প্রথম ম্যাচেই বাঘের গর্জন শুনেছে বিশ্ব

শাহাদাৎ আহমেদ সাহাদ
শাহাদাৎ আহমেদ সাহাদ শাহাদাৎ আহমেদ সাহাদ , স্পোর্টস রিপোর্টার
প্রকাশিত: ০২:৩৩ পিএম, ১১ অক্টোবর ২০২১

লক্ষ্য ১৬৫ রানের, ৪ ওভারের মধ্যে সাজঘরে দুই ওপেনার, স্কোরবোর্ডে রান তখন মাত্র ২৮। উইকেটে এলেন নতুন ব্যাটসম্যান, তিনিই দলের অধিনায়ক। প্রতিপক্ষকে ১৬৪ রান পর্যন্ত যেতে দেয়ার বেশ বড় দায় তারও। কেননা বল হাতে ৪ ওভারে খরচ করেছেন ৫৫ রান।

ফলে বাজে বোলিং, শুরুতে জোড়া উইকেট আর ম্যাচ জেতার সমীকরণ- কঠিন চাপ নিয়েই ব্যাটিং শুরু করেন অধিনায়ক। কিন্তু ব্যাটে নেই চাপের লেশমাত্র। মুখোমুখি প্রথম বলেই ব্যাট চালান সজোরে, মাঝ ব্যাটে হয়নি। তবু ব্যাটের বাইরের কানায় লেগে বল চলে যায় সীমানার ওপারে।

সেই যে প্রথম বল থেকে শুরু, এরপর আর থামাথামি নেই। মাত্র ২৭টি বল মোকাবিলা করেন সেই অধিনায়ক মোহাম্মদ আশরাফুল। আর তাতেই দলের জয়ের পথ সুগম করে দেন। তার ২২৫ স্ট্রাইকরেটে খেলা ৬১ রানের টর্নেডো ইনিংসে বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই দুর্দান্ত এক জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। বিশ্ব শুনতে পায় বাঘের গর্জন।

সাকুল্যে ৩টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রথম বিশ্ব আসরে খেলতে গিয়েছিলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দল। 'এ' গ্রুপে প্রতিপক্ষ শক্তিশালী দক্ষিণ আফ্রিকা আর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের পাওয়ার হাউজ হিসেবে পরিচিত  ওয়েস্ট ইন্ডিজ। স্বাভাবিকভাবেই এই গ্রুপের আন্ডারডগ ছিলো মোহাম্মদ আশরাফুলের দল।

কিন্তু নিজেদের প্রথম ম্যাচেই সবাইকে ভুল প্রমাণিত করে টাইগাররা। অধিনায়ক আশরাফুলের ছন্দময় মারমুখী ব্যাটিং আর আফতাব আহমেদের স্ট্রোক প্লে'তে অবিস্মরণীয় এক জয় দিয়ে বিশ্বকাপে অভিষেক ম্যাচেই নিজেদের উপস্থিতি জানান দেয় বাংলাদেশ দল।

Ashraful

বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচে ক্রিস গেইলের সেঞ্চুরির সুবাদে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ২০৫ রানের বিশাল সংগ্রহ দাঁড় করায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ম্যাচটি তারা জিততে পারেনি। প্রোটিয়ারা জিতেছিলো হেসে খেলে, মাত্র ২ উইকেট হারিয়ে, ১৪ বল হাতে রেখে।

তবে গেইলের অমন আগুন ফর্ম ও ফায়ার পাওয়ারে ঠাসা ক্যারিবীয়দের বিপক্ষে তরুণ ও নবীন বাংলাদেশ দল কতটুকু কী করতে পারবে, তা নিয়ে একটা প্রশ্ন ঠিকই দাঁড়িয়ে গিয়েছিলো। উত্তর মেলে উদ্বোধনী ম্যাচের একদিন পরই।

দিনটি ছিলো ১৩ই সেপ্টেম্বর, ভেন্যু জোহানেসবার্গের ওয়ান্ডারার্স স্টেডিয়াম। টস জিতে আগে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন টাইগার অধিনায়ক আশরাফুল। গেইল-স্মিথদের সামনে নেমে যান দুই স্পিনার, দুই পেসার ও এক মিডিয়াম পেসারে গড়া বোলিং আক্রমণ নিয়ে।

সেদিন প্রথম ওভারেই ইতিহাস গড়ার বার্তাটা দেন বাঁহাতি পেসার সৈয়দ রাসেল। ইনিংসের প্রথম দুই বলে ব্যাটই চালাননি গেইল, যেতে দেন উইকেটরক্ষক মুশফিকুর রহীমের গ্লাভসে। রানের খাতা খোলার চেষ্টায় তৃতীয় বলে করেন স্কয়ার কাট, যা সোজা গিয়ে জমা পড়ে পয়েন্টে দাঁড়ানো অলক কাপালির হাতে।

যেই গেইল বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে খেলেছিলেন ৫৭ বলে ১১৭ রানের বিধ্বংসী ইনিংস, তাকে ইনিংসের তৃতীয় বলেই ফিরিয়ে দেয় বাংলাদেশ। সেই ওভারে আর কোনো রানই দেননি রাসেল। নিউজিল্যান্ডের কিংবদন্তি শেন বন্ডের পর বিশ্বের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে উইকেট মেইডেন নেয়ার কীর্তি গড়েন বাংলাদেশের রাসেল।

টাইগারদের শুরুর ওভারের সেই সাফল্যের সুবাদে পাওয়ার প্লে'র ৬ ওভারে মাত্র ৩৩ রান করতে সক্ষম হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। রাসেলকে টানা ৪ ওভার করান আশরাফুল। নিজের ৪ ওভারে এক মেইডেনসহ মাত্র ১০ রান খরচ করেন রাসেল। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি তখন সেটিই ছিলো ৪ ওভারে সবচেয়ে কম রান দেয়ার রেকর্ড।

রাসেলের এমন বোলিংয়ের পরও অন্য পাশ থেকে তেমন সমর্থন মিলছিলো না। যার ফলে শুরুর ধাক্কা কাটিয়ে প্রথম দশ ওভারে আর কোনো উইকেট না হারিয়ে ৬৯ রান করে ফেলে ক্যারিবীয়রা। উইকেটে থিতু হয়ে যান ডেভন স্মিথ ও শিবনারায়ন চন্দরপল।

বাংলাদেশের দুঃখ আরও বাড়ে ১১তম ওভারের দ্বিতীয় বলে আফতাব যখন চন্দরপলের ক্যাচ ছেড়ে দেন। সেই ওভারে ১২ রান তুলে নেয় ক্যারিবীয়রা। উইকেটের আশায় ইনিংসের দশম ওভারের পর টানা স্পিন আক্রমণ চালাতে থাকেন আশরাফুল।

কিন্তু এর ফল হয় উল্টো। বিশেষ করে আশরাফুল নিজেই পুরো ৪ ওভার করার সিদ্ধান্ত নেয়ায়। ইনিংসের ১৪তম ওভারে স্মিথ-চন্দরপলের জুটি ভাঙেন আব্দুর রাজ্জাক। মাশরাফি বিন মর্তুজার হাতে ক্যাচ দেয়ার আগে চন্দরপল করেন ৩৭ রান।

এক ওভার পর স্মিথকে সোজা বোল্ড করে দেন রাজ্জাক। আউট হওয়ার আগে ৫২ বলে ৫১ রানের বেশি করতে পারেননি স্মিথ। রাজ্জাকের জোড়া আঘাতের পর ১৬ ওভার শেষে ক্যারিবীয়দের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৩ উইকেটে ১০৬ রান। তখনও দুইটি করে ওভার বাকি ছিলো দুই পেসার মাশরাফি ও ফরহাদ রেজার।

তবু স্পিনার চালিয়ে নেয়াই যথাযথ মনে করেন আশরাফুল। তিনি নিজেই করতে আসেন নিজের তৃতীয় ওভার। আগের দুই ওভারে মাত্র ১১ রান খরচ করায় তৃতীয় ওভার করার সিদ্ধান্ত তেমন ভুল ছিল না। কিন্তু সেই ওভারে দুইটি করে চার-ছয় হাঁকিয়ে ২০ রান তুলে নেন মারলন স্যামুয়েলস। শেষ বলে তাকে আউট করেন আশরাফুল।

সাকিবের করা পরের ওভারে আসে মাত্র ৫ রান, মারমুখী খেলতে গিয়ে আউট হন দীনেশ রামদিন। আগের ওভারে ২০ রান দেয়ার পরেও ১৯তম ওভারে নিজের কোটা পূরণ করতে আসেন আশরাফুল। তা প্রমাণিত হয় আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হিসেবে।

আশরাফুলের স্পিনে সেই ওভারে ৩ ছক্কা ও ১ চার হাঁকান ডোয়াইন স্মিথ, ক্যারিবীয়রা পায় ২৪ রান। শেষ ওভারে জাদু দেখান সাকিব। মাত্র ৯ রান খরচ করে তুলে নেন ৩টি উইকেট। অবশ্য এরপরও ক্যারিবীয়দের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৬৪ রান। শেষ ৪ ওভারেই তারা যোগ করে ৫৮ রান। যেখানে ২ ওভারে ৪৪ দেন আশরাফুল।

খরুচে বোলিংয়ের মাশুলটা ব্যাট হাতে দিতে কোনো ভুল করেননি টাইগার অধিনায়ক। ১৬৫ রানের লক্ষ্যে খেলতে নেমে বাংলাদেশের শুরুটা ছিলো নড়বড়ে। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই সাজঘরে ফিরে যান নাজিমউদ্দিন। ৩ ওভারে আসে মাত্র ১২ রান, তাও তৃতীয় ওভারে তামিম ইকবালের দুইটি চারের সুবাদে।

ইনিংসের চতুর্থ ওভারে প্রথমবারের মতো আগ্রাসী ব্যাটিং শুরু করে বাংলাদেশ। রবি রামপলের করা ওভারে দ্বিতীয় বলটি দর্শনীয় এক শটে লং লেগ অঞ্চল দিয়ে সীমানার ওপারে পাঠান আফতাব, পরের বলে হাঁকান বাউন্ডারি। পরপর দুই বলে বাউন্ডারি হজম করে লাইন-লেন্থ হারিয়ে ফেলেন রামপল, পরের বলে দেন ওয়াইডসহ ৫ রান।

সেই ওভারের প্রথম পাঁচ বলেই আসে ১৬ রান। কিন্তু শেষ বলে ঘটে বিপদ। আক্রমণাত্মক শট খেলার চেষ্টায় মিড অনে ক্যাচ দিয়ে বসেন তামিম। তার ব্যাট থেকে আসে ১৩ বলে ১০ রান। বাংলাদেশের সংগ্রহ তখন ৪ ওভারে ২ উইকেটে ২৮ রান। এরপরই যেনো শুরু হয় বাংলাদেশের আসল ব্যাটিং।

পরের ওভারের প্রথম বলে উইকেটে এসেই পরপর তিন বলে তিনটি বাউন্ডারি হাঁকান আশরাফুল, ড্যারেন পাওয়েলের সেই ওভারের শেষ বলে দর্শনীয় কভার ড্রাইভে মারের চতুর্থ বাউন্ডারি। এই ওভার থেকে আসে ১৮টি রান।

Aftab Ahmed

রামপলের আগের ওভারে ঝড় তুলেছিলেন আফতাব। সেটি ড্রেসিংরুমে বসে দেখেছিলেন আশরাফুল। এবার নিজে সুযোগ পেয়ে রামপলের মুখোমুখি প্রথম বলেই অ্যাশ স্কুপে ফাইন লেগ দিয়ে হাঁকান ছক্কা, পরের বলে মিড-অফ দিয়ে মারেন চার। শুরুর ধাক্কা সামলে তখন উড়ছে বাংলাদেশ।

কথায় বলে, ভাগ্য সাহসীদের পক্ষে থাকে। সেদিনও তাই হয়েছিল। পাওয়ার প্লে'র শেষ ওভারের শেষ বলে ক্যাচ তুলেছিলেন আশরাফুল। কিন্তু ফাইন লেগে সেটি রাখতে পারেননি ফিদেল এডওয়ার্ডস। জীবন পেয়ে আশরাফুল ছোটেন নতুন ইতিহাসের পথে, কম যান না আফতাবও।

পরপর তিন ওভারে ১৬, ১৮ ও ১৫ রানের সুবাদে পাওয়ার প্লে শেষে বাংলাদেশের সংগ্রহ দাঁড়ায় ২ উইকেটে ৬১ রান। সপ্তম ওভার করতে এসে খুবই কিপটে বোলিং করেন গেইল, আসে মাত্র ৫ রান। তবে ফিদেলের করা পরের ওভারের প্রথম দুই বলেই বাউন্ডারি হাঁকিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে দেন আফতাব। কিন্তু ফের ৫ রানের একটি ওভার করে রানের গতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন গেইল।

তবে থামার পাত্র ছিলেন না আশরাফুল। ডোয়াইন ব্রাভোর করা দশম ওভারের শেষ তিন বলে যথাক্রমে ৪, ৪ ও ৬ মেরে দলীয় একশ পূরণ করেন টাইগার অধিনায়ক। তার নিজের রান তখন ৪৮, মাত্র ১৮ বল থেকে। টি-টোয়েন্টিতে দ্রুততম ফিফটির বিশ্বরেকর্ড গড়তে তার হাতে তখনও ছিলো ৪টি বল।

দুই বলের বেশি নেননি বাংলাদেশের লিটল মাস্টার। ফিদেলের করা ১২তম ওভারের দ্বিতীয় বলে খাটো লেন্থের ডেলিভারিটি ফাইন লেগ দিয়ে সীমানার ওপারে পাঠান আশরাফুল, ফিফটি তুলে নেন মাত্র ২০ বলে। যা ছিলো তখন দ্রুততম ফিফটির বিশ্বরেকর্ড।

আশরাফুল-আফতাবের ঝড়ো ব্যাটিংয়ে ১২ ওভারেই ১২২ রান করে ফেলে বাংলাদেশ। জয়ের জন্য তখন ৪৮ বলে বাকি ছিলো মাত্র ৪৩ রান। ইনিংসের ১৫তম ওভারে সাজঘরে ফেরেন আশরাফুল। ততক্ষণে তার নামের পাশে ৭ চার ও ৩ ছয়ের মারে ৬১ রানের টর্নেডো ইনিংস।

অধিনায়ক ফিরে গেলেও দায়িত্ব নিয়ে বাকি কাজ শেষ করেন আফতাব। তিনি নিজের ফিফটি পূরণ করেন ১৪তম ওভারে। বাংলাদেশ দলের ম্যাচ জিততে প্রয়োজন হয় মাত্র ১৮ ওভার। অর্থাৎ পুরো ১২টি বল হাতে রেখেই জিতে যায় বাংলাদেশ। আফতাব শেষপর্যন্ত অপরাজিত থাকেন ৮ চার ও ১ ছয়ের মারে ৬২ রান করে।

এ জয়ের সুবাদে বাংলাদেশ পেয়ে যায় সুপার এইটের টিকিট। সে বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে হওয়া ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভারতকে হারিয়ে সুপার এইটে উঠেছিলো বাংলাদেশ। পরে সেরা আটের লড়াইয়ে হারায় তখনকার নম্বর ওয়ান দল দক্ষিণ আফ্রিকাকে। তবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সুপার এইটে আর কোনো ম্যাচ জেতা হয়নি টাইগারদের।

স্কোরকার্ড

ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ১৬৪/৮ (২০ ওভার; গেইল ০, ডেভন স্মিথ ৫১, চন্দরপল ৩৭, স্যামুয়েলস ২৭, সারওয়ান ৫, রামদিন ২, ডোয়াইন স্মিথ ২৯, ব্রাভো ২, পাওয়েল ১*; রাসেল ৪-১-১০-১, রাজ্জাক ৪-০-২৫-২, মাশরাফি ২-০-১৬-০, ফরহাদ ২-০-২২-২, সাকিব ৪-০-৩৪-৪, আশরাফুল ৪-০-৫৫-১)

বাংলাদেশ: ১৬৪/৪ (১৮ ওভার; তামিম ১০, নাজিমউদ্দিন ১, আফতাব ৬২*, আশরাফুল ৬১, সাকিব ১৩, অলক ৫*; পাওয়েল ৩-০-২৮-০, রামপল ৪-০-৩৫-২, গেইল ৪-০-২২-২, ফিদেল ৩-০-৩৩-০, ব্রাভো ২-০-৩৪-০, সারওয়ান ২-০-১০-২)

ফলাফল: বাংলাদেশ ৬ উইকেট জয়ী
ম্যান অব দ্য ম্যাচ: মোহাম্মদ আশরাফুল (বাংলাদেশ)

এসএএস/আইএইচএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।