ছেলের জন্যই রোনালদোর মতো উদযাপন করি: ইমরান তাহির

ইমাম হোসাইন সোহেল
ইমাম হোসাইন সোহেল ইমাম হোসাইন সোহেল চট্টগ্রাম থেকে
প্রকাশিত: ০৬:৪৫ পিএম, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

আর কিছুদিন পরই ৪৫তম জন্মদিনের কেকটা কাটবেন ইমরান তাহির। এরপর শুরু হবে তার ৪৬তম বর্ষে পথচলা। এই বয়সে ব্যাট-প্যাড তুলে রেখে অনেক ক্রিকেটারই পুরোদস্তুর কোচ হয়ে গেছেন, কিংবা দিচ্ছেন ধারাভাষ্য। অনেকে হয়তো ক্রিকেটের সঙ্গেই নেই।

সেখানে দক্ষিণ আফ্রিকার পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত ক্রিকেটার ইমরান তাহির দিব্যি ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন। আইপিএল, পিএসএল, বিপিএল থেকে শুরু করে বিশ্বের এমন কোনো ফ্রাঞ্চাইজি লিগ নেই- যেখানে ইমরান তাহিরের পদচারণা নেই।

বিপিএলে এবার রংপুর রাইডার্সের হয়ে খেলছেন দক্ষিণ আফ্রিকার এই লেগ স্পিনার। টি-টোয়েন্টিতে (ঘরোয়া এবং আন্তর্জাতিক মিলিয়ে) ৫০০ ছুঁই ছুঁই (৪৯৭টি) উইকেট তার। এই বয়সে কীভাবে এমন পারফরম্যান্স করতে পারেন ইমরান তাহির? তার অসাধারণ বোলিংয়ের রহস্য কী? কিভাবেইবা এই বয়সে ফিটনেস ধরে রাখেন? চট্টগ্রাম জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে সাক্ষাৎকারে এমন অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। যেখানে বিপিএলের মান কোথায়, সে প্রশ্নেরও উত্তর দিতে হয়েছে ইমরান তাহিরকে।

জাগোনিউজের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো সাক্ষাৎকারের চুম্বক অংশ...

প্রশ্ন: আপনি এখানে দারুণ একটি কম্বিনেশন পেয়েছেন। নিশাম এসেছে, আপনি আছেন, রিজা হেন্ডরিক্সসহ বেশ ভালোমানের ক্রিকেটার রয়েছেন। আপনি কী আশা করেন এবং আপনার কাছ থেকে দল কী প্রত্যাশা করে?
ইমরান তাহির: দেখুন, সর্বপ্রথম আমি ধন্যবাদ জানাই রংপুর রাইডার্সকে, বিদেশি ক্রিকেটার হিসেবে আমাকে খেলার সুযোগ করে দেয়ার জন্য। সত্যিই দারুণ রোমাঞ্চিত প্রথম ম্যাচ খেলতে পেরে। আমি নিজে এবং রিজা (রিজা হেন্ডরিক্স) ভালো পারফর্ম করতে পেরেছি। আমি মনে করি, এটা রংপুরের দারুণ একটি সেটআপ রয়েছে। যখন দলে যোগ দিয়েছি, তখন দল শীর্ষে ছিল। এখনও আছে।

এর কারণ হচ্ছে এখানে ম্যানেজমেন্ট বলুন কিংবা খেলোয়াড়- সবারই প্যাশন আছে, সবার আগ্রহ আছে। তারা ম্যাচ সম্পর্কে জানে এবং কীভাবে এগোতে হবে, সে সবও জানে। এ কারণে এই সেটআপে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া অনেকটা সহজ হয়ে গেছে আমার জন্য। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আপনি ভালো পারফর্ম করতে পারবেন এবং মানসিকভাবে রিলাক্সে থাকতে পারবেন।

প্রশ্ন: টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে (আন্তর্জাতিক এবং ফ্রাঞ্চাইজি) সব মিলিয়ে প্রায় ৫০০ (৪৯৭) উইকেট শিকারি আপনি, বিষয়টাকে কিভাবে দেখেন?
তাহির: সত্যিই আমি এ নিয়ে গর্বিত। কারণ, আপনি দেখবেন সারা বিশ্বেই প্রচুর স্পিনার রয়েছেন। সবার মধ্যে এটাকে অবশ্যই আমি মনে করি, বিরাট এক অর্জন। যেখানেই আমি ক্রিকেট খেলতে যাই, তখন দলের হয়েই খেলি। দল আমার কাছে যা চায়, আমি সেভাবেই খেলার চেষ্টা করি।

এমনকি আমি উইকেট টেকিং অপশন হিসেবেও ব্যবহৃত হই। আমি মনে করি, ম্যাচের মধ্যে অনেক সময় ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। যখন অবশ্যই উইকেট নেওয়াটা জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। এ জায়গায়টায় আমি সবসময়ই প্রস্তুত থাকি। এ জন্য আল্লাহকে ধন্যবাদ যে, নিজেকে এই পজিশনে নিতে পেরেছি এবং উইকেট নিতেও সক্ষম হই। এ জন্য আমি নিজেও গর্বিত যে অনেক উইকেট নিতে পেরেছি।

প্রশ্ন: টি-টোয়েন্টিতে এত উইকেট পাওয়ার মূল রহস্য কী?
তাহির: ভিন্ন কিছুই নয়। আমি শুধু খেলাটা উপভোগ করি। টেস্ট এবং ওয়ানডেতেও একইভাবে উইকটে নেওয়াটা উপভোগ করি। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটটা অনেক বেশি জনপ্রিয়, এটাই মূল পার্থক্য, আর কিছু নয়। আমার কাছে তো ভিন্ন কোনো অনুভূতি হয় না। তবে, প্রতিটি উইকেট নেওয়াতেই আলাদা আলাদা আনন্দ আছে। কারণ আপনি সব সময়ই প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট খেলছেন। অন্য দল তো আপনাকে সহজে কিছু দিয়ে দেবে না। তারা জন্য কঠিন সময় উপহার দিতে সবসময় প্রস্তুত থাকতে হয়। সুতরাং, আপনাকে এই লড়াই জেতার সব চেষ্টাই করতে হবে।

প্রশ্ন: ওয়ানডেতে অনেক বেশি বল করার সুযোগ পাওয়া যায়। অন্তত ১০ ওভার। সেখানে টি-টোয়েন্টি সুযোগ পান মাত্র ৪ ওভার। অথচ টি-টোয়েন্টিতেই বেশি উইকেট আপনার। এর পেছনে রহস্য কী?
তাহির: এটার পেছনে একটাই বড় কারণ, সেটা হলো কঠোর পরিশ্রম, সাধনা এবং অধ্যাবসায়। অবশ্যই আপনাকে প্রতিপক্ষ সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকতে হবে। তাদের কী ধরনের ব্যাটার রয়েছে, তারা কিভাবে ম্যাচে খেলতে যাচ্ছে। সে অনুযায়ী কিভাবে আমি প্ল্যান সাজাচ্ছি। সেভাবেই পরিকল্পনা সাজাই এবং এভাবেই অভিজ্ঞতা দিয়ে সারা বিশ্বে ক্রিকেট খেলে যাই।

এছাড়া যেখানেই যাই, সেখানকার স্থানীয় ক্রিকেটারদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেই। এখানে বিপিএলে আমাদের অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেক তরুণ ক্রিকেটার আছে, তাদের কাছ থেকে উইকেট এবং কন্ডিশন সম্পর্কে জেনে নিয়েছি। ঢাকা এবং এখানকার (চট্টগ্রাম) উইকেট সম্পর্কে জেনেছি। কারণ, দু’জায়গার কন্ডিশন ভিন্ন ভিন্ন।

এখানে এসেই আমি সর্বপ্রথম প্রতিপক্ষ সম্পর্কে জেনে নিয়েছি এবং কিভাবে তাদের বিপক্ষে বল করতে চাই, সে পরিকল্পনাও সাজিয়ে নিয়েছি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা, সেটা হচ্ছে- দল আপনার কাছ থেকে কী চায়, সে অনুযায়ী পারফর্ম করা।

সুতরাং, আমি মনে করি আপনি হোম ওয়ার্ক করার পর মাঠে যাবেন এবং যেভাবে প্রয়োজন সেভাবে নিজেকে মেলে ধরবেন। তবে এ জন্য আপনাকে অবশ্যই কঠোর পরিশ্রম করতে হবে এবং একই সঙ্গে আপনার একটি সুন্দর পরিকল্পনাও থাকতে হবে। তাহলেই সাফল্য হাতের মুঠোয় এসে ধরা দেবে। আমি প্রতিটি ম্যাচে পরিকল্পনা করে খেলতে যাই যে- কিভাবে আমি খেলবো, পরিস্থিতি অনুযায়ী আমি কিভাবে বল করবো!

প্রশ্ন: আপনার বয়স তো ৪০ প্লাস (প্রায় ৪৫ বছর); কিন্তু দেখতে এখনও একেবারে তরুণ। এর পেছনে আসল রহস্য কী?
তাহির: সিক্রেট বা রহস্য হচ্ছে- গুড ডায়েট, হার্ড ওয়ার্ক এবং আপনি হয়তো জানেন, আমি নিয়মিত জিম করি, দৌড়াই। এটা খুব কঠিন হয়তো। তবে আমি মনে করি, যদি খেলে যেতে চাই, তাহলে আমাকে এভাব হার্ডওয়ার্ক করতে হবে। আমার মনে হয়, একমাত্র রহস্য হচ্ছে- আমি দৌড়ানো বন্ধ করি না। এটা খুব কঠিন, কারণ বয়স একটা বড় বাধা। এ কারণেই আমি দ্রুত মুভ করতে পারি, ভালো বল করতে পারি।
কখনোই ভাবতে পারি না যে, আমি ক্রিকেটের বাইরে। বিশেষ করে আধুনিক সময়ের ক্রিকেট খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং কঠিন। তবে আমি মনে করি, এর মধ্যেই আমার জন্য অনুপ্রেরণা রয়েছে।

প্রশ্ন: আপনি তো দীর্ঘ সময় ধরেই খেলছেন। তো নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে যদি বলেন যে, পাঁচ বছর আগে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে যেভাবে দেখেছেন এবং এখন যেমন দেখছেন- দুটোর মধ্যে পার্থক্য কী?
তাহির: দেখুন, আমি মনে করি যদি তরুণ ক্রিকেটারদের আপনি বেশি বেশি সুযোগ তৈরি করে দিতে পারেন, তাহলে এটা হবে অনেক বড় একটি বিষয়। বিদেশি খেলোয়াড়রা ভিন্ন একটি পার্ট। তারা নানা দেশে যাবে, খেলবে এবং নিজের পারফরম্যান্স দেখানোর চেষ্টা করবে। আপনি যদি এখন তরুণদের সুযোগ দেন, তাহলে ৫ বছর পর দেখবেন, তারা এক একজন সুপারস্টার হিসেবে পরিণত হয়েছে। তারাই ভালোমানের ক্রিকটার হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে পারবে।

বিপিএলে আসার আগে বেশ কিছু ম্যাচ টিভিতে দেখেছি এবং আমার দল রংপুরেও বেশ কিছু ভালোমানের তরুণ ক্রিকেটার রয়েছে। আমি মনে করি, যদি কোনো টুর্নামেন্ট জিততে চান, তাহলে অবশ্যই আপনার কাছে ভালোমানের স্থানীয় তরুণ ক্রিকেটার থাকতে হবে। আমরা সৌভাগ্যবান যে, আমাদের দলে (রংপুর রাইডার্স) সে মানের ক্রিকেটার রয়েছে।

প্রশ্ন: আপনার চোখে বিপিএল এবং অন্যান্য ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগগুলো মধ্যে পার্থক্য কী?
তাহির: দেখুন, সারা বিশ্বের সব প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটই তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ। আপনি কোনোটার সঙ্গে কোনোটারই তুলনা করতে পারেন না। দর্শকরা যদি এখানে খেলা দেখতে আসে, তাহলে আমি মনে করি, সেই লিগের বা টুর্নামেন্টের স্ট্যান্ডার্ড খুবই উঁচু। প্রতিটি দলই এখানে ১৭০ থেকে ২০০ কিংবা তারও বেশি রান করছে। এটাই এই লিগের স্ট্যান্ডার্ড এবং কোয়ালিটিকে দেখিয়ে দিচ্ছে।

সুতরাং, আমি মনে করি বিপিএলের স্ট্যান্ডার্ড অনেক ভালো। তবে আমি যেমনটা বলছিলাম, একজন বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে আমরা এবং স্থানীয় ক্রিকেটার যারা রয়েছেন- তারা একে অপরকে সহযোগিতা করি, দলকে জেতানোর জন্য। আমরা অভিজ্ঞতা দিয়ে চেষ্টা করছি, কিভাবে দলকে প্রতিটি লড়াইয়ে জয় এনে দেওয়া যায়।

প্রশ্ন: তরুণ লেগস্পিনারদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে কী পরামর্শ থাকবে? তারা কিভাবে নিজেদেরকে আরও বেশি প্রস্তুত করে তুলতে পারবে?
তাহির: দেখুন সব লেগ স্পিনারের ভিন্ন ভিন্ন অ্যাকশন থাকে। আমার পরামর্শ হলো, আমাকে যদি কেউ ফলো করে, তাহলে বলবো- আমি দিনে প্রায় তিন ঘণ্টা বোলিং অনুশীলন করি। আমি মনে করি, তরুণ থেকে এ বিষয়টাই আমাকে একজন ভালোমানের বোলারে পরিণত করেছে। তবে, আপনাকে অবশ্যই জানতে হবে প্রতিদিন কিভাবে বোলিং করতে হবে এবং অবশ্যই তাদের একটা লক্ষ্য থাকতে হবে। ম্যাচের পরিস্থিতি অনুযায়ী কিভাবে বল করতে হবে, তাও জানতে হবে। এ কারণে অনুশীলনে অনেক বেশি বল করে যেতে হবে। একই সঙ্গে অবশ্যই লাইন এবং লেন্থ পারফেক্ট হওয়া জরুরি।

তবে আমি মনে করি, ক্রিকেট অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে। এখন অনেক বেশি ফ্যাসিলিটিজ পাচ্ছেন ক্রিকেটাররা। যেটা প্রথম দিকে হয়তো আমরা পাইনি। সুতরাং, আমার কথা হচ্ছে তরুণ স্পিনারদের অনেক বেশি টার্গেট বোলিং করতে হবে। এ বিষয়টাই স্পিনারদের ভালো হিসেবে গড়ে তুলবে।

প্রশ্ন: রোনালদোর মতো উইকেট উদযাপন সম্পর্কে বলুন। আপনি কি রোনালদোর খুব বড় ভক্ত?
তাহির: এটা সত্যি যে, আমার ছেলে রোনালদোর খুব বড় ভক্ত। সে রোনালদোর মতোই উদযাপনের চেষ্টা করে। সে চায় আমিও এভাবে উদযাপন করি। এখানে এসে প্রথম ম্যাচে উইকেট নেওয়ার পর ছেলের জন্যই এভাবে উইকেটের উদযাপনটা করেছি। এটা ছাড়া আমার যে উদযাপন, সেটা খেলার প্রতি সম্মান, আবেগের জন্য হয়ে যায়। আমি সবসময় এটার জন্য অপেক্ষা করি, যতবার সুযোগ পাই; চেষ্টা করি যত বেশি সম্ভব উপভোগ করতে।

আইএইচএস/এমএমআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।