‘টমাস চিঠিখানা তোমার মাকে দিও’

রহমান মৃধা
রহমান মৃধা রহমান মৃধা
প্রকাশিত: ১২:৪০ পিএম, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৩

ফোর্ট মায়ার সৈকতের সঙ্গেই ফিরোজ ভাই করেছে সুন্দর বাড়ি। আশপাশে সবুজে ভরা। বাড়ির বাগানে আম, জাম, কাঁঠাল, কলা, নারকেল, লিচু, আখ, শাকসবজি—সবকিছুতে ভরা।

সবাই খুব আনন্দ–ফুর্তির মধ্যে আছি। ফিরোজ ভাই ও সালমা ভাবির আদর-যত্ন মুগ্ধ করে তুলেছে। ফিরোজ ভাই এবং সালমা ভাবি সুইডেনে এক কনফারেন্সে এসেছিলেন স্টকহোমে। তাই সবাই সবাইকে চেনা জানার কারণে মেলামেশাটা জমে উঠেছিল তখন।

ফোর্ট মাইয়ারের পারে গড়ে উঠেছে লি কাউন্টি শহর যেখানে ফিরোজ ভাইয়ের ক্লিনিক। আমরা শহর ঘুরতে হঠাৎ চোখে পড়ে গেলো বিজ্ঞানী টমাস এডিসনের বাগানবাড়ি। এডিসন অন্ধকার জগতে আলোর সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন বাল্ব আবিষ্কার দিয়ে। টমাস এডিসনের আদি বসতবাড়ি ওয়েস্ট অরেঞ্জ, নিউ জার্সিতে। তবে জীবনের অনেক সময় এবং শেষের বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন এই ফ্লোরিডাতে।

পাঠক কেন আজ হঠাৎ এসব কথা? দীর্ঘদিন ধরে আমি লেখালেখি করছি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে এবং তাদের বর্তমান সমস্যার কথা তুলে ধরার চেষ্টা করছি নানাভাবে, যাতে করে তাদেরও ভাগ্যের পরিবর্তন হয়। প্রতিবন্ধী হতে পারে বা দিতে পারে পরিবর্তন করে গোটা বিশ্বকে, যদি তারাও একটু সহানুভূতি পায়। এমন ঘটনা পৃথিবীতে রয়েছে যা জানা বা অজানা থাকতে পারে।

যাই হোক না কেন, আজ বলব আমার ফোর্ট মাইয়ারে লি কাউন্টি শহরের ওপর গড়ে ওঠা টমাস এডিসনের রহস্যময় জীবনকাহিনির একটু অংশ এবং তার বাগানবাড়ি ভ্রমণের গল্পের সঙ্গে বাল্ব আবিষ্কার নিয়ে কিছু কথা।

টমাস আলভা এডিসনের জন্ম ১১ ফেব্রুয়ারি ১৮৪৭, মৃত্যু ১৮ অক্টোবর ১৯৩১। টমাস বিশ্বের মানব কল্যাণে এবং বিশ্বের কলকারখানাতে রেভল্যুশন সৃষ্টি করেছিলেন ইলেকট্রিক বাল্ব তৈরি করে। টমাস স্কুল জীবন শুরু করেছে। বেশিদিন না যেতেই স্কুলের শিক্ষক তার হাতে একটি চিঠি তুলে দিয়ে বলেছিল, ‘টমাস চিঠিখানা তোমার মাকে দেবে।’

টমাস বাড়িতে এসে তার মার হাতে চিঠি দিতেই মা তৎক্ষণাৎ পড়তে শুরু করেন। টমাসের মায়ের চোখ ভরা জল যা শুধু ঝরছে। চোখে জল দেখে টমাস মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তোমার চোখে জল কেন? তুমি কাঁদছ কেন? কী এমন কথা লিখেছে যে তুমি কাঁদছ?’ মা চোখ মুছে টমাসকে বলে, বাবা আমার গর্ব লাগছে তোমার শিক্ষকের চিঠি পড়ে।

কী লিখেছেন শিক্ষক? লিখেছেন তুমি তোমার স্কুলের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র, তারা তোমাকে যুগোপযোগী এবং তোমার প্রয়োজন মতো শিক্ষা দিতে পারবেন না। কারণ, তেমন যোগ্যতাসম্পন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা তাদের নেই, এমনকি যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকও নেই। তাই তারা লিখেছে, আমি তোমার একমাত্র শিক্ষক এবং মা, যে পারবে তোমাকে সুশিক্ষা দিতে।

প্রথম পর্ব পড়ুন এখানে 

টমাস বলেছিল তার মাকে, তাহলে তো ভালোই হবে মা, আমি তোমার থেকে শুধু ভালোবাসা নয় এখন থেকে প্রশিক্ষণও পাব। কী মজাই না হবে! টমাস শুধু শিক্ষা নয়, সুশিক্ষা পেয়েছিল জীবনে। পৃথিবীর অন্ধকারকে আলোময় করেছিলেন তিনি, তার ইলেকট্রিক বাল্ব তৈরি করে। অনেক বছর পার হয়েছে, তার মা মারা গেছেন। আজ হঠাৎ তার কেন একটু অস্থিরতা লাগছে, টমাস পুরনো স্মৃতিচারণার সঙ্গে খুঁজছে ঘরের অনেক পুরনো কাগজপত্র।

jagonews24

হঠাৎ আলমারির কোণে তার নজরে পড়ে ছোটবেলা তার মাকে দেওয়া শিক্ষকের সেই চিঠি। টমাস চিঠিখানা খুলে পড়তে অবাক, হতভম্ব এবং দিশাহারা হয়ে পড়েন। মা যা তাকে বলেছিল, তার কোনো কথাই তো এখানে লেখা নেই। স্কুলশিক্ষক লিখেছিল, তোমার ছেলে প্রতিবন্ধী, সে খুবই দুর্বল সব বিষয়ে, তাকে দিয়ে শিক্ষা হবে না। তাই পারলে তুমি নিজেই তোমার ছেলের দায়িত্ব নাও। আমরা পারব না এমন গাধাকে শিক্ষা দিতে।

শিক্ষকের ওই কথা বিশ্বাস করেনি টমাসের মা সেদিন। স্কুলশিক্ষক সেদিন টমাসের জীবনের আলোর ইতি ঘটিয়েছিলেন কিন্তু টমাসের মা তা হতে দেননি সেদিন, বরং দিয়েছিলেন সেদিন হৃদয় ভরে বিশ্বাস আর আশ্বাস টমাসের জীবনে। এক বিস্ময়কর মা এবং তার চমৎকার নেতৃত্ব দিয়েছিল দ্বীপ জ্বেলে টমাসের জীবনে।

ফোর্ট মাইয়ারে টমাসের বাড়িতে তার ডাইরি পড়তে চোখের জল এসেছিল এবং মনে পড়ে গেলো লাখো প্রতিবন্ধীদের কথা। অনেক মধুর স্মৃতি জড়িত রয়েছে এই শহরকে এবং মিয়ামিকে ঘিরে, তারপর অনেক দিন ধরে আলেক্স ধরেছে আমাদের নিয়ে যাবে কি-ওয়েস্টে, যেখানে প্রথম মিলন হয়েছিল দুজনার দুজনায়। আলেক্সের মুখে তন্ময় হয়ে শুনলাম তার হাভানা থেকে কি-ওয়েস্টে আসতে নৌকাভ্রমণের ভয়ংকর কাহিনি, শুনলাম সাগরের বর্ডারগার্ড পুলিশের সঙ্গে প্রথম দর্শনের বর্ণনা।

গত বছর এ সময় আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে গেছি। এবার মেয়ে জেসিকা পরিকল্পনা করেছে ছুটিতে মিয়ামি ভ্রমণের। জেসিকার সঙ্গে তার সেই বাল্যবন্ধু ভেন্ডেলাও যাবে। এ খবরে ছোট বোন জলিও পরিকল্পনা করেছে আসবে মিয়ামিতে। এর মধ্যে আমার এলাকার এক ছোট ভাই, অমীয় দাশ (ফার্মাসিস্ট, ওষুধ প্রস্তুতকারক, বোকা রেতন, যুক্তরাষ্ট্র), সেও জেনেছে আমরা আসছি, সেও একটি ছোটখাটো প্ল্যান রয়েছে আমাদের ঘিরে।

সব জল্পনা–কল্পনা শেষে গত ২৮ নভেম্বর সকালে গাড়ি করে স্টকহোম আরলান্ডা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিতেই সুইডেনের কনকনে শীত সঙ্গে মারাত্মক তুষারপাতের কবলে পড়লাম।

যেমন ঠান্ডা তেমন বাতাশ এবং প্রচন্ড তুষারপাত, সব মিলে প্লেন ছাড়তে চার ঘণ্টা বিলম্ব। প্লেনে সবাই চুপচাপ বসে আছে, সঙ্গে আমরাও। চার ঘণ্টা দেরির কারণে কানেক্টিং ফ্লাইট কোপেনহেগেন থেকে বাতিল হয়ে গেলো, স্টকহোমে থাকতেই। পরবর্তী ফ্লাইট সাড়ে তিনটায় কোপেনহেগেন টু মিয়ামি, এমনটি আশ্বাস দিয়ে প্লেন উড়াল দিলো। যথা সময়ে কোপেনহেগেনে পৌঁছে ফাইনাল চেকআপ সেরে রওনা দিলাম মিয়ামির উদ্দেশ্যে। টানা ১০ ঘণ্টা পর মিয়ামি লোকাল টাইম রাত সাড়ে ৮টায় মিয়ামি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম।

উবার ধরে আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে হাজির হতেই কেয়ারটেকার সব কিছু বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলো। সুইডেন থেকে মিয়ামির সময়ের ব্যবধান ৬ ঘণ্টা বিধায় মিয়ামির রাত ৮:৩০ আমাদের কাছে রাত আড়াইটা। কিছুক্ষণ ঘুমের পর উঠে দেখি সকাল ৯টা বেজে গেছে। বড় বড় জানালার পর্দা সরিয়ে দেখি মহাশূন্যের ওপর বসবাস, যার একদিকজুড়ে রয়েছে আটলান্টিক মহাসাগরের ভিউ, অন্য দিকগুলোজুড়ে রয়েছে আকাশছোঁয়া ভবন। সকালে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গেলাম খাবারের সন্ধানে, দেখার সন্ধানে, সাগরের সন্ধানে। এবারের ভ্রমণে জেসিকা আমাদের ট্যুর গাইড।

ছুটি শুরু হয়েছে কেনাকাটির মধ্য দিয়ে। কারণ, ওয়েদার মনঃপূত নয়, আকাশ মেঘে ঢাকা। সাগরে গোসল হয়নি আজ, তাই সারাদিন দোকান ঘোরা এবং কেনাকাটার মধ্য দিয়ে দিনটি গেছে। সবকিছুর দাম চড়া, যুদ্ধ এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণেই এটা হয়েছে। সবাই মোটামুটি কিছু না কিছু কিনেছে। ছোট বোন জলি এসেছে, সকালে মিয়ামি সৈকতে যাব এবং গোসল করব এমনটি পরিকল্পনাও রয়েছে। শপিং মল ছাড়াও শহরটি হেঁটে হেঁটে ঘুরেছি।

মাঝে মধ্যে ভিডিও করে ফেসবুকেও দিয়েছি। একটা জিনিস কিছুতেই মেলাতে পারিনি, সেটা হলো এত নারকেলগাছ অথচ ডাব পাওয়া দুষ্কর। তবে বটগাছের দেখা মিলেছে এখানে এসে। দেখে মনে পড়ে গেলো ‘কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো—কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।’

নদীর পরিবর্তে আটলান্টিক মহাসাগর এটাই শুধু পার্থক্য। যাই হোক দিন শেষে সন্ধ্যা তারপর রাত, ডিনারের সন্ধানে। কে কী খাবে, এটা একটা জটিল বিষয়।

চলবে...

এমআরএম/জিকেএস

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]