আরব বিশ্বের ভূমিকা ও নিস্তব্ধতার রাজনৈতিক ব্যাখ্যা

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ১১:৪৭ এএম, ০৮ এপ্রিল ২০২৫

প্যালেস্টাইন সংকট শুধু একটি সীমান্ত বা ভূখণ্ডের বিরোধ নয়—এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন, জাতিগত নিধনের এক নির্মম, রক্তাক্ত অধ্যায়। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই লাখ লাখ প্যালেস্টাইনিকে উচ্ছেদ, হত্যা এবং বন্দিত্বের মুখোমুখি হতে হয়েছে। তাদের ওপর চলছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, দখল এবং পরিকল্পিত নিপীড়ন।

এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে জ্বলন্ত প্রশ্নটি হলো: আরববিশ্ব কোথায়? কেন প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলো, যারা জাতিগত, ভাষাগত ও ধর্মীয়ভাবে প্যালেস্টাইনের সাথে একসূত্রে গাঁথা, তারা এতটা নিষ্ক্রিয়, দ্বিধাগ্রস্ত, অথবা কূটনৈতিকভাবে দুর্বল?

বিজ্ঞাপন

১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার পর একাধিকবার আরব রাষ্ট্রগুলো যৌথভাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। কিন্তু প্রতিবারই রাজনৈতিক ভঙ্গুরতা, নেতৃত্বের অভাব, অভ্যন্তরীণ বিভক্তি এবং পাশ্চাত্য শক্তির প্রভাব আরবদের পিছিয়ে দেয়। প্যান-আরবিজম আন্দোলনের পতনের পর এই অঞ্চলটিতে কোনো ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আর সম্ভব হয়নি। আজকে আরব লীগ একটি নামমাত্র প্রতীক—যারা মাঝে মাঝে নিন্দা প্রস্তাব পাশ করে, কিন্তু বাস্তবে কিছুই করতে পারে না।

১. সৌদি আরব ও উপসাগরীয় রাজতন্ত্রগুলো

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

তেলের অর্থনীতি ও পশ্চিমা সামরিক সহায়তার বিনিময়ে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন ইসরায়েলের প্রতি সরাসরি বিরোধিতা থেকে পিছিয়ে গেছে। “আব্রাহাম অ্যাকর্ড”-এর মাধ্যমে বাহরাইন ও UAE ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে—একটি পদক্ষেপ যা প্যালেস্টাইনের স্বার্থকে কার্যত বিসর্জন দেওয়ার নামান্তর।

২. মিশর ও জর্ডান: নীরব অংশীদার

মিশর ও জর্ডান দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলের সাথে শান্তিচুক্তি বজায় রেখেছে। গাজা উপত্যকার একমাত্র দক্ষিণ সীমান্তটি মিশরের নিয়ন্ত্রণে, অথচ প্রায়ই তারা এই সীমান্ত বন্ধ রেখে গাজাবাসীর মানবিক সংকটকে আরও ভয়াবহ করে তোলে। মানবিক বিবেচনার বদলে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও ভূ-রাজনৈতিক হিসেবটাই বড় হয়ে উঠেছে।

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন

৩. কাতার ও তুরস্ক: প্রতীকী সমর্থন

কাতার ও তুরস্ক তুলনামূলকভাবে কিছুটা উচ্চকণ্ঠ, তবে তাদের ভূমিকাও মূলত প্রতীকী। মিডিয়া (যেমন আল-জাজিরা) ও কিছু আর্থিক সহায়তা ছাড়া কার্যকর রাজনৈতিক বা সামরিক চাপ সৃষ্টি করার মতো পদক্ষেপ চোখে পড়ে না।

কারণসমূহ: নিষ্ক্রিয়তার পেছনের বাস্তবতা

১. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ক্ষমতার ভয়:

আরব বিশ্বের বহু দেশই নিজেরাই রাজনৈতিক সংকটে জর্জরিত। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা, গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি এবং জনরোষের ভয় তাদের আন্তর্জাতিক ইস্যুতে নেতৃত্বদান থেকে বিরত রাখে।

বিজ্ঞাপন

২. পশ্চিমা নির্ভরতা ও ভীতি:

সৌদি আরবসহ অনেক রাষ্ট্র নিরাপত্তা ও অস্ত্র সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ওপর নির্ভরশীল। ফলে ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান তাদের জন্য কূটনৈতিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়।

৩. ইসলামি ঐক্যের অভাব:

সুন্নি-শিয়া বিভাজন, আঞ্চলিক আধিপত্যের দ্বন্দ্ব এবং মতাদর্শগত বিভক্তি মুসলিম বিশ্বকে একসাথে দাঁড়াতে দেয়নি। ফলে প্যালেস্টাইনের প্রশ্নে শক্তিশালী ঐক্য প্রতিষ্ঠা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

মানবিক বিপর্যয় ও ইতিহাসের দায়

প্যালেস্টাইন সংকট আজ আর শুধু রাজনৈতিক ইস্যু নয়, এটি মানবিক বিপর্যয়ের প্রতীক। শিশুদের ওপর বোমা বর্ষণ, হাসপাতাল ধ্বংস, খাদ্য ও পানির সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার মতো কর্মকাণ্ড একটি জাতিকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার পাঁয়তারা।

বিজ্ঞাপন

আর কত অমানবিকতা, আর কত নিষ্ঠুরতার চিত্র দেখতে হবে আমাদের? যখন শিশুদের রক্তে ভিজে যায় হাসপাতালের মেঝে, যখন পুরো জাতিকে খাদ্য ও পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, তখন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং তথাকথিত “সভ্য” বিশ্ব—আমেরিকা সহ—নিষ্ক্রিয় ও নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। তারা কিছু নরম বিবৃতি দিয়ে নিজেদের মানবতাবাদী মুখোশ রক্ষা করে, কিন্তু বাস্তবতায় তারা কার্যত সহিংসতার বৈধতা দিচ্ছে। যেন কিছুই ঘটছে না, যেন প্যালেস্টাইনের ওপর গণহত্যা কোনো বিষয় নয়। এই নিস্তব্ধতা শুধু কূটনৈতিক ব্যর্থতা নয়—এটি মানবতার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা।

সম্ভাব্য পথ: প্রতিরোধ কি এখনও সম্ভব?

  • জনগণের চাপ ও প্রতিবাদ:

আরব রাষ্ট্রগুলোর জনগণ যদি গণআন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে, তবে কূটনৈতিক অবস্থানে পরিবর্তন আনা সম্ভব।

  • বিকল্প আন্তর্জাতিক জোট:

মুসলিম ও নিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো নিয়ে একটি নতুন ন্যায়ভিত্তিক আন্তর্জাতিক ফোরাম গঠন করা জরুরি—যা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্যালেস্টাইন ইস্যুতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

বিজ্ঞাপন

  • সাংস্কৃতিক ও তথ্যযুদ্ধ:

মিডিয়া, সাহিত্য, সিনেমা ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের বাস্তবতা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার, যেন মানুষ ন্যায়ের পক্ষে সংহতি গড়ে তোলে।

আরব বিশ্ব কি ইতিহাসের কাঠগড়ায়?

প্যালেস্টাইন সংকট শুধু ইসরায়েল ও প্যালেস্টাইনের মধ্যকার বিরোধ নয়; এটি মানবতা বনাম নিপীড়নের লড়াই। এখানে শুধু ইসরায়েল নয়, আরব বিশ্বের নিষ্ক্রিয়তা এবং পশ্চিমা বিশ্বের দ্বিচারিতাও সমানভাবে দায়ী।

ইতিহাস একদিন এই প্রশ্ন তুলবেই: যখন একটি জাতিকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার চেষ্টা চলছিল, তখন আপনারা কোথায় ছিলেন?

বিজ্ঞাপন

আরব রাষ্ট্রগুলোর নীরবতা, নিষ্ক্রিয়তা এবং রাজনৈতিক ব্যবসার ইতিহাস একদিন এই জাতিগত দুঃখগাথার অংশ হিসেবে চিহ্নিত হবে—একটি বিশ্বাসঘাতক প্রজন্মের দলিল হয়ে।

লেখাটি যদি আপনার হৃদয়ে নাড়া দেয়, তবে প্রশ্ন তুলুন—আপনার নীরবতাও কি ইতিহাসের দায়ের অংশ নয়?

জাগোনিউজের খবর পেতে ফলো করুন

রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক
(সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন)
Rahman.Mridha@gmail.com

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - jagofeature@gmail.com