একজন ফোরকান স্যার

জিসান মাহমুদ
জিসান মাহমুদ জিসান মাহমুদ , কুয়েত প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ১০:০৪ এএম, ১০ অক্টোবর ২০২২

দুদিন আগেই শিক্ষক দিবস গেলো। যদিও এই শিক্ষক দিবস-মা দিবস-বাবা দিবস-ভালোবাসা দিবস এগুলো আমার কাছে তেমন কিছুই প্রভাব ফেলে না। শ্রদ্ধার আবার নির্দিষ্ট দিবস হয় নাকি! যারা মা-বাবার খবর নেয় না, শিক্ষককে দেখলে সম্মান দিতে জানে না তারাও ফেসবুকে ওই দিন কতশত ছবি পোস্ট দেয়। যাক তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।

তবে আজকে যার কথা বলতে ইচ্ছা হয়েছে তিনি আমাদের ফোরকান স্যার। ফেসবুকে একটি ভাইরাল ছবি দেখে হঠাৎ স্যারের কথা মনে পড়লো। মনে হয়েছিল তিনিই আমাদের ফোরকার স্যার। যার ভয়ে একটা সময় পুরো মাদরাসা কাঁপতো। স্যারের ক্লাস করেছে কিন্তু বেতের বাড়ি খাইনি এমন শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে না।

যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছি তখন থেকে ভয় কাজ করতো, কারণ স্যারের ক্লাস সপ্তম শ্রেণি থেকে শুরু হবে। তাও আবার প্রথম ক্লাস। মনে মনে ভাবতাম ইশ! যদি সপ্তম শ্রেণিতে ক্লাস না করে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে চলে যেতে পারতাম। এতটাই ভয় কাজ করতো।

সপ্তম শ্রেণিতে উঠার পর প্রথম ক্লাসে স্য্যার পেতাম প্রতিদিন। অনেক ফাঁকিবাজি করেছি, কিন্তু স্যারের ক্লাসে সেই সুযোগ আর ছিল না। একদিন অনুপস্থিত থাকলে কি মারটায় না দিত! কোনো ওজুহাত তার কাছে চলতো না। সবার অভিভাবকের নম্বর তার কাছে জমা থাকতো। যদি একদিন কেউ অনুপস্থিত থাকে তাহলে তার মা/বাবা কেউ ফোন করে উপযুক্ত কারণ বলতে হবে। এরপর অনুপস্থিত থাকার কারণে যে দরখাস্ত লিখে নিয়ে আসা হয় সেখানে অভিভাবকের সাক্ষর থাকতে হবে।

সপ্তম শ্রেণিতে উঠার পর আগে দরখাস্ত লেখা নতুন করে শেখান তিনি। তাই দরখাস্তে কোনো বানান, দাঁড়ি, কমা ভুল থাকতে হবে না। থাকলে সেটার জন্য আলাদা মার খেতে হত। তবে আমাদের মাঝে একজন ছিল মোশাররফ।

মোশাররফ মেয়ে কণ্ঠে কথা বলতে পারে। সে করতো কি, অনুপস্থিত থাকলে ক্লাসে আসার আগে ফোরকান স্যারকে ফোন দিয়ে তার মা সেজে কথা বলতো। ছেলে এই সমস্যার কারণে মাদরাসায় যেতে পারে নাই। স্যারও কণ্ঠ বুঝতে পারতো না। অন্যদিকে আবার অভিভাবকের সাক্ষর নকল করে নিয়ে আসতো। সাক্ষর নকল শুধু সে না। অনেকে করতো। আবার ধরাও খেত।

হাজিরা নেওয়ার পর কিছুক্ষণ সময় দিত হোমওয়ার্ক করার জন্য। পড়া শেষ হলেই সবাই মনে মনে আল্লাহকে ডাকতো। পড়া নেওয়ার আগে জিজ্ঞেস করতো যারা শেখেনি তারা যেন দাঁড়িয়ে যায়। ফলে তাদের দুই রকমের শাস্তি আগেই দিয়ে দিত।

প্রথমত, কুমড়াচিংড়ি, দ্বিতীয়ত সেই অবস্থাই নাড়াচাড়া করলে পিঠের ওপর বেত্রাঘাত। যেদিন মন একটু ভালো থাকবে সেদিন হাতের ওপর বেত্রাঘাত। যদিও একটা সময় তিনি এই কুমড়াচিংড়ি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তার জন্য আলাদাভাবে ক্লাসে বেত রেডি রাখা লাগতো। কেউ এই বেত ধরার সাহস করতো না।

যারা পড়া পারবে বলে বসে থাকতো এবার তাদের এক এক করে ডাক দিত বোর্ডে লেখার জন্য। এর মাঝে ভাগ্য ভালো থাকলে কেউ বেঁচে যেত, কারণ কয়েকজন লিখতে লিখতে সময় চলে যেত। তাদের মাঝে কেউ লিখতে না পারলে মার দ্বিগুণ হয়ে যেত।

তবে যেদিন কোনো একটা বিষয় নিয়ে কথা বলা শুরু করবে সেদিন বলতে বলতে সময় চলে যাচ্ছে সেটা খেয়াল করতো না। আর সেদিন আমাদের জন্য ছিল আনন্দের। পড়া আর জিজ্ঞেস করার সুযোগ নেই। আর স্যারের পরামর্শমূলক কথাগুলোকে আমরা ওয়াজ বলতাম।

ফোরকার স্যারের একটা হিরো হোন্ডা ছিল। ওই রকম হোন্ডা মাদরাসায় ছিল দুইজনের। একটি প্রিন্সিপ্যাল বেলায়েত হোসাইন তালুকদারের অন্যটি স্যারের। যদিও প্রিন্সিপ্যালেরটা ছিল অনেকটা নতুন। তাই ফোরকান স্যারের হোন্ডার আওয়াজ শুনলেই সবাই বুঝে যেত স্যার চলে আসছে।

একদিন না আসলে ওই দিন ছাত্রদের কাছে ঈদের দিন মনে হত। সবাই ক্লাস শুরু হওয়ার আগে হোন্ডা আছে কিনা চেক করে নিত। ব্যক্তিগত কাজে সন্দ্বীপ থেকে চট্টগ্রাম যাওয়া আছে স্যার ক্লাস মিস দিত না।

সবাইকে মাদরাসার নির্দিষ্ট ড্রেস পরে আসতে হতো। কেউ পাঞ্জাবীর সঙ্গে সাদা পায়জামা ব্যতীত অন্য প্যান্ট পরলে পায়ের ওপর চলতো বেত্রাঘাত। অন্যদিকে টাকনুর নিচে কাউকে প্যান্ট পায়জামা পরতে দেখলে আবারো মার শুরু।

এদিকে মাদরাসার ছেলেরা তো আরো চালাক। তারা আসার সময় ঠিকই প্যান্ট পরে আসতো, আর ব্যাগের ভেতর পায়জামা রাখতো। যখনি স্যারের ক্লাস শুরু হবে ঠিক তখনি ব্যাগের ভেতর থেকে পায়জামা বের করে প্যান্টের ওপর পরে ফেলতো। স্যারের ক্লাস শেষ হলে আবার খুলে ব্যাগে নিয়ে নিত। আর স্যার বুঝতেই পারতো না।

৫ ঘণ্টা পর আমাদের ১ ঘণ্টা বিরতি। বিরতির সময় জোহরের নামাজ। নামাজের আগে কেউ মাদরাসা থেকে বের হতে পারবে না এটাই নিয়ম। নামাজ সবার জন্য বাধ্যতামূলক। ফোরকার স্যার ওজুর সময় বেত নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতো। সবাই ঠিকঠাক ওজু করছে কিনা। কেউ যেন নামাজ ফাঁকি দিতে না পারে। যতক্ষণ সবাই মসজিদে না যাবে তিনি দাঁড়িয়ে দেখবে। যেই শ্রেণিতে বিরতির পর ওনার ক্লাস থাকে সেই ক্লাসে আবার নামাজের জন্য ধরা হতো। কেউ নামাজ না পড়লে তাকে মার খেতে হত।

নামাজের জন্য যেমন তার কোনো ছাড় নেই, তেমনি চুল/নখ এগুলো বড় করার কেউ সাহস পেত না। এক কথায় সবাই ওনাকে বাঘের মত ভয় পেত। যেই স্যারের ক্লাস ফাঁকি দেবে পরদিন তাকে খুঁজে বের করে শাস্তি দিত। বলতে গেলে পুরো মাদরাসা একটা নিয়মের মাধ্যমে চলতো তখন। সব কিছুতে শৃঙ্খলা বজায় ছিল।

যতই রাগী হোক কথা বলার সময় হাসিমুখে কথা বলতো। কারো নাম না জানলে তাকে তার পছন্দের নামে ডাকতো। তার মতো কেউ কখনো শাসন করবে না। মানুষ গড়ার কারিগর আমাদের এই ফোরকান স্যার। যিনি আজীবন তার ছাত্রদের মাঝে বেঁচে থাকবেন। মাদরাসা থেকে বিদায় নেওয়ার পর আগের সেই জৌলুশ আর মাদরাসায় নেই। নেই ভালো ফলাফলও।

মাদরাসা থেকে আলিম পাস করার পর অনার্স করার জন্য চট্টগ্রাম আসার পর একদিন স্যারের সাথে দেখা। দেখেই চিনে ফেলছে। হাসিমুখে জড়িয়ে ধরে খুব সুন্দর করে কথা বললো। মাদরাসায় যতই কঠোর হোক না কেন, বাইরে একজন সাদা মনের মানুষ।

[email protected]

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]