ভাই ভাই এবং আমাদের শিক্ষা

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০৬:১৫ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
দাঁতন দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করা গ্রামীণ সকালের নিত্যদিনের চিত্র

খাঁটি সরিষার তেল চুপচুপ করে মাথায় দেওয়া, চুল পাট করে আঁচড়ানো। দুই ভাই গ্রাম থেকে শহরে আসছে। তারা শহরে থাকা তাদের শিক্ষিত ভাইয়ের জন্য নিয়ে আসছে গরুর খাঁটি দুধ, মুড়ি, মুরগী, কাঁঠাল, কচুসহ আরও কত কি! বাস থেকে নামতে গিয়েই বাসের কন্ডাকটরের সঙ্গে ঝামেলা। এইভাবেই তারা ঢাকা শহরে এসে নামে। এরপর তারা একটা রিকশা নিয়ে রওনা দেয় ভাইয়ের বাড়ির দিকে। যেতে যেতে তারা আলোচনা করে কীভাবে তারা তাদের ভাইয়ের শিক্ষিত বউয়ের সাথে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলবে। এটা নিয়েও দুই ভাইয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগে যায়।

দুই ভাইয়ের ক্ষণে ক্ষণে লেগে যায় আবার সাথে সাথেই গলাগলি হতেও সময় লাগে না। মেজো ভাইটার মাথা কিঞ্চিৎ গরম তাই সে দ্রুতই আবেগী হয়ে যায়। সে অবধারিতভাবেই আশা করেছিল তাদের ভাই তাদের বাসস্টেশন থেকে নিতে আসবে। কিন্তু বড় ভাই তাকে বুঝিয়ে বলে। ঢাকা শহরে চাকরি করতে গেলে বসের কথামতো চলতে হয়। এটাতো আর নিজেদের জমি চাষ করার বিষয় না। কোদাল নিয়ে দুই কোপ দিয়ে আসলাম। ইচ্ছে করলো গেলাম, ইচ্ছে করলো না তো গেলাম না। বলাই বাহুল্য নাটকের এসব কথাবার্তা হয় গ্রামীণ ভাষায়।

গ্রাম থেকে আনা কাঁঠাল সবাই মিলে মেঝেতে বসে ভেঙে খাওয়া। নিজে খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে বড় ভাই একই হাতে কাঁঠালের রোয়া মুখে তুলে দিচ্ছেন ছোট ভাই এবং তার বউয়ের মুখে। আবার গ্রাম থেকে শহরে এসে টয়লেট ব্যবহার করা একটা বিশাল ঝক্কির কাজ কারণ এখন প্রায় সব বাসাতেই আর প্যান নেই, সেখানে স্থান করে নিয়েছে উঁচু কমোড। উঁচু কমোডে কীভাবে বসতে হয় এটা অনেকেই জানেন না। আমি একবার ঢাকার একটা বেসরকারি হাসপাতালের টয়লেটে দেখেছিলাম ছবি দেওয়া আছে ঠিক কীভাবে কমোডে বসে টয়লেট করতে হয়। কমোডে বসে টয়লেট করলে গ্রামের মানুষের কাছে মনে হয় যেন ঠিকমতো পেট পরিষ্কার হয়নি। এক ধরনের অস্বস্তি কাজ করে সারাটাদিন।

ভাই ভাই এবং আমাদের শিক্ষাগ্রামের চায়ের দোকানের বারোয়ারি আড্ডা

টেবিলে বসে খেতে এখনও গ্রামের মানুষ অভ্যস্ত না। আর খেতে খেতে স্মৃতিচারণ করাও খাওয়ারই অংশ। সেখানে যখন বলা হয় মিলন ছোট বেলায় খেতে বসলে ওর নাক দিয়ে সর্দি ঝরতো এটা মিলনের বউ নিতে পারেনি। আমরা ছোটবেলায় আইসক্রিমকে মালায় বলেই জেনে এসেছি। এখনও গ্রামে বেড়াতে গেলে বন্ধুরা মিলে মালায় কিনে খাওয়া উৎসবের অংশ হয়েই আছে। কিন্তু মিলন শহরে এসে মালায়কে আইসক্রিম বলতে শিখে গেছে। শহরের মানুষদের পোশাক পরিচ্ছদ খাওয়া সবকিছুই গ্রামের মানুষদের কাছে এখনও নতুন। খাবার টেবিলে পাত্র থেকে হাত দিয়ে খাবার নিয়ে নেওয়াটা তাদের কাছে খুবই মামুলি ব্যাপার। এখানে সত্যজিৎ রায়ের একটা সাক্ষাৎকারের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। পথের পাঁচালিতে হাত দিয়ে খাবার খেতে দেখে বিদেশের কোনো একটা দেশের দর্শক হল থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।

গ্রামের মানুষদের জীবন যুদ্ধের (স্ট্রাগলের) গল্প শহুরে সিনথিয়ার বিশ্বাস হতো না। তাই যখন ছোট ভাই মিলনের সাথে তার প্রেম হয়েছিল তখন তার কাছে এগুলোকে সিনেমার গল্প বলেই মনে হত। তার কখনোই ধারণা ছিল না যে বাস্তবেও এসব হয়। আসলেই কারো জীবনের গল্প অন্য করোও কাছে সিনেমার গল্প বলেই মনে হয়। যাইহোক ভাই ভাই নাটকটা কতবার যে দেখেছি তার হিসাব নেই। এরপর যখন ভাই ভাই ২ এসেছে তখনও সেটা মুগ্ধতা নিয়ে দেখেছি। এরপর এবারের ঈদে এসেছে ভাই ভাই ৩। আমার ঈদের আনন্দ পূর্ণতা পেয়েছে এই নাটকটা দেখে।

ভাই ভাই এবং আমাদের শিক্ষাগ্রামীণ খেলাধুলার অকৃত্রিম সরঞ্জাম

এতো গেলো নাটকের কথা। এবার আসি বাস্তবতার কাছে। আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা পদ্মার পলিবিধৌত গ্রাম চভবানীপুরে। কুষ্টিয়া সদর থেকে গড়াই নদী পার হলে হাটশহরিপুর ইউনিয়ন। তারপর প্রমত্তা পদ্মা নদী। এই পদ্মা নদীর অপর পাড়ের গ্রাম চরভবানীপুর। নামের আগের চর শব্দটা এই গ্রামের চরিত্র বুঝতে সহায়ক। প্রকৃতির নিবিড় মমতায় এই গ্রামের গড়ে উঠা। কথায় আছে নদীর একুল ভেঙে ওকুল গড়ে এইতো নদীর খেলা। তেমনই এক খেলায় নদীর পাড়ে এই চরগুলো জেগে উঠেছিল। সময়ের পরিক্রমায় সেগুলোই এখন স্থায়ী জনবসতিতে পরিণত হয়েছে।

আশপাশের গ্রামগুলোর নামও একই রকম- চরঘোষপুর, চররঘুনাথপুর ইত্যাদি। প্রশাসনিকভাবে গ্রামটা কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও এখানকার মানুষজন নিত্যদিনের প্রয়োজনে পাবনাতেই যাতায়াত করেন। শুধুমাত্র প্রশাসনিক দরকারে কুষ্টিয়া আসেন। এই গ্রামে তখনও সভ্যতার ছোঁয়া লাগেনি। বিদ্যুৎও আসেন। গ্রামের মানুষ জানে না টেলিভিশন, ফ্যানের খবর। এখানকার মানুষদের মুখের ভাষাটাও প্রাকৃতিক। নিত্যদিনের সেই ভাষার মধ্যে রাখঢাক নেই মোটেও। সব কথায় একেবারে আদিম ও অকৃত্রিম। ঘুম থেকে উঠেই মানুষজন চুলার কয়লা বা ছাই দিয়ে ঘষে দাঁত পরিষ্কার করে। অনেকেই পুরোনো চুলা ভেঙে সেখান থেকে পোড়া মাটি উঠিয়ে রাখেন। সেটা দিয়েও চমৎকার দাঁত পরিষ্কার হয়। এরপর তারা নুন দিয়ে পান্তা খেয়ে ক্ষেতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েন।

এরপর একটা সময় চরভবানীপুর ছেড়ে এসে কুষ্টিয়ার শহরতলি বাড়াদীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলাম। সেখানেও ছিল গ্রামীণ আবহ। মাধ্যমিক পাস করে যখন উচ্চমাধ্যমিকে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে ভর্তি হলাম তখন বাধ্য হয়েই শহরে যাতায়াত বেড়ে গেলো। তখন কিছু বিষয় খুব সহজেই ধরা দিলো। আমরা গ্রামের মানুষ আব্বা, মা, চাচা, ফুপু, মামা, খালা, নানা, নানী, দাদা, দাদি এইসব ডাকেই অভ্যস্ত কিন্তু শহরের মানুষের কাছে এই ডাকগুলো হচ্ছে আব্বু, আম্মু, চাচ্চু, ফুপ্পি, মাম্মা, খালামনি, নানু, নানী, দাদু, দিদা।

ভাই ভাই এবং আমাদের শিক্ষাচরভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা

এছাড়াও আরও অনেক শব্দ শিখলাম তফন হয়ে গেছে লুঙ্গি, গুঞ্জি হয়ে গেছে গেঞ্জি। আর নিত্যদিনের কাজকর্মের শব্দগুলোও নতুন। খাওয়া, শহরে এসে হয়ে গেছে কখনও ব্রেকফাস্ট কখনও লাঞ্চ বা কখনও ডিনার আর হাগা, মুতার মতো অপরিহার্য শব্দগুলো হয়েছে টয়লেট করা।

এবার আসি কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণায়। বুয়েট থেকে পাশ করার পর বহুজাতিক কোম্পানি সিমেন্সে যোগদান করলাম। টয়লেটে যেয়ে দেখি সেখানে প্যান নেই, কমোড। তাই আমি বেশিরভাগ সময় বাসায় ফিরে বড় টয়লেট সারতাম। আর নেহায়েৎ দরকার পড়লে কমোডের ওপর উঠে। সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা ছিল। কখন উল্টে পড়ে যাই সেই ভয় তো ছিলই। এরপর অবশ্য দ্রুতই মানিয়ে নিয়েছিলাম। এভাবে টয়লেট করতে করতে এখন আর প্যানে টয়লেট করতে পারি না। কমোডে টয়লেট করতে যেয়ে আরও একটা ক্ষতি হয়েছে এখন নামাজে বসতে অনেক কষ্ট হয়। এখন বুঝি প্যানে টয়লেট করা এক ধরনের ব্যায়ামও ছিল।

আমার আব্বা খাবার পর হাত দিয়ে দাঁত মেজে গড়গড়া করে কুলি করে মুখ পরিষ্কার করেন। এটাতে আমরা অভ্যস্তই ছিলাম। এরপর একদিন উনি ঢাকার বাসায় এসে ডাইনিং টেবিলের পাশের সিংকে যখন এটা করছিলেন তখন দেখি সবাই বিরক্ত হচ্ছে। পরে আমি আব্বাকে বললাম, তুমি এটা যেকোন বাথরুমে যেয়ে দরজা বন্ধ করে করো। জানি না আব্বা মন খারাপ করেছিল কি না?

গ্রামের মানুষদের মন যেমন পরিষ্কার সম্পর্কগুলোও পরিষ্কার। কাউকে ভালো লাগলে মাথায় তুলে নিয়ে নাচবে আর কাউকে অপছন্দ হলে সেটাও সরাসরি জানিয়ে দিতে দ্বিধা করেন না। এই স্বভাবটা এখনও আমার মধ্যে ধরে রেখেছি। আমি বন্ধুদের বিশেষ করে ছোটদের অবলীলায় তুই তোকারি করি। এটা শুনে আমার গিন্নী একদিন বলেই বসলো, তুমি এই তুই তোকারি করো এটাতো সবাই ভালো চোখে নাও দেখতে পারে। তখন আমি উত্তর দিয়েছিলাম, তাতে আমার বয়েই গেছে, আমি কারো খাইও না কারোটা পরিও না।

ভাই ভাই এবং আমাদের শিক্ষাগ্রামীণ আপ্যায়নে জৌলুশ না থাকলেও আন্তরিকতা থাকে শতভাগ

যাইহোক নাটকের কাছে ফিরে আসি। খালিদ, সুজন আর মিলন তিন ভাইয়ের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের ফাঁকে ফাঁকে সাগর জাহান গল্প বলে গেছেন বাংলাদেশের শহরের আর গ্রামীণ মূল্যবোধের সংঘাতের। একক পরিবারে বেড়ে ওঠা সিনথিয়ার সাথে যৌথ পরিবারে বেড়ে ওঠা মিলনের সংঘাতের মাধ্যমে উঠে এসেছে স্বজনদের প্রতি অনুভূতির গল্প। আর পুরো নাটকে বাড়ির কাজের ছেলের চরিত্র হারুণ ভাই যেন হয়ে উঠেছেন অভিবাভবক।

ঘটনাক্রমে আমরাও তিনভাই অনেক স্ট্রাগল করে বড় হয়েছিলাম। আজকে সবাই প্রতিষ্ঠিত। তিনজন আছি পৃথিবীর তিন প্রান্তে। দেশে গেলে আমাদের কথা হয়, দেখা হয়। এছাড়া তেমনভাবে কথা বা দেখা হবার সুযোগ খুবই কম। আমি সবসময়ই চাইতাম আমার ছোট ভাই দুজন স্বনির্ভর হবে কিন্তু আমি কখনওই তাদের ওপর কোনো বড় ভাই সুলভ খবরদারি করবো না। ঠিক যেমনটা আমাদের আব্বা আমাদের উপর বাবাসুলভ খবরদারি না করে আমাদের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন।

এই নাটকে মারজুক রাসেল, রুমেল, পাভেল, হারুন তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ অভিনয় করেছেন বলেই আমার বিশ্বাস। আর ভাই ভাই ৩ এসে দিলারা জামানের অভিনয় ছিল বাড়তি পাওয়া। আশাকরি সাগর জাহানের হাত ধরে গ্রামীণ মূল্যবোধের এমন আরও অনেক নাটক তৈরি হবে। শহরের মানুষ গ্রাম বলতে এখনও শুধু 'ভিলেজ পলিটিকস' বিষয়টায় বুঝেন।

এটা খুবই দুঃখজনক। আসলে গ্রামের সাথে দূরত্ব থাকার কারণেই এই ভুল বোঝাবুঝি। আমরা যদি আমাদের শেকড়কে না ভুলে গিয়ে প্রতি বছর অন্ততঃপক্ষে একটিবার সপরিবারে গ্রামে যাই তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম আর গ্রাম সম্মন্ধে ভুল ধারণা নিয়ে বেড়ে উঠবে না। বাংলাদেশের শতকরা প্রায় আশিভাগ মানুষ গ্রামে বাস করেন। তাই তাদের বাদ দিয়ে ভাষা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধ কোনটারই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব না।

এমআরএম/জেআইএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]