তারাবিহের আলোচনা
আরশের ধনভান্ডার পাওয়ার দোয়া পড়া হবে আজ

১৪৪৪ হিজরির রমজান মাসের দ্বিতীয় তারাবিহ আজ। আজকের তারাবিতে সুরা বাকারার ২০৪ আয়াত থেকে শেষ পর্যন্ত এবং সুরা আল-ইমরানের শুরু থেকে ৯১ আয়াত পর্যন্ত তেলাওয়াত করা হবে। আজকের তারাবিহতে পড়া হবে আরশের ধনভান্ডার পাওয়ার দোয়াসহ ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধান।
ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিধানাবলীর পাশাপাশি আজকের তারাবিহতে পড়া হবে অনেক দোয়া। ধারাবাহিকভাবে অর্থসহ দোয়াগুলো তুলে ধরা হলো-
ধৈর্য ধারণের দোয়া
رَبَّنَآ أَفْرِغْ عَلَيْنَا صَبْرًا وَثَبِّتْ أَقْدَامَنَا وَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكٰفِرِين
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ধৈর্যধারণের শক্তি দান কর এবং আমাদের পদগুলো দৃঢ় রেখ এবং কাফির দলের উপর আমাদেরকে জয়যুক্ত কর।’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৫০)
আয়াতুল কুরসি
اللَّهُ لَآ إِلٰهَ إِلَّا هُوَ الْحَىُّ الْقَيُّومُ ۚ لَا تَأْخُذُهُۥ سِنَةٌ وَلَا نَوْمٌ ۚ لَّهُۥ مَا فِى السَّمٰوٰتِ وَمَا فِى الْأَرْضِ ۗ مَن ذَا الَّذِى يَشْفَعُ عِندَهُۥٓ إِلَّا بِإِذْنِهِۦ ۚ يَعْلَمُ مَا بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَمَا خَلْفَهُمْ ۖ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَىْءٍ مِّنْ عِلْمِهِۦٓ إِلَّا بِمَا شَآءَ ۚ وَسِعَ كُرْسِيُّهُ السَّمٰوٰتِ وَالْأَرْضَ ۖ وَلَا يَـُٔودُهُۥ حِفْظُهُمَا ۚ وَهُوَ الْعَلِىُّ الْعَظِيمُ
‘আল্লাহ, তিনি ছাড়া সত্যিকারের কোন উপাস্য নেই, তিনি চিরঞ্জীব, সর্বদা রক্ষণাবেক্ষণকারী। তাঁকে তন্দ্রা ও নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে, তাঁরই। কে সেই ব্যক্তি যে তাঁর অনুমতি ছাড়া তাঁর নিকট সুপারিশ করে? তিনি লোকদের সমুদয় প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য অবস্থা জানেন। পক্ষান্তরে মানুষ তাঁর জ্ঞানের কোনকিছুই আয়ত্ত করতে সক্ষম নয়, তিনি যে পরিমাণ ইচ্ছে করেন সেটুকু ছাড়া। তাঁর কুরসী আকাশ ও পৃথিবী পরিবেষ্টন করে আছে এবং এ দু’য়ের রক্ষণাবেক্ষণ তাঁকে ক্লান্ত করে না, তিনি উচ্চ মর্যাদাশীল, মহান।' (সুরা বাকারা : আয়াত ২৫৫)
আরশের ধনভাণ্ডার থেকে পাওয়া দোয়া-
رَبَّنَا لَا تُؤَاخِذْنَآ إِن نَّسِينَآ أَوْ أَخْطَأْنَا ۚ رَبَّنَا وَلَا تَحْمِلْ عَلَيْنَآ إِصْرًا كَمَا حَمَلْتَهُۥ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِنَا ۚ رَبَّنَا وَلَا تُحَمِّلْنَا مَا لَا طَاقَةَ لَنَا بِهِۦ ۖ وَاعْفُ عَنَّا وَاغْفِرْ لَنَا وَارْحَمْنَآ ۚ أَنتَ مَوْلٰىنَا فَانصُرْنَا عَلَى الْقَوْمِ الْكٰفِرِينَ
‘হে আমাদের রব! যদি আমরা বিস্মৃত হই অথবা ভুল করি তবে আপনি আমাদেরকে পাকড়াও করবেন না। হে আমাদের রব! আমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর যেমন বোঝা চাপিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের উপর তেমন বোঝা চাপিয়ে দিবেন না। হে আমাদের রব! আপনি আমাদেরকে এমন কিছু বহন করাবেন না যার সামর্থ আমাদের নেই। আর আপনি আমাদের গোনাহ মাফ করুন, আমাদেরকে ক্ষমা করুন, আমাদের প্রতি দয়া করুন, আপনি আমাদের অভিভাবক। অতএব কাফির সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আমাদেরকে সাহায্য করুন। ’ (সুরা বাকারা : আয়াত ২৮৬)
এ দোয়ায় রয়েছে ক্ষমা ও দয়া প্রার্থনা ভাব-ভঙ্গি। এ দোয়াটি আরশের ধনভাণ্ডার থেকে প্রাপ্ত বলে জানিয়েছেন নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম। জীবনের ভুল-ভ্রান্তি থেকে মুক্ত থাকতে ক্ষমা প্রার্থনার পদ্ধতি রয়েছে এ দোয়ায়। যাতে ভুল-ভ্রান্তির কারণে পূর্ববর্তী নবিদের উম্মতের মতো উম্মতে মুহাম্মাদিকে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে না হয়। এ আয়াত প্রসঙ্গে হাদিসে পাকে নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা করেন-
‘সুরাহ বাকারার শেষ আয়াতগুলো আমাকে আরশের ধনভাণ্ডার থেকে দেওয়া হয়েছে। আমার আগে আর কোনো নবিকে এগুলো দেওয়া হয়নি।’ (মুসনাদে আহমদ, বায়হাকি)
অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘মেরাজের রাতে আল্লাহ তাআলা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে তিনটি জিনিস দান করেন। আর তাহলো-
১. পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ;
২. সুরাহ বাকারার শেষ আয়াতগুলো এবং
৩. তাওহিদের অনুসারীদের সব পাপের ক্ষমার ঘোষণা।’ (মুসলিম, তিরমিজি, নাসাঈ, মুসনাদে আহমদ)
হজরত নুমান ইবনে বশির রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আসমান জমিন সৃষ্টির দু’হাজার বছর আগে আল্লাহ তাআলা লিখে রেখেছেন যে, সুরা বাকারার শেষ দু’আয়াত যে ঘরে ৩দিন পাঠ করা হবে, সে ঘরের কাছে শয়তান আসতে পারবে না।’ (বাগবি- তাফসিরে মাজহারি)
সুরা বাকারায় যা আলোচিত হয়েছে
ইসলামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি সুরা বাকারার এ অংশে আল্লাহ তাআলা সন্নিবেশিত করেছেন। সুদ ভিত্তিক অর্থ ব্যবস্থার ভয়াবহতা ও তা হারাম ঘোষণা করে পরিহারের কথা বলা হয়েছে।
মুসলিম উম্মাহর ঐক্যের মূলনীতি থেকে শুরু করে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দান-সদকার হকদার তা দান করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইয়াতিমদের সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ করার প্রতি গুরুত্বারোপসহ স্বামী-স্ত্রীর দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। আল্লাহর ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে বাবা মায়ের অধিকার যথাযথ আদায়ের কথাও বলা হয়েছে এ সুরায়। এ ছাড়াও আলোচিত হয়েছে-
আয়াত ২০৪-২১৪
ইসলামের সামাজিক অবস্থার চিত্রায়ন করা হয়েছে। মুমিনের প্রকৃত পরিচয়, ইয়াহুদি জাতির ধ্বংসের কারণ এবং মুশরিকদের বিপরীতমুখী দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে বর্ণনা রয়েছে। মুসলিম উম্মাহর ঐক্যবদ্ধের মূলনীতি ঘোষণাপূর্বক জান্নাত লাভের মিথ্যার আশ্বাসে লোভ-লালসা ও বিভ্রান্তিমূলক বর্ণনার বিষয়ে সতর্কতা রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা ২০৭নং আয়াতে ঘোষণা করেন-
وَ مِنَ النَّاسِ مَنۡ یَّشۡرِیۡ نَفۡسَهُ ابۡتِغَآءَ مَرۡضَاتِ اللّٰهِ ؕ وَ اللّٰهُ رَءُوۡفٌۢ بِالۡعِبَادِ
‘মানুষের মধ্যে এমন আছে যে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে নিজের প্রাণ দিয়ে থাকে, বস্তুতঃ আল্লাহ তাঁর বান্দাদের প্রতি অত্যধিক দয়ালু।’
বিভিন্ন গ্রন্থে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, এ আয়াতটি সোহাইব রুমী রাদিয়াল্লাহু আনহু-এর এক ঘটনাকে কেন্দ্র করে নাজিল হয়েছিল। তিনি যখন মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনা অভিমুখে রওয়ানা হয়েছিলেন, তখন পথিমধ্যে একদল কোরাইশ তাকে বাধা দিতে উদ্যত হলে তিনি সওয়ার থেকে নেমে দাঁড়ালেন এবং তার তুনীরে রক্ষিত সবগুলো তীর বের করে দেখালেন এবং কোরাইশদের লক্ষ্য করে বললেন, হে কোরাইশগণ! তোমরা জান, আমার তীর লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় না। আমি আল্লাহর শপথ করে বলছি, যতক্ষণ পর্যন্ত তুনীরে একটি তীরও থাকবে, ততক্ষণ তোমরা আমার ধারে-কাছেও পৌঁছতে পারবে না। তীর শেষ হয়ে গেলে তলোয়ার চালাব। যতক্ষণ আমার প্রাণ থাকবে, ততক্ষণ আমি তলোয়ার চালিয়ে যাব। তারপর তোমরা যা চাও করতে পারবে।
আর যদি তোমরা দুনিয়ার স্বার্থ কামনা কর, তাহলে শোন, আমি তোমাদের মক্কায় রক্ষিত আমার ধন-সম্পদের সন্ধান বলে দিচ্ছি, তোমরা তা নিয়ে নাও এবং আমার রাস্তা ছেড়ে দাও। তাতে কোরাইশ দল রাজি হয়ে গেল এবং সোহাইব রুমী রাদিয়াল্লাহু আনহু নিরাপদে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দরবারে উপস্থিত হয়ে ঘটনা বর্ণনা করলেন। তখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দু’বার বললেন, সোহাইব লাভবান হয়েছে! সোহাইব লাভবান হয়েছে!’ (মুস্তাদরাকে হাকেম: ৩/৩৯৮)
এ আয়াতও ব্যাপক অর্থের, যা সমস্ত মুমিন, আল্লাহভীরু এবং দুনিয়ার মোকাবেলায় দ্বীনকে প্রাধান্য দানকারী সকলকেই শামিল করে থাকে। কেননা, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হওয়া সমস্ত আয়াতের ব্যাপারে নীতি হলো, ‘আয়াতের যে অর্থ তার ব্যাপকতাকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে, বিশেষ কোনো কারণে নাজিল হয়ে থাকলেও অর্থ কেবল তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। যারা উত্তম গুণাবলী এবং পূর্ণ ঈমানের গুণে গুণান্বিত হবে, তাঁদের সকলের জন্য নমুনা হবেন সোহাইব রাদিয়াল্লাহু আনহু।
অতপর আল্লাহ তাআলা পরবর্তী আয়াতে ঈমানদারদের উদ্দেশ্য করে ঘোষণা করেন-
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا ادۡخُلُوۡا فِی السِّلۡمِ کَآفَّۃً ۪ وَ لَا تَتَّبِعُوۡا خُطُوٰتِ الشَّیۡطٰنِ ؕ اِنَّهٗ لَکُمۡ عَدُوٌّ مُّبِیۡنٌ
‘হে বিশ্বাসিগণ! তোমরা পরিপূর্ণরূপে ইসলামে প্রবেশ কর এবং শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। নিশ্চয়ই সে তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ২০৮)
এ আয়াতে ঈমানদারদের বলা হচ্ছে যে, তোমরা ইসলামে পরিপূর্ণরূপে প্রবেশ করে যাও। এমন করো না যে, যে নির্দেশগুলো তোমাদের স্বার্থ ও পছন্দ হবে, সেগুলোর উপর আমল করবে এবং অন্যান্য নির্দেশগুলো ত্যাগ করবে। অনুরূপ যে দ্বীন তোমরা ছেড়ে এসেছ, তার কথাও ইসলামে প্রবেশ করানোর অপচেষ্টা করো না; বরং কেবল ইসলামকেই পূর্ণরূপে বরণ করে নাও।
এ আয়াতে দ্বীনের নামে বিদআতেরও খন্ডন করা হয়েছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসীদের মতবাদও খন্ডন করা হয়েছে। যারা ইসলামকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে প্রস্তুত নয়, বরং দ্বীনকে কেবল (ব্যক্তিগত) ইবাদত অর্থাৎ, মসজিদে সীমাবদ্ধ রেখে দিতে চায়। রাষ্ট্রীয় সকল পর্যায় থেকে তাকে নির্বাসন দিতে চায়।
এইভাবে জনসাধারণকেও বুঝানো হচ্ছে, যারা প্রচলিত প্রথা ও লোকাচার এবং আঞ্চলিক সভ্যতা-সংস্কৃতিকে পছন্দ করে, কোনো মতেই তারা এগুলোকে ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয়; যেমন মৃত্যু ও বিবাহ-শাদীতে ব্যয়বহুল ও অপচয়মূলক এবং বিজাতীয় রীতিনীতি ইত্যাদির অনুকরণ করে থাকে, তাদেরকে বলা হচ্ছে যে, তোমরা সেই শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না, যে ইসলাম পরিপন্থী কথা ও কর্মকে লোভনীয় ও শোভনীয় ভঙ্গীতে তোমাদের সামনে পেশ করে, যে মন্দের উপর খুব ভালোর লেবেল চড়ায় এবং বিদআতকেও নেকির কাজ বলে বুঝায়, যাতে সর্বদা তোমরা তার পাতা জালে ফেঁসে থাকো।
আয়াত ২১৫-২২০
দান-সাদকার অগ্রাধিকারভুক্ত খাতের উল্লেখ, ইসলামে জিহাদের গুরুত্ব, আল্লাহর মাসসমূহের মধ্যে সম্মানিত মাসের বিধান ও তাৎপর্যের বর্ণনা রয়েছে। মদ-জুয়া নিষিদ্ধে প্রথম কর্মসূচি ঘোষণা এবং দান-সাদকার পরিমাণ ও মাত্রা এবং ইয়াতিমের সম্পদ ব্যয় নির্বাহ ও অধিকার সংরক্ষণের বিবরণ রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা দান-সাদকা সম্পর্কে ঘোষণা করেন-
یَسۡـَٔلُوۡنَکَ مَا ذَا یُنۡفِقُوۡنَ ؕ قُلۡ مَاۤ اَنۡفَقۡتُمۡ مِّنۡ خَیۡرٍ فَلِلۡوَالِدَیۡنِ وَ الۡاَقۡرَبِیۡنَ وَ الۡیَتٰمٰی وَ الۡمَسٰکِیۡنِ وَ ابۡنِالسَّبِیۡلِ ؕ وَ مَا تَفۡعَلُوۡا مِنۡ خَیۡرٍ فَاِنَّ اللّٰهَ بِهٖ عَلِیۡمٌ
তারা কি ব্যয় করবে সে সম্পর্কে আপনাকে প্রশ্ন করে। বলুন, যে ধন-সম্পদ তোমরা ব্যয় করবে তা পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, এতিম, মিসকিন এবং মুসাফিরদের জন্য। উত্তম কাজের যা কিছুই তোমরা কর আল্লাহ সে সম্পর্কে সম্যক অবগত।’ (সুরা আল-বাকারা: আয়াত ২১৫)
অর্থাৎ আমাদের সম্পদ থেকে কী পরিমাণ ব্যয় করব এবং কোথায় ব্যয় করব? এ প্রশ্নে দুটি অংশ রয়েছে। একটি হচ্ছে অর্থ-সম্পদের মধ্য থেকে কি বস্তু এবং কত পরিমাণ খরচ করা হবে? দ্বিতীয়টি হচ্ছে এই দানের পাত্র কারা? প্রথম অংশে অর্থাৎ কোথায় ব্যয় করবে সে সম্পর্কে এরশাদ হচ্ছে-
‘আল্লাহর রাস্তায় তোমরা যা-ই ব্যয় কর তার হকদার হচ্ছে, ‘তোমাদের পিতা-মাতা, নিকট আত্মীয় স্বজন, এতিম মিসকিন ও মুসাফিরগণ।’
আর দ্বিতীয় অংশের জবাব অর্থাৎ কি ব্যয় করবে? এ প্রশ্নের উত্তর প্রাসঙ্গিকভাবে অন্তর্ভুক্ত করে এরশাদ করা হয়েছে- ‘তোমরা যেসব কাজ করবে তা আল্লাহ তাআলা জানেন।’
বাক্যটিতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমাদের জন্যে কোনো পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়নি যে, এতটুকু বাধ্যতামূলকভাবেই তোমাদেরকে ব্যয় করতে হবে এবং স্বীয় সামর্থ্যানুযায়ী যা কিছু তোমরা ব্যয় কর, আল্লাহর কাছে এর প্রতিদান পাবে।
আয়াত ২২১-২৪২
মানুষের পারিবারিক জীবনের নীতিমালায় ইসলামে বিবাহের বিধান, যৌন জীবন, বিধর্মী ও মুশরিক নারী পুরুষকে বিবাহের বিধান, মহিলাদের ঋতুস্রাবের বিধান, শপথ সংক্রান্ত সতর্কতার বিধান ওঠে এসেছে। স্বামী-স্ত্রীর ইলা’র বিধান, তালাকের বিধান ও মোহর, তালাক পরবর্তী হিল্লা বিয়ে সংক্রান্ত বিষয় ওঠে এসেছে। সন্তানদের স্তন্যদানের বিষয়, বিধবা বা তালাকপ্রাপ্তা নারীর ইদ্দতকাল এবং বিধবার প্রতি ইসলামের উদারতা ও তাদের অধিকার সংরক্ষণে ইসলামি নীতি আলোচিত হয়েছে।
আয়াত ২৪৩-২৫৮
ইয়াহুদিদের চরম হঠকারিতা, আল্লাহর পথে জিহাদ ও তার নেতৃত্বের সুফল, জালেমকে দিয়ে জালেমদের দমনের বিষয়টি ওঠে এসেছে। রিসালাত ও নবুয়ত প্রসঙ্গে নবীগণের মধ্যে পারস্পরিক মর্যাদার তারতম্য এবং কোরআনুল কারিমের সবচেয়ে বড় আয়াত ‘আয়াতুল কুরসি’ মধ্যে মহান আল্লাহ তাআলা অনেকগুলো গুণের আলোচনা এসেছে। ইসলামের পূর্ণাঙ্গ অনুসরণে তাগুত বর্জন ঈমানের পূর্বশর্ত ও ব্যক্তি স্বাধীনতার আলোচনা রয়েছে।
আয়াত ২৫৯-২৮৬
এ সুরায় সুদের মতো মারাত্মক ব্যাধির গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা রয়েছে। ব্যবসা ও সুদের নীতিগত পার্থক্য, সুদের অর্থনৈতিক ক্ষতি, সুদের শাস্তি ঘোষিত হয়েছে।
সুরার শেষাংশে লেনদেন ও চুক্তি সংক্রান্ত বিধিবিধানের পাশাপাশি ইসলামের সাক্ষ্য আইন, মেয়াদি ঋণ সংক্রান্ত নীতিমালা এবং বন্ধকীঋণ সংক্রান্ত নীতিমালার বিবরণ রয়েছে। আরও রয়েছে ঈমানের সঠিক রূপ-রেখার আলোচনা।
সুরা আল-ইমরান
মদিনায় অবতীর্ণ ২০ রুকু ও ২০০ আয়াত বিশিষ্ট সুরা এটি। এ সুরায় দু’টি দলকে সম্বোধন করা হয়েছে। একটি হলো আহলে কিতাব আর দ্বিতীয় দলটি হলো যারা প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ঈমান গ্রহণ করেছিলেন।
সুরা আল-ইমরানের আজকের পঠিত অংশে যেসব দোয়া ও আবেদন রয়েছে তা তুলে ধরা হলো-
হেদায়েতের ওপর থাকার আবেদন-
رَبَّنَا لَا تُزِغْ قُلُوبَنَا بَعْدَ إِذْ هَدَيْتَنَا وَهَبْ لَنَا مِن لَّدُنكَ رَحْمَةً ۚ إِنَّكَ أَنتَ الْوَهَّابُ
অর্থাৎ ‘হে আমাদের রব! সরল পথ দেওয়ার পর আপনি আমাদের অন্তরসমূহকে সত্য লঙ্ঘনপ্রবণ করবেন না। আর আপনার কাছ থেকে আমাদের রহমত দান করুন, নিশ্চয়ই আপনি মহাদাতা।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৮)
পরকালের স্মরণের দোয়া-
رَبَّنَآ إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لَّا رَيْبَ فِيهِ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَا يُخْلِفُ الْمِيعَادَ
হে আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয়ই তুমি সমুদয় মানুষকে একদিন সমবেত করবে, যাতে কোনও সন্দেহ নাই। নিশ্চয়ই আল্লাহ অঙ্গীকারের খেলাফ করেন না। (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৯)
গোনাহ মাফের দোয়া-
رَبَّنَآ إِنَّنَآ ءَامَنَّا فَاغْفِرْ لَنَا ذُنُوبَنَا وَقِنَا عَذَابَ النَّارِ
‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা ঈমান এনেছি, অতএব আমাদের গুনাহসমূহ ক্ষমা কর এবং আমাদেরকে জাহান্নামের শাস্তি হতে রক্ষা কর।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ১৬)
আল্লাহকে সর্বময় ক্ষমতায় শুকরিয়া আদায় করা-
قُلِ اللَّهُمَّ مٰلِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِى الْمُلْكَ مَن تَشَآءُ وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَآءُ وَتُعِزُّ مَن تَشَآءُ وَتُذِلُّ مَن تَشَآءُ ۖ بِيَدِكَ الْخَيْرُ ۖ إِنَّكَ عَلٰى كُلِّ شَىْءٍ قَدِيرٌ - تُولِجُ الَّيْلَ فِى النَّهَارِ وَتُولِجُ النَّهَارَ فِى الَّيْلِ ۖ وَتُخْرِجُ الْحَىَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَتُخْرِجُ الْمَيِّتَ مِنَ الْحَىِّ ۖ وَتَرْزُقُ مَن تَشَآءُ بِغَيْرِ حِسَابٍ
বল, ‘হে আল্লাহ! তুমি সমুদয় রাজ্যের মালিক, যাকে ইচ্ছে রাজ্য দান কর আর যার থেকে ইচ্ছে রাজ্য কেড়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছে সম্মানিত কর আর যাকে ইচ্ছে অপদস্থ কর, তোমারই হাতে সব রকম কল্যাণ, নিশ্চয়ই তুমি সকল বস্তুর উপর ক্ষমতাবান। তুমিই রাতকে দিনের ভিতর আর দিনকে রাতের ভিতর ঢুকিয়ে দাও, তুমিই জীবিতকে মৃত হতে বের কর এবং মৃতকে জীবিত হতে বের কর আর যাকে ইচ্ছে বেহিসাব রিয্ক্ব দান কর।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ২৬-২৭)
গর্ভবতী নারী সন্তানের জন্য যে দোয়া করবে-
رَبِّ إِنِّى نَذَرْتُ لَكَ مَا فِى بَطْنِى مُحَرَّرًا فَتَقَبَّلْ مِنِّىٓ ۖ إِنَّكَ أَنتَ السَّمِيعُ الْعَلِيمُ
হে আমার প্রতিপালক! আমার উদরে যা আছে, তাকে আমি একান্ত তোমার উদ্দেশে উৎসর্গ করলাম, কাজেই আমার পক্ষ হতে তা গ্রহণ কর, নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ। (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৩৫)
নেক সন্তান লাভে হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালামের দোয়া
رَبِّ هَبْ لِى مِن لَّدُنكَ ذُرِّيَّةً طَيِّبَةً ۖ إِنَّكَ سَمِيعُ الدُّعَآءِ
‘হে আমার প্রতিপালক! আমাকে তোমার পক্ষ হতে একটি সুসন্তান দান কর। নিশ্চয় তুমি প্রার্থনা শ্রবণকারী।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৩৮)
ঈমানের সাক্ষী হওয়ার দোয়া-
رَبَّنَآ ءَامَنَّا بِمَآ أَنزَلْتَ وَاتَّبَعْنَا الرَّسُولَ فَاكْتُبْنَا مَعَ الشّٰهِدِينَ
‘হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি যা অবতীর্ণ করেছ আমরা তার উপর ঈমান এনেছি, রসূলের আনুগত্য স্বীকার করেছি, সুতরাং আমাদেরকে সাক্ষ্যদানকারীদের মধ্যে লিপিবদ্ধ কর।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৫৩)
আল্লাহকে শ্রেষ্ঠ কৌশলী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়া-
وَمَكَرُوا وَمَكَرَ اللَّهُ ۖ وَاللَّهُ خَيْرُ الْمٰكِرِينَ
আর তারা কৌশল করেছিল এবং আল্লাহ্ও (জবাবে) কৌশল করেছিলেন, আল্লাহ কৌশলীদের শ্রেষ্ঠ। (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ৫৪)
সুরা আল-ইমরানের প্রথম অংশে আলোচিত বিষয়ের সংক্ষিপ্ত তথ্য তুলে ধরা হলো-
আয়াত ১-৩২
এ সুরায় আল্লাহ তাআলা তাওহিদের বিষয়ে অতিতের আসমানী কিতাবের রেফারেন্সসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরছেন। পৌত্তলিকতা, খ্রিস্টবাদ ও আল্লাহর একত্ববাদের আলোচনা, তাওরাত ও ইঞ্জিলের ঐতিহাসিক পটভূমি, সব রিসালাতের উৎসের বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে।
কোরআনে মুহকামাত ও মুতাশাবিহাত আয়াতের আলোচনাও রয়েছে। মুমিনের গুণাবলী ও তাঁদের প্রতি আল্লাহর সাহায্যের পাশাপাশি ইসলামের সামগ্রিক আলোচনা ও আমল ধ্বংস হওয়ার কারণ এবং বিধর্মীদের সঙ্গে বন্ধুত্বের ব্যাপারে নসিহত এবং আল্লাহ তাআলার সার্বভৌম ক্ষমতার বিষয় ওঠে এসেছে।
আয়াত ৩২-৬৪
পূর্ববর্তী নবি-রাসুলসহ অনেক মহীয়সী ব্যক্তিত্বের জীবনাচরণ ইবাদত-বন্দেগি ও মর্যাদা এবং শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষণা রয়েছে এ আয়াতগুলোতে। বিবি মরিয়ম ও হজরত ইসা আলাইহিস সালামের জন্ম, প্রেক্ষাপট, মুযিজা, নবুয়তি মিশন এবং ইসা আলাইহিস সালামকে হত্যায় ইয়াহুদিদের ষড়যন্ত ও মুবাহালার বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে।
আয়াত ৬৫-৯১
মুসলিম জাতির ঐক্য এবং মুসলমানদের ছদ্মাবরণে ইয়াহুদি ও ইসলাম বিদ্বেষীদের ষড়যন্ত্রসহ নৈতিকতার প্রশ্নে ইয়াহুদি ও খ্রিস্টানদের অবস্থান বিষয়ক আলোচনা রয়েছে। শেষের আয়াতগুলোর দিকে আল্লাহর সঙ্গে নবিদের ওয়াদা এবং আল্লাহ তাআলা অবাধ্যতাকারী মুরতাদের তাওবা প্রসঙ্গে বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
আজকের তারাবিহতে যাওয়ার আগে মুসল্লিদের উচিত, সুরা বাক্বারার বাকি অংশ এবং সুরা আল-ইমরানের শুরু থেকে ৯১ আয়াত পর্যন্ত তাফসিরসহ অধ্যয়ন করা। অর্থসহ পড়া সম্ভব না হলেও অন্তত এ আয়াতগলো তেলাওয়াত করা। বিশেষ করে উল্লেখিত দোয়া, আবেদন ও প্রশংসামূলক আয়তগুলো মুখস্ত করে নেয়া এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা ও প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা।
আল্লাহ তাআলা মহামারি করোনাসহ যাবতীয় সমস্যার কোরআন থেকে সমাধান খুঁজে বের করার পাশাপাশি কোরআনের আলোকে জীবন গড়ার চেষ্টা করা। তবেই নামাজ ও ইবাদতে আনন্দ পাবে মুমিন। মুক্তি পাবে যাবতীয় অন্যায়, অপরাধ, গোনাহ ও মহামারি থেকে।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে কোরআনের আজকের তেলাওয়াতের অংশ বুঝে পড়ার তাওফিক দান করুন। কোরআন অনুযায়ী আমলি জিন্দেগি যাপন করার তাওফিক দান করুন। হৃদয়ে কোরআনের নূর তথা হেদায়েত ধারন করার তাওফিক দান করুন। দোয়াগুলো বেশি বেশি পড়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জিকেএস