অভিবাসী শ্রমিক শোষণে ক্ষুণ্ন হচ্ছে মালয়েশিয়ার ভাবমূর্তি

আহমাদুল কবির
আহমাদুল কবির আহমাদুল কবির , মালয়েশিয়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০৩:৩১ পিএম, ৩০ জানুয়ারি ২০২৪
ছবি: সংগৃহীত

অভিবাসী শ্রমিক শোষণে ক্ষুণ্ন হচ্ছে মালয়েশিয়ার ভাবমূর্তি। মালয়েশিয়ার আইনজীবীরা বলছেন, সমস্যা অব্যাহত থাকলে বিদেশি কর্মীদের প্রতিনিধিত্বকারী দূতাবাসগুলো মালয়েশিয়ায় নিজ দেশ থেকে কর্মী সরবরাহের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে।

সোমবার (২৯ জানুয়ারি) দ্য সান ডেইলি পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে, মালয়েশিয়ায় জোরপূর্বক শ্রমের অভিযোগ পুরনো যা ২০২০ এবং ২০২২ এর মধ্যে গুরুতরভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। বিশেষত রাবার গ্লাভস এবং পাম অয়েল সেক্টরে বিষয়টি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে মালয়েশিয়ার পণ্যগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের বাজারে বিক্রি করতে বাধা দেওয়া হয়েছিল।

আইনজীবীরা জোরপূর্বক শ্রমের বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে সরকারকে সতর্ক করেছে যে, অভিবাসী শ্রমিক শোষণ অব্যাহত থাকলে, এ ধরনের কর্মকাণ্ড মালয়েশিয়ার জন্য উচ্চ ঝুঁকি তৈরি করছে। এ রকম ঘটতে থাকলে বিদেশি শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী দূতাবাসগুলো সত্যায়ন বা প্রত্যয়ন বন্ধ করে নিজ দেশে রিপোর্ট দিতে পারে।

দেশটির ফৌজদারি ও বেসামরিক আইনজীবী সেলিম বশির বলেন, শোষণমূলক চর্চা ২০২৩ সাল পর্যন্ত ব্যাপকভাবে অব্যাহত ছিল, যা গত ২০ ডিসেম্বরের ঘটনা দ্বারা প্রমাণিত হয়, যখন ১৭১ জন বাংলাদেশিকর্মী পুলিশ রিপোর্ট করে দাবি করে রিক্রুটিং এজেন্টরা আগমনের তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে তাদের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে।

‘প্রতিক্রিয়ায় তাদের নিয়োগকর্তাদের কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিয়োগকর্তার অবশিষ্ট কোটা প্রত্যাহার করা হয়েছে।’

সেলিম বলেন, এ ধরনের সমস্যাগুলো মোকাবিলা করতে এবং শ্রমিকদের অধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ব্যাপক এবং টেকসই প্রচেষ্টার প্রয়োজন।

তিনি বলেন, দেখা গেছে বাংলাদেশি কর্মীরা দীর্ঘ কাজের সময়, অপর্যাপ্ত বিশ্রাম, নিম্নমানের জীবনযাত্রা, নিম্ন মজুরি, জোরপূর্বক শ্রম এবং পাসপোর্ট বাজেয়াপ্তসহ বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে।

সেলিম বলেন, কর্মীরা কর্মসংস্থান এজেন্টদের প্রতারণার শিকার হয় যারা ভালো বেতন এবং সুযোগের প্রতিশ্রুতি দেয়, অথবা তৃতীয় পক্ষের (দালাল) দ্বারা মিথ্যা আশ্বাসের শিকার হয়। অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণ প্রশমিত করার জন্য সরকারি প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আইন প্রণয়নের ক্রমাগত ফাঁক, প্রয়োগের ত্রুটি এবং অন্যান্য বাধাগুলো তাদের আইন প্রয়োগ করার ক্ষমতাকে বাধাগ্রস্ত করে।

তিনি বলেন, নিয়োগকর্তা এবং নিয়োগকারী এজেন্টদের ওপর আরও কঠোর শাস্তি আরোপ করা উচিত। বিশেষ করে যারা শ্রমিকদের পাসপোর্ট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আটকে রাখে।

অভিবাসী কর্মীদের কর্মক্ষেত্র নিয়মিত পরিদর্শনকে অগ্রাধিকার দেওয়া কঠোর প্রবিধান এবং নিয়োগ নীতি কার্যকর করার মতোই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন এ আইনজীবী।

এছাড়াও অভিবাসী কর্মীদের মধ্যে আইনি সচেতনতা বৃদ্ধি করা অপরিহার্য কারণ এটি নিশ্চিত করতে হবে যে তারা মালয়েশিয়ার আইনের মধ্যে তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন আছে।

বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়া গমনের আগে কর্মীদের গন্তব্য দেশের আইন-কানুন রীতিনীতি সম্পর্কে সরকারিভাবে ব্রিফিং দেওয়া হয়। তবে বিমানে উঠবার প্রাক্কালে এ ধরনের ব্রিফিং কর্মীকে প্রকৃত সমৃদ্ধ করে না বলেই বাস্তবে দেখ যায়। অনেককর্মী প্রেরণকারী রিক্রুটিং এজেন্টের নাম, নিয়োগকারী কোম্পানির নাম এবং নিয়োগ চুক্তিতে কী লেখা, কোন সেক্টরের কাজ, বেতন সম্পর্কে বলতে পারে না।

এমন কি দেখা গেছে নতুন কর্মী কাজ ও বেতন সম্পর্কে এমন তথ্য দেয় যা তার নিয়োগ চুক্তির সঙ্গে মেলে না। অর্থাৎ এরা প্রতারণার মধ্যে বিদেশ যাত্রা শুরু করে! ভুল ধারণা দিয়ে বেশি অর্থ খরচ ও খারাপ অবস্থায় নিপতিত হতে প্রলুব্ধ করার পুরনো অভিযোগ রয়েছে।

আইনজীবী দাতুক শঙ্করা নারায়ণন নায়ার, যিনি করপোরেট এবং বাণিজ্যিক আইনে বিশেষজ্ঞ, অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণ ও দুর্ব্যবহার মোকাবিলা করার জন্য বলেছেন, আইনি পেশাদাররা এনজিও, নাগরিক সমাজ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সহযোগিতা করতে পারে।

তিনি বলেন, তারা এমন সেক্টরগুলোতে ফোকাস করতে পারে যেখানে শোষণের উচ্চ প্রবণতা রয়েছে, যেমন উৎপাদন, নির্মাণ এবং পরিষেবা শিল্প। বার কাউন্সিলকে অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণের বিষয়টি দেখার জন্য সক্রিয়ভাবে উপ-কমিটি গঠন করা উচিত।

তিনি বলেন, উপ-কমিটি অভিবাসী শ্রমিকদের বিনামূল্যে আইনি পরামর্শ দিতে পারে এবং তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করতে পারে। লক্ষ্যযুক্ত সহযোগিতা এবং সেক্টর অনুযায়ী নির্দিষ্ট উদ্যোগের মাধ্যমে আইন পেশাজীবীরা শোষণের মূল কারণগুলোকে মোকাবিলা করতে এবং অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য ব্যাপক সুরক্ষা প্রদানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

দেখা গেছে, অভিবাসী কর্মীরা নিয়োগকর্তা বা এজেন্টের বা দালালের শোষণের মধ্যে আতঙ্কিত অবস্থায় থাকে প্রকৃত সমস্যার কথা বলে না এবং বলার পরে অনেকের চাকরি গেছে, দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

শঙ্করা বলেন, অভিবাসী কর্মীদের যেখানে সেখানে থামিয়ে ডকুমেন্ট পরীক্ষা করার চলমান পদ্ধতি কর্মী ব্যবস্থাপনার অদক্ষতা এবং ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগনীতি থেকে উদ্ভূত হয়েছে। নীতিমালা সংশোধনের মাধ্যমে অন্তর্নিহিত কারণগুলোকে মোকাবিবেলা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে কাজ করেন জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিক এটিএন বাংলার কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ও ভালো সংবাদের সম্পাদক কেরামত উল্লাহ বিপ্লব বলেন, মালয়েশিয়ার আইনজীবী সমাজ শ্রম শোষণ এবং অব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সরকারকে সচেতন হতে পরামর্শ দিয়েছে এবং দেশের সুনামের স্বার্থে নিজেরা উদ্যোগ নিয়েছে এটা মানবতার জন্য খুব ভালো উদ্যোগ। একইসাথে বাংলাদেশ থেকে কর্মী প্রেরণের পূর্বে নিয়োগকর্তার সক্ষমতা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হবে।

তিনি বলেন, অভিবাসী কর্মীকে নিয়োগ চুক্তি সম্পর্কে আগেই শিক্ষিত করে পরে স্বাক্ষর নিয়ে প্রেরণ করা গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে দেশ ত্যাগের আগেই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এবং কর্মীরা বিদেশে খারাপ অবস্থায় পড়বে না। জি-টু-জি প্লাসের কর্মীদের নিয়ে কাজ না পাবার কাহিনি শোনা যায়নি। তার মানে সে সময় বাংলাদেশ নিশ্চিত হয়েই কর্মী প্রেরণ করেছিল।

এমআরএম/এএসএম

প্রবাস জীবনের অভিজ্ঞতা, ভ্রমণ, গল্প-আড্ডা, আনন্দ-বেদনা, অনুভূতি, স্বদেশের স্মৃতিচারণ, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেখা পাঠাতে পারেন। ছবিসহ লেখা পাঠানোর ঠিকানা - [email protected]