈরি করেনি। আসলে অকৃত্রিম সম্পর্কগুলো তো এমনই হয়। যেখানে কোনো চাওয়া পাওয়ার বিষয় থাকে না। থাকে শুধু বিনিসুতোর মায়ার বাঁধন। আর থাকে একে অপরের জন্য অন্তরের অন্তঃস্থলের হৃদয় নিংড়ানো দোয়া, শুভকামনা এবং ভালোবাসা। তবে আশাকরি শিগগিরই মামণি এবং খালামণির সাথে দেখা হবে। আমি অধীর আগ্রহে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের অপেক্ষায় আছি।

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com