বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কি মেধা যাচাই প্রক্রিয়া?
![বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা কি মেধা যাচাই প্রক্রিয়া?](https://cdn.jagonews24.com/media/imgAllNew/BG/2019November/mojammel-20220821190129.jpg)
মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক
সেদিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের খুব সম্ভবত জীববিজ্ঞান অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে একটা রুমে মাত্র প্রশ্নের প্যাকেট খুলে বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছি। একটা প্রশ্নে চোখ আটকে গেলো। যতটুকু মনে পড়ে একটা এমসিকিউ প্রশ্ন দেখলাম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ’র নাটকের নাম কী, এ ধরনের কোনো প্রশ্ন। বুঝতে পারলাম না, বায়োলজি যারা পড়বে তাদের কেন ওয়ালীউল্লাহ’র নাটকের নাম জানতে হবে।
আজকে ডিউটি করলাম কলা অনুষদে ভর্তি পরীক্ষার। পরিদর্শকের দায়িত্ব পালনরত একজন তরুণ সহকর্মী বললেন, ‘স্যার, একটা প্রশ্ন একটু পড়ে দেখি।’ আমি বললাম, ‘দেখো। প্রশ্ন পড়লে আমার মাথা গরম হয়ে যায়। তাই ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন পড়া বাদ দিয়েছি অনেক আগে।’ উক্ত তরুণ সহকর্মী আমাকে বললেন, ‘স্যার দেখেন প্রশ্ন এসেছে অমুক কবিতায় ‘আঠারো’ শব্দটি কতবার এসেছে, তা নিয়ে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ কত সালে ফ্রান্সে ছিলেন, তা নিয়ে।’
আঠারো বছর নিয়ে কবিতায় আঠারো শব্দটি কতবার এসেছে তা বলার জন্য সেই কবিতাটি তো পরীক্ষার্থীর মুখস্ত থাকতে হবে। সাধারণ মানের মুখস্ত নয়, একেবারে মুখস্ত ঠোঁটস্ত থাকতে হবে। কারো ভাষাজ্ঞান জানার জন্য তাকে সাহিত্য সংক্রান্ত রোবটিক প্রশ্ন করার মানে কী, তা বুঝতে পারলাম না।
ক’দিন আগে লিখেছি, knowing about literature অথবা এনি সাবজেক্ট, আর knowing literature অর দ্যাট সাবজেক্ট, এই দুইটা এক কথা নয়। যেমন করে দর্শন সম্পর্কে জানা আর দর্শন জানা এক কথা নয়। প্রথমটি তথ্যমূলক বা information retrieving আর দ্বিতীয়টি অনুধাবনমূলক বা matter of understanding।
বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে বিশেষায়ণের জায়গা। তত্ত্ব চর্চার জায়গা। অথচ প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতির কারণে এখন পর্যন্ত এখানকার ভর্তি প্রক্রিয়ায় ‘জ্যাক অব অল ট্রেডস’ ধরনের মিডিওকাররাই বেশি নম্বর পেয়ে থাকে। তত্ত্ব বিশ্লেষণের পরিবর্তে তথ্য উদগীরণের দক্ষতাকে এখানে পুরষ্কৃত করা হয়।
কী সাংঘাতিক কথা…!
আমার এলাকার এক ছোট ভাই। স্কুল টিচার। ওর মেয়ে অংকে খুবই ভালো। ঘোড়ার ডিমের সাধারণ জ্ঞানে সে ন্যূনতম নম্বরের চেয়ে এক নম্বর কম পাওয়ায় চবি-তে ভর্তি হতে পারেনি। শুনে আমার এত খারাপ লেগেছে, ভাষায় বলতে পারছি না…! আমি বুঝি না, গণিতজ্ঞ হওয়ার জন্য একজন ভর্তিচ্ছুকে অমুক দেশের মুদ্রার নাম, তমুক দেশের রাজধানীর নাম কেন জানতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি যে সাবজেক্টেই পড়েন না কেন, আইডিয়েলি, আপনাকে ৩ ধরনের বিষয় এখানে পড়তে হবে; মূল বিষয়, প্রাসঙ্গিক বিষয় এবং সাধারণ বিষয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সবাই কিছু সাবজেক্ট পড়বে। সেগুলো নির্ধারিত থাকবে অথবা একটা তালিকার মধ্য থেকে সেগুলো বাছাই করে নিতে হবে অথবা উভয় ধরনেই এটি হতে পারে। শিক্ষার্থীর মূল বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু বিষয় থাকবে যা উক্ত সাবজেক্টের সবাইকে পড়তে হবে। এগুলোকে একসময়ে আমরা সাবসিডিয়ারি বলতাম। এখন এলাইড কোর্স বলে। দুনিয়াজোড়া এই ধরনের বিষয়গুলোকে মাইনর কোর্স বলা হয়। রিকোয়ারমেন্ট কোর্স এবং মাইনর কোর্সগুলোর সর্বমোট পরিমাণ কোনোক্রমেই মেজর তথা মূল বিষয়ের বেশি হবে না।
কথাগুলো বলার কারণ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার শর্তই হলো একজন শিক্ষার্থী যে ডিপার্টমেন্টে ভর্তি হয়, সেই ডিপার্টমেন্টের পড়াশোনাগুলোর পাশাপাশি তাকে অন্য ডিপার্টমেন্টের কিছু বিষয়েও খানিকটা পড়তে হয়। এর মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থীর মধ্যে একটা সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে ওঠে।
আমার মতে, সংশ্লিষ্ট ভর্তিচ্ছু যে বিষয়ে পড়তে চায় শুধু সেই বিষয়ে বা বড়জোড় সেইটার সঙ্গে ক্লোজলি রিলেটেড কোনো কোনো বিষয়ে ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে। বিশেষায়িত পড়ালেখার জন্য ভর্তি পরীক্ষাও বিশেষায়িত হওয়া যুক্তিসংগত।
যুক্তি-বুদ্ধি যা-ই বলুক, বাস্তবতা ভিন্ন। ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন, প্রচলিত ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে মেধার যাচাই হয় না, যাচাই হয় অপরিসীম মুখস্তবিদ্যার। এইটা একটা ফাঁকি। বলতে পারেন, সবচেয়ে লুক্রেটিভ বিসিএস পরীক্ষার মতো জাতীয় ফাঁকি।
আর একটা কথা। সম্প্রতি আমরা ঢাবির ভর্তি পরীক্ষা নিলাম দেশের প্রধান প্রধান সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে। চবি কেন সেই নিয়মে গেলো না? দেশের এক কোনায়, শহর থেকে এত দূরে হাজার হাজার লোকের যে অমানবিক কষ্ট হয়, তা কি তারা বোঝে না? কারা যেন কিসের মতো করে ঘোলা করে জল খায়, তা আর বললাম না। অথবা, বলতে পারলাম না…!
ঢাবির সিস্টেমটা সুন্দর। তারা এমসিকিউয়ের পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নেয়। এতে করে বোঝা যায়, পরীক্ষার্থীর বিশ্লেষণী ক্ষমতা কতটুকু।
অনেকেই জানে না, অনুষদভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষা বাংলাদেশে প্রথম চালু হয়েছিল চবি-তে। তখন আমরা ছাত্র ছিলাম। এটি ছিল আমাদের আন্দোলনের ফসল। চবিতে ইউনিট সিস্টেমে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার নিয়ম চালু হওয়ার বেশ কয়েক বছর পর ঢাবিতে এটি গ্রহণ করেছিল। মানুষ দিন দিন সামনের দিকে যায়, আর আমরা দিন দিন পিছনের দিকে যাচ্ছি; অথবা পিছিয়ে পড়ছি ‘সানন্দে’!
অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা জানি না, চবিতে টিচারদের পাশাপাশি নন-একাডেমিক কর্মকর্তাদের দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পরিদর্শনের কাজ করানো হয়। অর্থ বিতরণ ছাড়া এর কোনো ‘মাজেজা’ আমি খুঁজে পাইনি। ন্যূনতম মান নিশ্চিত করা যাবে যতজন পরীক্ষার্থীর ভর্তি পরীক্ষায়, তার বাইরে গিয়ে ক্যাপাসিটির বাইরে যাকে তাকে দিয়ে ডিউটি করিয়ে, গাদাগাদি করে বসিয়ে, শিফটে শিফটে পরীক্ষা কেন নেওয়া হচ্ছে, তা আমার সঠিক বুঝে আসে না। টাকাটাই কি সবচেয়ে বড় কথা?
দুই শিফটের প্রশ্ন দুই কোয়ালিটির হওয়াটাই স্বাভাবিক। প্রশ্নপত্র তো মানুষ তৈরি করে। এমনকি রোবট বা সুপার কম্পিউটার দিয়েও একই মানের মূল্যায়নমূলক প্রশ্নপত্র তৈরি করা অসম্ভব। তাই ন্যায়বিচারের স্বার্থে, চেষ্টা করা উচিত শিফটিং না করে একক প্রশ্নে একটা পরীক্ষা নেওয়া। তা যদি করা না যায়, সেক্ষেত্রে আসনসংখ্যা দুই শিফটের মধ্যে ভাগ করে নেওয়া।
ভর্তি পরীক্ষায় প্রত্যেক পরীক্ষার্থী অপরাপর সকল পরীক্ষার্থীর প্রতিদ্বন্দ্বী। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো একই প্রশ্নে একই কোয়ালিটির ইনভিজিলেশনে পরীক্ষা নেওয়া।
তা তো হয় না। অনেক কিছুই হয় না। কেন যে হয় না, অনেকখানি বোঝা গেলেও তা প্রায়শ বলা যায় না। এত এত ফোরাম, অথচ মন খুলে কথা বলার কোনো সুযোগ এখানে কারো নাই। টপ টু বটম সেইম অবস্থা। প্রত্যেকে একটা সিস্টেমের ফাঁদে পড়ে মেকি হাসিমুখে ঝুলিয়ে সাগ্রহে সাইন করছে এত হাজার এত শত দশ টাকার বিল ফর্ম। কে মরলো, কে বাঁচলে তা দেখার সময় কারো নাই।
যদি এমন হয় আপনি দাওয়াত করেছেন অনেককেই, কিন্তু খাওয়াতে পারছেন শুধু অল্পকিছু মানুষকে। তখন উপায় হতে পারে gate keeping করা। অর্থাৎ কিছু একটা ছুতানাতা ধরে লোকজনকে গণহারে বাদ দেওয়া।
উচ্চশিক্ষার ভর্তি পরীক্ষা যেন মেধা যাচাইয়ের নামে এ ধরনের গেট কিপিং টাইপের কিছু একটা ব্যাপার। আপনার সন্তান বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় টেকেনি, তার মানে এই নয় যে সে যথেষ্ট মেধাবী নয়। বরং ধরে নেন, সে একটা লটারিতে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু লটারি জিততে পারেনি।
লটারি না জেতাটা যেমন কারো ডিসক্রেডিট নয়; তেমন করে উচ্চশিক্ষা ভর্তি পরীক্ষায় কেউ কাঙ্ক্ষিত ফল লাভ না করাটা কারো মেধাহীনতার প্রমাণ নয়।
কে শোনে কার কথা…!
(মোহাম্মদ মোজাম্মেল হকের ফেসবুক স্ট্যাটাস)।
ইএ/জিকেএস