বঙ্গবন্ধুবিহীন মুক্তিযুদ্ধের কথা! কিসের বার্তা?

মো. মাহমুদ হাসান
ওদের কাছে কি কোনো বার্তা আছে? বদলে যাওয়া বা বদলে ফেলার বার্তা! রাস্তার দু’ধারে সারি সারি বৃক্ষরাজী শোভা বর্ধনের পাশাপাশি অক্সিজেন বিলিয়ে প্রকৃতিকে শান্ত রেখে মানবজাতিকে বাঁচিয়ে রাখে। হেমন্তের আগমনী বার্তায় সবুজ পত্ররাজী ধীরে ধীরে রূপ পাল্টাতে শুরু করে। দেখেই বোঝা যায়, শীত সমাগত। সময় যত গড়িয়ে চলে, সবুজ পত্ররাজী হলদে থেকে সোনালী রূপ ধারণ করে, এক সময়ে বৃক্ষদেবী তার সকল সৌন্দর্য হারিয়ে শুষ্ক ডালপালা নিয়েই দাঁড়িয়ে থাকে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে এমন কিছু চরিত্র আছে, যারা সব সময়ই ক্ষমতার কাছাকাছি থাকে, ক্ষেত্র বিশেষে তারা নীতিনির্ধারকও হয়ে উঠে। ক্ষমতার মধু আহরণে এরা সামনের কাতারে থাকলেও, পালাবদলের আগেই ওরা রূপ পাল্টাতে শুরু করে!
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে প্রবাসের মাটিতে কেমন যেন একটা তোড়জোড় শুরু হয়েছে। হতাশা, অনিশ্চয়তা নিয়ে যারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন, এরাও যেন দৃশ্যপটে আসতে শুরু করেছে। রূপ পাল্টে যারা আওয়ামী সেজে এতদিন চারদিক দাবড়িয়ে বেড়িয়েছেন, খোলস পাল্টাতে এদের কেউ কেউ প্রস্তুতি শুরু করেছে, প্রবাসের মাটিতে এরা রূপ পালটিয়ে এরই মধ্যে নতুন রূপ ধারণ করতে শুরু করেছে। এরা কি তাহলে নতুন কোনো আগমনী বার্তায় উজ্জীবিত হয়ে উঠছে? কি সেই বার্তা? গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিবর্তনের বার্তা দেওয়ার মালিক জনগণ, আর তার একমাত্র উপায় গণভোট। এখনো সেই গণভোটের বাকি এক বছর, তাহলে বসন্তের কোকিলদের মাঝে এত দৌড়ঝাঁপ কেন?
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দাতা নামের লগ্নিকারকদের দারুণ প্রভাব। সরকার ও রাজনীতিতে আড়ালে আবডালে তারা নানাভাবে কলকাটি নাড়ে। বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, উন্নয়ন অংশীদার বা দাতা পরিচয়ে তারা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির নানারকম কর্মকাণ্ড চালায়। সোজাসাপ্টা ভাষায় আমরা যাদের ডিপ্লোমেট বা কূটনীতিক নামে চিনি, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী তারা কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড নিয়ে সরব হওয়ার সুযোগ নেই। তবুও দারিদ্র্যতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের নীতি নির্ধারণী বিষয় নিয়েও তারা তৎপর হয়ে উঠে। মাঝে মধ্যে মানবাধিকারের নামে চাপাচাপির বার্তা চালায়।
মানবাধিকারের ফেরিওয়ালা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে মোড়লীপনার শীর্ষে থাকে। বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে নিষেধাজ্ঞা চলমান। প্রকৃত অর্থে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হলে, নিষেধাজ্ঞার খড়গ আসতেই পারে। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন স্বপরিবারে নির্মম নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হলো, তাদের মানবাধিকার তখন জাগ্রত হলো না!
একুশে আগস্ট ১৯৯৬ ভয়াবহ গ্রেনেড হামলায় আইভি রহমানসহ বাইশ জন নিহত হলেন, তিন শতাধিক নেতাকর্মীকে সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হলো, পার্লামেন্টারিয়াব আহসান উল্লাহ মাস্টার, আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন কূটনীতিক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া নিহত হলেন, তখনও এদের মানবাধিক জাগ্রত হলো না! সাঈদীকে চাঁদ দেখার গুজব রটিয়ে শত শত মানুষকে অগ্নিদগ্ধ করা হলো, ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটে অঙ্গার হয়ে অসার দেহ পড়ে থাকলো, তখনো তাদের মানবাধিকার জাগ্রত হলো না! আসলে ‘মানবাধিকার’ শব্দটি তাদের কাছে স্বার্থ সিদ্ধির এক মোক্ষম হাতিয়ার, সুযোগ বুঝে তারা হাতিয়ারকে সচল করে। তালেবানকে তারা একবার জঙ্গি সন্ত্রাসী বানায়, আবার সময়ের প্রয়োজনে তালেবানকে গলায় জড়িয়ে চুমু খায়। আফগানিস্তানের কর্মকাণ্ডই তার বড় প্রমাণ।
আজকাল বাংলাদেশে মানবাধিকারের ফেরিওয়ালারা বেশ সচল হয়ে উঠছে! জোটবদ্ধভাবে নানা রকম ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার প্রতিযোগিতা দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। আর এসব দেখে পরিবর্তন প্রত্যাশী একদল মানুষ বড় বেশি আশাবাদী হয়ে উঠছে। এরা ভাবছে, ইউক্রেন সংকটে দেশের অর্থনীতি যখন টালমাটাল হবে, বিদেশি প্রভূদের চাপে নাস্তানাবুদ শেখ হাসিনা তখন পরাভূত হতে বাধ্য হবে! পাশাপাশি পিনাকী, ইলিয়াস, নেত্র নিউজের মতো আজগুবি গল্পের নির্মাতারা তো রাতদিনই কাজ করছেন। একবার এরা ব্যাংকের ভোল্ট খালি করার গল্প বাঁধে, আর একবার সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেওয়ার গল্প শোনায়। আফগানিস্তানে যখন তালেবানরা ক্ষমতা পায়, সময় সমাগত ভেবে তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। শ্রীলঙ্কা হওয়ার স্বপ্নে সঙ্গী সাথীদের নিয়ে পাঁচ তারকা হোটেলে আয়েশি ডিনারে ব্যস্ত সময় পার করে!
এটি অনস্বীকার্য স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতি দুটি বৃহৎ ধারায় বিভক্ত। একাত্তরের পরাজয়ে একটি ধারা ম্রিয়মাণ হলেও পঁচাত্তর পরবর্তীতে সামরিক স্বৈরাচারদের ছত্রছায়ায় এরা ধারাবাহিকভাবে শক্তি সঞ্চয় করতে শুরু করে, ক্রমান্বয়ে সরকারের অংশীদারত্ব নিয়ে ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসবে মেতে উঠে। অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রীয় দর্শনকে পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পরিপন্থি রাষ্ট্র দর্শন বাস্তবায়নে উঠেপড়ে লেগে যায়। একুশ বছরে বিকৃত ইতিহাস জেনে গড়ে উঠে একটি প্রজন্ম। এই প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের বিকৃত ইতিহাস-ই সত্য রূপে আবির্ভূত হয়।
গত একযুগে একাত্তরের পরাজিত আদর্শের অনুসারী একদল সুবিধাবাদী রঙ পাল্টিয়ে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের সাথে মিশে গিয়েছিল। এই ধারাটি শুধু দেশে নয়, প্রবাসের মাটিতেও সক্রিয় ছিল। কূটনীতিকদের লম্ফ ঝম্ফ দেখে এরা আবারও রূপ পাল্টাতে শুরু করেছে। এতদিন জয়বাংলা বলে যারা হুঙ্কার ছেড়েছিল, বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানেও বঙ্গবন্ধুর নাম নিতে তাদের আপত্তি!
অগ্নিঝরা মার্চ, আর বিজয়ের ডিসেম্বর! এ মাস দুটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম অর্জনের মাস। তবুও, এ মাসগুলো সমাগত হলেই, যেন কিছু মানুষের হৃদয়ের দহন বেড়ে যায়! যন্ত্রণায় এদের এদের রক্ত টগবগিয়ে উঠে। অন্তরাত্মাকে শীতল করতে এরা প্রচণ্ড প্রতিশোধ পরায়ন হয়ে উঠে। নেকড়ের দল চারদিকে শিকারের খোঁজে সদলবলে মরিয়া হয়ে তৎপরতা চালায়। এর অন্তরালে কাজ করে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটিকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার এক সুদূর প্রসারী হীন প্রচেষ্টা।
এই ঘৃণ্য অপশক্তির প্রথম টার্গেট ছিল ১৫ই আগস্ট। স্বাধীন সার্বভৌম ভারতের উত্থানের সাথে বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের রয়েছে এক সুগভীর যোগসূত্র। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে বসবাস করেও বাংলাদেশের জন্মকে এখনো মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি, এমন মানুষের সংখ্যা দেশটিতে নেহায়েত কম নয়। ব্যর্থ রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রেমে এখনো এরা হাবুডুবু খায়, এই দুষ্ট চক্র সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধু আর তার পরিবারকে হত্যার জন্য ১৫ আগস্টকে বেছে নিয়েছিল।
একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস আমাদের জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দিন। পনেরো আগস্ট, ৩রা নভেম্বর বাঙালির ইতিহাসের কলঙ্কময় দিবস। প্রবাসে থাকলেও এসব দিবসে নিজেকে গুটিয়ে রাখতে পারি না। ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ থেকেই নানা অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার চেষ্টা করি। ২০২২ এর বিজয় দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল।
আয়োজকদের মতে, প্রবাসের নতুন প্রজন্মের মাঝে মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাসকে বিকশিত করাই তাদের লক্ষ্য ছিল। উপস্থিত বারো জন সংবর্ধিত মুক্তিযোদ্ধার একজন বাদে কেউই বঙ্গবন্ধুর কথা বলেননি! এ মহান নেতার নামটিও উচ্চারণ করেননি। সুকৌশলে বঙ্গবন্ধুকে এড়িয়ে চলার এমন হীন চেষ্টা দেখে বিস্মিত হয়েছি।
বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে সুবিধাবাদীদের মেরুকরণ নতুন কিছু নয়। কূটনীতিকদের লম্ফঝম্ফ দেখে কিছু সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশিদের মেরুকরণের প্রক্রিয়াটি বিস্ময় লাগছে। তবে কি বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের নীলনক্সা বহুদূর এগিয়ে গেছে? মার্কিনি অনুরোধকে উপেক্ষা করে বঙ্গবন্ধু কন্যা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করেছেন, বিশ্ব ব্যাংককে অবজ্ঞা করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু বাস্তবায়ন করেছেন, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, ফ্লাইওভারের মতো বড় বড় প্রকল্পের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে রাতদিন কাজ করছেন, তবুও চারদিকে এত ষড়যন্ত্র কেন?
সমাজ ব্যবস্থার বাস্তবতায় দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন আছে, রাজনীতিবিদ আর আমলাতন্ত্রের ভারসাম্য নিয়ে কথা বলার ব্যাপক সুযোগ আছে, কিন্তু ডিজিটালাইজেশন কিভাবে দুর্নীতির পথকে সংকুচিত করছে, সেটি নিয়ে কোনো আলোচনা নেই! এক্ষেত্রে শাসকদলের ব্যর্থতাকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। সন্তোষজনক না হলেও এ সরকারের আমলে, যত সংখ্যক হোমরা চোমড়াকে দুর্নীতি দমন কমিশনের মুখোমুখি হতে হয়েছে, অতীতের কোনো সরকারের আমলে কি এমন পরিসংখ্যান খুঁজে পাওয়া যাবে?
ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির নায়ক শাসক দলের ব্যাপক ক্ষমতাবান নেতাদের মুহূর্তে কপর্দকহীন করে শেখ হাসিনা তাদের আইনের মুখোমুখি করেছেন, ভূমি ব্যবস্থাপনায় ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়ায় আতঙ্ক গ্রস্ত হয়ে উঠছে দুর্নীতিবাজ চক্র, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণে রেল আর সড়ক যোগাযোগে বদলে যাচ্ছে দৃশ্যপট, পৃথিবীর বৃহত্তম সমুদ্র সৈকত অবধি বিস্তৃত হচ্ছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক, গড়ে উঠছে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দৃষ্টিনন্দন রেলওয়ে স্টেশনসহ বড় বড় মেগা উন্নয়ন প্রকল্প।
এত সবের পরেও ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে নেই। আবারও বঙ্গবন্ধুর নামটিকে মুছে দিতে দেশি-বিদেশি লম্ফ ঝম্ফ দৃশ্যমান হচ্ছে! স্বাধীন বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে ধারণ করেই এই ষড়যন্ত্রকে রুখতে হবে। যারা বঙ্গবন্ধুকে বিসর্জন দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, এরা দেশপ্রেমের ছদ্মবরণে একাত্তরের পরাজিত শক্তির সোল এজেন্ট, এদের রুখতেই হবে।
লেখক: কলামিস্ট, উন্নয়ন গবেষক ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক
এমআরএম/এমএস