ইসলামের প্রথম খলিফা: যার অবদান অবিস্মরণীয়

ইসলাম ডেস্ক
ইসলাম ডেস্ক ইসলাম ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৬:৪৯ পিএম, ১৯ জানুয়ারি ২০২৩

ফখরুল ইসলাম নোমানী

জমাদিউস সানি হিজরি সালের ৬ষ্ঠ মাস। এ মাসের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এ ছাড়া প্রথম ইসলাম গ্রহণকারী, প্রথম খলিফা এবং হজরত মুহাম্মদের (সা.) অনন্তসঙ্গী ও প্রিয় সাহাবি হজরত আবু বকর সিদ্দীকের (রা.) ওফাত হয় এ মাসের ২২ তারিখে। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) ৫৭৩ সালে মক্কার কুরাইশ বংশের বনু তাইম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম আবু কোহাফা ও মায়ের নাম সালমা বিনতে সাখার।

মুসলিম বিশে দিবসটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা নিষ্প্রয়োজন। মহানবী হজরত মুহাম্মদের (সা.) সব কথা ও ঘটনা সর্বপ্রথম যিনি বিনা বাক্যে এবং বিনা দ্বিধা-সংকোচে সত্য বলে স্বীকার করেছিলেন, হুজুরের (সা.) পবিত্র জবানে তাকে সিদ্দীক উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন এবং তিনিই যাকে আফজালুল বাশার বা মানব শ্রেষ্ঠ আখ্যায়িত করেছিলেন। তার পবিত্র জীবনাদর্শ আলোচনা-স্মরণ করার জন্য কোনো বিশেষ দিন-তারিখ বা সময় নির্দিষ্ট করারও প্রয়োজন পড়ে না। সব সময়ই তার আদর্শের কথা স্মরণ করা প্রত্যেক মুসলমানের নৈতিক দায়িত্ব। তথাপি বলতে হয় হজরত আবু বকর সিদ্দীকের (রা.) ওফাত দিবসটি কেবল মুসলমানদের জাতীয় পর্যায়ে নয় আন্তর্জাতিক পর্যায়েও যথাযথ মর্যাদায় পালিত হওয়ার দাবি রাখে।

নবি (সা.) হজরত আবু বকরের (রা.) পরিচয় দিয়েছেন এবং প্রশংসা করেছেন এভাবে: রাসুলুল্লাহকে (সা.) প্রশ্ন করা হয়, আপনার দৃষ্টিতে কে সবচেয়ে বেশি প্রিয়? তিনি বলেন আয়েশা (রা.)। লোকেরা আরজ করলেন, আমাদের উদ্দেশ্য পুরুষদের মধ্যে কে? হুজুর (সা.) বললেন, তার (আয়েশার) পিতা। রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রায় বলতেন, যারা আমার প্রতি কোনো প্রকারের এহসান বা উপকার করেছে, আমি তাদের প্রতিদান দিয়েছি আবু বকর (রা.) ব্যতীত। আমার উপর তার বিরাট উপকার রয়েছে, তার প্রতিদান কেয়ামতের দিন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা দেবেন। রাসুলুল্লাহর (সা.) বক্তব্যের ব্যাখ্যা অপর একটি উক্তিতে বিদ্যমান। তিনি বলেন, আমার প্রতি কারো উপকার আবু বকর (রা.) অপেক্ষা বেশি নয়। তিনি তার জান-মাল দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন। উপরন্তু তার কন্যাকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন।

উম্মুল মোমেনিন হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, একরাত আসমানে নক্ষত্ররাজি ঝকঝক করছিল। আমি নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রসূল! আপনার উম্মতের মধ্যে কারো নেকি বা পূণ্য কি আসমানের তারকারাজির সমান হবে? তিনি বললেন, হ্যাঁ আয়েশা! উমর ফারুকের (রা.) পূণ্যগুলো আসমানের তারকারাজির সমান হবে। হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমার ধারণা ছিল যে হুজুর (সা.) আমার আব্বাজানের নাম উল্লেখ করবেন। আমি প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! তাহলে আমার আব্বাজানের? হুজুর বললেন, বিচলিত হওয়ার কিছু নেই আয়েশা! আবু বকরের (রা.) কেবল হিজরত রজনীর পূণ্যগুলো উমরের (রা.) সমগ্র জীবনের পূণ্যগুলোর বেশি হবে।

হজরত আবু বকর সিদ্দীকের (রা.) পক্ষে হুজুরের (সা.) নৈকট্য লাভের যত সুযোগ হয়েছিল, তিনি হুজুরের (সা.) প্রকাশ্য ও গোপন বিষয়াদি সম্পর্কে যত বেশি অবহিত ছিলেন এবং হুজুরের (সা.) প্রতি তার যে গভীর আস্থা ও বিশ্বাস ছিল, তা আর কারো ছিল না। রাসুলুল্লাহ (সা.) গভীর রাত পর্যন্ত তার কাছে বসে মুসলমানদের সমস্যাবলী এবং বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করতেন এবং অধিকাংশ সময় তার পরামর্শকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করতেন। বস্তুত যদি কেউ এ বিষয়ের যোগ্য হতো যে হুজুরের (সা.) দৃষ্টিতে সে অতিপ্রিয়, তা হলে হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) এ বিষয়ে সবচেয়ে যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন। হুজুরের (সা.) কাছে তিনি কত উচ্চ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন, হুজুরের (সা.) উল্লেখিত কয়েকটি উক্তি ও মন্তব্য হতে তা সহজে অনুমান করা যায়। রাসুলুল্লাহর (সা.) কাছে এত বড় মর্যাদার অধিকারী আর কোনো সাহাবি ছিলেন না।

তিনি ছিলেন তাঁর গোত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয়, বন্ধুবৎসল ও অমায়িক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী, দানশীল ও চরিত্রবান। জাহেলি যুগেও কখনো শরাব পান করেননি। তাঁর অমায়িক মেলামেশা, পাণ্ডিত্য ও ব্যবসায়ীক দক্ষতার কারণে অনেকেই তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব ও সখ্য স্থাপন করতেন। তাঁর বাড়িতে প্রতিদিন মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়মিত বৈঠক বসতো।

প্রথম খলিফা আমিরুল মোমেনিন হজরত আবু বকরের (রা.) দুটি উপাধি সর্বাধিক পরিচিত আবু বকর এবং সিদ্দীক এ দুটি উপাধি জাহেলিয়াত ও ইসলাম উভয় যুগেই সর্বাধিক পরিচিতি লাভ করে। তার অপর একটি উপাধি ছিল আতিক। অতি সুন্দর খুবসুরতকে আতিকও বলা হয়। হজরত আবু বকর (রা.) ছিলেন অতি সুদর্শন-সুন্দর। আবার এ কথাও বলা হয় যে, শব্দটির মূল হচ্ছে ‘ইতক’ যার মানে হচ্ছে ‘আজাদ করা’। এদিক থেকে আতিক মানে আজাদ বা মুক্ত। তার পিতা আবু কোহাফা (রা.) কর্তৃক এ নামকরণের কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে যে, তাদের কোনো সন্তান জীবিত থাকত না। আবু বকর (রা.) যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন তার পিতা তাকে কোলে করে কেবলামুখী হয়ে দোয়া করেছিলেন, যার মর্ম এই, হে আল্লাহ! এই সন্তান তোমার দোজখ হতে আজাদ বা মুক্ত। তুমি তা আমাকে দান করো।

তাছাড়া কোনো কোনো বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, জাহেলিয়া যুগে হযরত আবু বকরের (রা.) নাম ছিল আবদুল কাব। কিন্তু ইসলাম যুগে এই নাম পরিবর্তন করে আব্দুল্লাহ রাখা হয়। হুজুর (সা.) তার আতিক নামটি একারণেই অক্ষুণ্ন রাখেন যে, হুজুর তাকে আগুন থেকে মুক্ত বলে সুসংবাদ জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ আশারায়ে মোবাশশারা বা জীবদ্দশায় যে দশজন বেহেশতের সুসংবাদ প্রাপ্ত, হজরত আবু বকর (রা.) তাদের মধ্যে প্রথম।

হজরত আবু বকরের (রা.) জীবনকে দুইভাগে ভাগ করা হয়; ইসলামের পূর্বে ও পরের যুগ। মুসলমান হওয়ার পূর্বে তিনি যেমন আরবের সম্মানিত সন্তান ও নানা গুণের অধিকারী ছিলেন; তেমনি ইসলাম গ্রহণের পরও তিনি বহুক্ষেত্রে উচ্চ সম্মান ও শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হন। তিনি জাহেলি যুগের আরবে প্রচলিত পাপাচারে কখনো লিপ্ত হননি। ইসলামের আবির্ভাবের এক বছর পূর্বে রাসুলুল্লাহর (সা.) খেদমতে তার আসা-যাওয়া হতে থাকে এবং ইসলাম গ্রহণের পর তিনি হুজুরের (সা.) নির্দেশে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। বদর, ওহুদ ও হুনায়েন যুদ্ধে তার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার দৃষ্টান্ত বিরল। তাবুক যুদ্ধের সময় হজরত আবু বকর (রা.) তার ঘরের সমস্ত সম্পদ হুজুরের (সা.) খেদমতে হাজির করেন। হুজুর (সা.) জিজ্ঞাসা করেন, পরিবার-পরিজনের জন্য তুমি কী রেখে এসেছো? জবাবে বললেন, আল্লাহ ও তার রাসুলকে রেখে এসেছি।

ইসলামের জন্য হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) তার মাল-দৌলত কতটা অকাতরে দান করতেন, তার আরেকটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হজরত ইবনে উমর (রা.) বর্ণনা করেন, উম্মুল মোমেনিন হজরত আয়েশার (রা.) মহান পিতা যখন ইসলাম গ্রহণ করেন, তখন তার কাছে বাণিজ্যিক আসবাবপত্র ছাড়া চল্লিশ হাজার দীনার মওজুদ ছিল। কিন্তু মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসার, দরিদ্র মুসলমানদের সাহায্য এবং অত্যাচারী প্রভাবশালী কোরায়েশদের গোলামি থেকে মুসলমানদের মুক্তির জন্য সে সময় পর্যন্ত ৩৫ হাজার দীনার ব্যয় করেছিলেন। তাছাড়া মসজিদে নববির জমিও তিনি নিজের অর্থ দিয়ে খরিদ করে ওয়াকফ করে দেন।

হজরত আবু বকর সিদ্দীকে (রা.) সৌভাগ্য হয়েছিল যে, হুজুর (সা.) তাকে হিজরি নবম সালে নিজের প্রতিনিধি রূপে আমিরুল হজ মনোনীত করে মক্কায় পাঠান এবং ইন্তেকালের পূর্বে তিনি ১৭ ওয়াক্ত নামাজের ইমামতি করেন। তার শ্রেষ্ঠত্বের কথা পবিত্র কোরআনের ১৭টি স্থানে ইশারা-ইঙ্গিতে বলা হয়েছে। তিনি ছিলেন উজ্জ্বল গৌরবর্ণ, পাতলা ছিপছিপে ও প্রশস্ত ললাট বিশিষ্ট। শেষ বয়সে চুল সাদা হয়ে গিয়েছিল। মেহেদির খিজাব লাগাতেন। অত্যন্ত দয়ালু ও সহনশীল ছিলেন।

রাসুলুল্লাহর (সা.) ওফাতের পর মুসলমানগণ আমিরুল মোমেনিন ও খলিফা হিসেবে হজরত আবু বকর সিদ্দীককে (রা.) মনোনীত করেন। তার খেলাফত কাল ছিল দুই বছর তিন মাস ১১ দিন। খেলাফতের এ গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রহণের পর তিনি সর্বপ্রথম যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন, সেগুলো হচ্ছে প্রথমত জাকাত অস্বীকারকারীদের বিরুদ্ধে জেহাদ। দ্বিতীয়ত নবুওয়াতের মিথ্যা দাবিদারদের মূলোৎপাটন। তৃতীয়ত মুরতাদ দমন। তাছাড়া কোরআন সংকলন ও হুজুর (সা.) কর্তৃক সর্বশেষ ঘোষিত ওসামা অভিযান পরিচালনা করা, যা হুজুরের (সা.) ওফাতের কারণে স্থগিত হয়ে গিয়েছিল। তাঁর যোগ্য নেতৃত্বের ফলে খুব সহজেই ধর্মত্যাগীদের ফেতনা দমন করা সম্ভব হয়। ইসলামের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রা.) ৬৩৪ সালে ইন্তেকাল করেন। মহানবি হজরত মুহম্মদের (সা.) পাশে তাঁকে দাফন করা হয়।

ইসলামি খেলাফতের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দীক (রা.) মাত্র আড়াই বছরের খিলাফতের সময়টুকু ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হয়। ইসলামের এই প্রথম খলিফা ও প্রথম মুসলিম পুরুষ ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ আছেন।

লেখক: ইসলামি গবেষক ও কলামিস্ট।

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।