বুধ গ্রহে চাঁদ উঠেছে

মো. ইয়াকুব আলী
মো. ইয়াকুব আলী মো. ইয়াকুব আলী
প্রকাশিত: ০৩:৪২ পিএম, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২১

বহুদিন পর একটি বই পড়েছি। পড়তে পড়তে আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। ভদ্রলোকেরা যেটাকে বলেন গুসবাম। আমি প্রচন্ডরকম ধীর গতির পাঠক। এমন পাঠক হওয়ার অসুবিধা যেমন বইটা শেষ করতে দেরি হয়ে যায় আবার সুবিধা হচ্ছে গল্পের চরিত্রগুলো চোখের সামনে দেখতে পাওয়া যায়, তাদের হাসি কান্না মূর্ত হয়ে ওঠে।

কিযী তাহনিনের লেখা এই বইয়ে সর্বমোট গল্প আছে দশটি। বিষয় বৈচিত্র্যে প্রত্যেকটা গল্পই আলাদা। পাঠক গল্পের চরিত্রগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের একেবারে প্রান্তিক জনপদ থেকে শুরু করে পাঁচতারা হোটেল পর্যন্ত মনেমনে বেড়াবেন। আর লেখকের বর্ণনা এতটাই প্রাঞ্জল যে পাঠক নিজেই গল্পের চরিত্র হয়ে উঠবেন। তাই গল্প শেষ হবার পরও পাঠক কিছুক্ষণের জন্য বিভ্রান্তিতে থাকবেন যে তিনি আসলে তখন কোথায় অবস্থান করছেন।

বইয়ের নামকরণ যেই গল্পের নামে সেটা দিয়েই পড়া শুরু করেছিলাম। পড়তে যেয়ে মনে হলো এটা হয়তোবা কোনো একটা থ্রিলারধর্মী কোনো গল্প হবে কিন্তু লেখিকা সেটাকে একেবারে মানবীয় গল্পের পরিণতি দিয়েছেন। গল্পের গতিময়তা আমাকে একটানে গল্পটা শেষ করতে বাধ্য করেছিলো। গল্পটা শেষ করার পর মনের মধ্যে এক ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছিলো। আমি ঠিক জানি না এই শূন্যতার মানে কি?

এরপর শুরু করেছিলাম প্রথম গল্পটা ‘বিন্যাকুড়ির আকাশ-পাতাল’। অসম্ভব মুগ্ধতা নিয়ে গল্পটা পড়েছিলাম। শেষ করার পর মনের মধ্যে একটা ধাক্কা লাগলো আর মনে হলো যেন শরীরের সব লোম দাঁড়িয়ে গেছে। গল্পের প্লটে যে স্থানের বর্ণনা দেয়া হয়েছে সেই স্থানটা আমি চিনি।

গ্রামীণ বাজার যেগুলোকে স্থানীয়রা হাট বলে থাকেন সেই স্থানের নিখুঁত বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। গ্রামের মানুষদের উৎসব আনন্দের অনুষঙ্গ আসলেই অতি সস্তা। মাত্র এক টাকাতেই সেই আনন্দ পূর্ণতা পায়। আর আছে প্রকৃতি নির্ভরতা।

এরপর একে একে পড়ে গেছি বিলম্বি টান, মধ্যদিনের গান, একটি সম্পূর্ণ রঙিন সিনেমা, মনোভূমির জল, আমি মেশিনঘরের রিসিপশনিস্ট, ফিওনা ফ্যাশনিস্তার মুখোশ বিলাস, আষাঢ়ে, হলেও হতে পারে প্রেম। ইচ্ছে ছিলো একটানা বইটা পড়ে শেষ করার কিন্তু নাগরিক ব্যস্ততায় আর সেটা হয়ে উঠেনি। তাতে বরং ভালোই হয়েছে প্রত্যেকটা গল্পের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করা গেছে।

‘বিলম্বি টান’ গল্পটা পড়ার পর থেকেই জীবনানন্দ দাশের এই লাইনটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে - ‘সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী; ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন।’ ‘মধ্যে দিনের গান’ গল্পের নিচের লাইনগুলো খুব ভালো লাগলো - ‘মানুষ নিজের সঙ্গে নিজে থাকতে চায় না কারণ নিজের মুখোমুখি হলে পুরনো সব হিসাবনিকাশ মেলাতে হয়। সেই হিসাবনিকাশ, যা থেকে সে সারাক্ষণ পালিয়ে বেড়াতে চায়।’

একটি সম্পূর্ণ রঙিন সিনেমাতে আবারও গ্রামীণ লোকাচারকে আশ্রয় করে একটা দুর্দান্ত গল্প বলা হয়েছে। একজন জন্মান্ধের কাছে এই পৃথিবী কিভাবে একটা রঙিন সিনেমা হয়ে উঠে সেই মনোজাগতিক বর্ণনা দেয়া হয়েছে অত্যন্ত জীবন ঘনিষ্ঠভাবে। ‘মনোভূমির জল’ গল্পটা আমার কাছে মনে হয়েছে এটা একজন জাতিস্মরের গল্প। গল্পটা পড়ার সময় কবির সুমনের সেই কালজয়ী গানের লাইনগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো –

‘অমরত্বের প্রত্যাশা নেই নেই কোন দাবী দাওয়া

এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকে চাওয়া’

আমি মেশিনঘরের রিসিপশনিস্ট, ফিওনা ফ্যাশনিস্তার মুখোশ বিলাস, আষাঢ়ে গল্প তিনটা আবার নগর কেন্দ্রিক। নগরের প্রাত্যহিক জীবন যাপন, মানুষের মেকি আচরণ, অতিলোভী মূল্যবোধের পাশাপাশি এসেছে কপর্দকহীন একটা পরিবারের সংগ্রামের গল্প। ফিওনা ফ্যাশনিস্তার মুখোশ বিলাস'এ লেখিকা শহুরে মুখোশের আড়ালের আসল মানবীকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন।

আষাঢ়ে গল্পে বর্তমান সভ্যতার একটা রূঢ় সত্য উত্থাপন করেছেন - যে ধনী সে আরো ধনী হবার নেশায় মত্ত আর যে গরীব সে কোনোমতে টিকে যুদ্ধে অবতীর্ণ। এইসব ছাপিয়ে গল্পটা শেষ হয় মানুষের মানবিক মূল্যবোধের প্রকৃতি উন্মোচনের মধ্য দিয়ে।

‘হলেও হতে পারে প্রেম’ গল্পে লেখক দেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছেন এবং পাঠকের কাছে প্রশ্ন রেখেছেন আসলে প্রেমের স্বরূপ কি? আমি কোন সাহিত্যবোদ্ধা নই তাই এই বইটার সাহিত্যিক মূল্য কতখানি আমার জানা নেই। আমাকে সবসময়ই যে বিষয়টা মুগ্ধ করে সেটা হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনবোধ এবং জীবন সংগ্রাম।

যে লেখা যতবেশি জীবন ঘনিষ্ঠ সেই লেখা আমার ততবেশি ভালো লাগে। লেখকের ভাষা এবং শব্দচয়ন গল্পের প্লট এবং কাহিনির সাথে পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে আমার কাছে। শুরুর গল্প ‘বিন্যাকুড়ির আকাশ-পাতাল’ এ লেখক উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ‘মনোভূমির জল’ এ এসে আবার দক্ষিণাঞ্চলের প্রকৃতির সুন্দর বর্ণনা দিয়েছেন। আবার গল্পের প্রয়োজনেই ‘হলেও হতে পারে প্রেম’ গল্পে দেশের বাইরের পরিবেশেরও পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন।

বইটি শেষ করার পর লেখকের কল্পনাশক্তি এবং জীবনবোধের ব্যাপ্তি সম্মন্ধে একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। যেখানে লেখক একইসাথে ঘুরছেন পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্তে, কখনও যাচ্ছেন নগরে আবার কখনও যাচ্ছেন গ্রামে, কখনও যাচ্ছেন গ্রামীণ হাটে আবার কখনও যাচ্ছেন শহরের পাঁচতারা হোটেলে।

এটাই আসলে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একজন লেখকের তফাৎ। ভূমিকাতে লেখক একটা কথা বলেছেন, ‘এক দানের এ জীবনভূমিতে, আমি নানা জীবনের গল্প কুড়োতে চাই।’ গল্পগুলো পড়ার পর এই কথাটার মর্ম পাঠক বুঝতে পারবেন।

এই বইটা পড়তে গিয়ে জেনেছি লেখকের আরও দুটো বই আছে - ‘আছে এবং নাই’ এবং ‘ইচ্ছের মানচিত্র’। আমি অধীর আগ্রহে এই দুটো বই হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। লেখকের কাছে আরও এমন সুন্দর সুন্দর গল্পের বইয়ের প্রত্যাশা রইলো।

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]