করোনা প্রতিরোধে যেভাবে সফল জার্মানি
মিজানুর হক খান, জার্মানি (বার্লিন) থেকে
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস ইউরোপের দেশ ইতালি, স্পেন আর ফ্রান্সে তাণ্ডব চালালেও জার্মানির স্বাস্থ্য সেবাকে কাবু করতে পারেনি। কোনো রকম প্রতিষেধক ছাড়াই শুধু সেবা আর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দেশটিতে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে এই ভাইরাস। এ যাবত রোগীর সংখ্যা প্রায় ১৯৬০০০ যার মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ১৮০,০০০ এর মতো, আর মারা গেছেন ৯০৫০ জনের কিছু বেশি মানুষ।
অনেকের কাছেই প্রশ্ন, করোনা মোকাবিলায় কিভাবে সফল জার্মানি? সহজ উত্তর Trace, Test এবং Treat (শনাক্ত, পরীক্ষা এবং চিকিৎসা) এই ‘তিন T’ কৌশলেই সফল জার্মানি। দেশটি অন্য যেকোনো ইউরোপীয় দেশের তুলনায় বেশি পরিমাণ করোনাভাইরাস পরীক্ষা চালিয়েছে। দেশটি সপ্তাহে ৩ থেকে ৫ লাখ মানুষের করোনা পরীক্ষা করেছে। ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এমন সন্দেহ হলেই তাদের সবার পরীক্ষা করা হয়েছে। কোভিড-১৯ রোগের একটি উপসর্গও যার মধ্যে রয়েছে তাকে পরীক্ষা করা হয়েছে।
ব্যাপক পরীক্ষা ও জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রস্তুতির পাশাপাশি জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা মারকেলের সময়োচিত সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্বে মৃত্যুহার হ্রাসের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। একজন প্রশিক্ষিত বিজ্ঞানী হিসেবে তিনি এই সংকটের শুরু থেকেই নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করে দ্রুত ও কার্যকর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তিনি সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পদক্ষেপটা খুবই কঠোরভাবে আরোপ করেছিলেন। তাছাড়া দক্ষিণ কোরিয়াকে অনুসরণ করে দ্রুত রোগ শনাক্তকরণের ওপর জোর দিয়েছিলেন। তার সময়োচিত পদক্ষেপ প্রায় সব মহল থেকে প্রশংসা পেয়েছে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে এমন যৌক্তিক সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
আমি মনে করি জার্মানিদের এই সাফল্যের মূলে রয়েছে তাদের দেশপ্রেম। এদেশের নাগরিকেরা বরাবরই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সরকারের সকল নির্দেশনাই তারা মেনে চলেন। করোনার সময়েও তাই, যথাযথ সামাজিক দূরত্ব মেনে চলেছেন সবাই। অবসরে যাওয়া ডাক্তাররা ফিরে এসেছেন দেশের মানুষের সেবা করার জন্য। ২০০০০০ মেডিকেল স্টুডেন্ট দিয়েছেন স্বেচ্ছাশ্রম।
সরকারের সবচেয়ে প্রশংসনীয় উদ্যোগগুলোর একটি ছিল দ্রুত অর্থনৈতিক সহায়তা। ৩ দিনের মধ্যে সহায়তা পেয়েছেন সবাই। ছোট আকারের কোম্পানি থেকে শুরু করে স্বনির্ভর ব্যক্তিরা কমপক্ষে তিন মাসের জন্য ১৫ হাজার ইউরো পর্যন্ত সরকারি ভর্তুকি পেয়েছেন। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পেয়েছে আরও বেশি। সাধারণ মানুষের সমস্যা কাটাতেও সরকার কিছু ঘোষণা করেছে।
যেমন এক জরুরি আইনের বলে আয়ের অভাবে বাসাভাড়া মেটাতে না পারলেও মালিক ভাড়াটেদের তাড়াতে পারবে না। প্রায় সকল সাহায্য পাওয়া এবং অর্থনৈতিক লেনদেন হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে। এমনকি যারা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাহায্য করেছে তারাও অ্যাকাউন্ট নম্বর নিয়ে ব্যাংকে টাকা পাঠিয়েছেন। সুতরাং মানুষকে ঝুঁকি নিয়ে কোথাও যেতে হয়নি। প্রচারের আশায় কেউ সাহায্য দিয়ে ছবি তোলার জন্য শত শত মানুষকে জড় করেননি। নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাই ছিল প্রধান প্রচেষ্টা।
জার্মানির উল্লেখযোগ্য একটি ভালো দিক হলো শক্তিশালী জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা। চীনে করোনা প্রাদুর্ভাবের পর জানুয়ারি থেকেই জার্মানিব্যাপী হাসপাতালগুলো তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করে। জানুয়ারিতে জার্মানির হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পরীক্ষা কীটসহ চিকিৎসা উপকরণ দিয়ে উপযোগী করা হয়েছে।
জানুয়ারিতেই জার্মানিতে ২৮ হাজার ভেন্টিলেটরসহ আইসিইউ বেড ছিল। অর্থাৎ প্রতি ১ লাখ লোকের জন্য ৩৪টি আইসিইউ। যেখানে ইতালিতে সমপরিমাণ লোকের জন্য ১২ টি এবং ন্যাদারল্যান্ডে ৭টি আইসিইউ বেড রয়েছে। তবে বর্তমানে জার্মানিতে মোট ৪০ হাজার আইসিইউ বেড রয়েছে। জার্মানি ইতালি, স্পেন ও ফ্রান্সের রোগীদের ও সেবা দিয়েছে। এর মাধ্যমেই জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় জার্মানির সক্ষমতা বোঝা যায়।
দেশটিতে বসবাসরত সংকটে থাকা প্রবাসীদের পাশে দাঁড়িয়েছে নানা সামাজিক ও রাজনৈতিক মাধ্যম। বার্লিনে আমি দেখেছি বিভিন্ন কমিউনিটিতে সাহায্য সহযোগিতা করছেন সবাই। আমরাও সাধ্যমতো সাহায্য করেছি বাংলাদেশি কমিউনিটির যারা অসহায় বা অপেক্ষাকৃত খারাপ অবস্থায় ছিলেন বিশেষ করে ইতালি এবং সাইপ্রাস থেকে কিছু বাংলাদেশি নতুন এসেছিলেন, তাদেরই সাহায্যের প্রয়োজন ছিল বেশি। বাংলাদেশ দূতাবাস সবসময় জার্মানিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন এবং প্রতিদিন দূতাবাস খোলা রেখেছেন। বরাবরের মতোই তাদের আন্তরিকতার কোনো অভাব ছিল না।
দেশটির সরকারি ও বিরোধী দলসহ সকল রাজনৈতিক দল তাদের ভিন্নমত ও ভেদাভেদ ভুলে সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতির ক্ষেত্রে ভিন্নমত থাক্তেই পারে, কিন্তু জনগণের প্রয়োজনেই রাজনীতি। একে অন্যকে দোষারোপ না করে দেশ ও জাতির বিপদের সময় সকলের পাশে দাঁড়ানোই আদর্শ রাজনীতি চর্চার পরিচয়।
এখনও বিপদ পুরোপুরি কেটে যায়নি। সামনের দিনগুলোতে মেনে চলতে হবে সাবধানতা। জার্মানির সংক্রমণ রোগ বিষয়ের গবেষণা কেন্দ্র রবার্ট কক ইন্সটিটিউটের সভাপতি লোথার ভীলার জার্মানির জনগণকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, সবাইকে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত আচরণবিধি মেনে চলতে হবে, তা না হলে দ্বিতীয় দফায় আসা করোনাভাইরাসের সংকট ফের বিপদজনক পরিস্থিতিতে চলে যেতে পারে।
আমাদের প্রজন্মের সকলের জন্যই নতুন একটি অভিজ্ঞতা এটি। কিছু দেশ এখনও পরিস্থিতি সামাল দিয়ে উঠতে পারছে না। এখনও যে সকল দেশে করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ তারা জার্মানিকে অনুসরন করতে পারে।
লেখক: মিজানুর হক খান
সাবেক সভাপতি, বার্লিন আওয়ামী লীগ।