ঘোষণায় সীমাবদ্ধ অনিবন্ধিত মোবাইল ফোন বন্ধের ‘তোড়জোড়’

আল-আমিন হাসান আদিব
আল-আমিন হাসান আদিব আল-আমিন হাসান আদিব , নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:২৬ পিএম, ১২ এপ্রিল ২০২৪
অবৈধপথে দেশে ব্যাপকহারে মোবাইল ফোন ঢুকছে
  • দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন কমছে, নিম্নমুখী আমদানি
  • মোবাইল ফোন আসছে চোরাইপথে, বাড়ছে ভ্যাট ফাঁকিও
  • তোড়জোড় করলেও বন্ধ হচ্ছে না অবৈধ মোবাইল ফোন
  • অবৈধ মোবাইল ধরা বিটিআরসির কাজ নয়: কমিশনার

দেশে মোবাইল ফোনের উৎপাদন কমছেই। সর্বশেষ তিন মাসে দেশে সাড়ে পাঁচ লাখ মোবাইল ফোনের উৎপাদন কম হয়েছে। এর মধ্যে বেশি কমেছে স্মার্টফোনের উৎপাদন। একই সময়ে বিদেশ থেকে মোবাইল ফোনের আমদানিও নিম্নমুখী। অথচ দেশের মানুষের হাতে মোবাইল ফোন বাড়ছে। বিশেষ করে হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়ছে স্মার্টফোন।

দেশে উৎপাদন কম, আমদানিও কম। তাহলে ছড়িয়েপড়া এসব স্মার্টফোন দেশে আসছে কীভাবে—এমন প্রশ্ন তুলেছেন প্রযুক্তিসংশ্লিষ্টরা। বিষয়টি নিয়ে খোলামেলা জবাব দিয়েছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। জানিয়েছেন, অবৈধপথে দেশে ব্যাপকহারে মোবাইল ফোন ঢুকছে। ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে অবৈধভাবে মোবাইল আনছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।

ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েই তিনি অনিবন্ধিত মোবাইল ফোন বন্ধের ঘোষণা দেন। গত ১৬ জানুয়ারি এক অনুষ্ঠানে পলক জানান, জুলাইয়ের মধ্যেই অনিবন্ধিত মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে চোরাইপথে দেশে মোবাইল ফোন আনার পথ বন্ধ করতে হবে।

আরও পড়ুন

প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণার পর ১৮ জানুয়ারি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। তাতে বলা হয়, ‘জাতীয় পরিচিতি ও নিবন্ধিত সিম কার্ডের সঙ্গে ট্যাগিং করে প্রতিটি মোবাইল ফোন নিবন্ধের মাধ্যমে বিভিন্ন সরকারি সেবা গ্রহণ-প্রদান নিশ্চিত করা, অবৈধভাবে উৎপাদিত বা আমদানি করা মোবাইল ফোনের ব্যবহার বন্ধে এনইআইআরের কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গ রূপে চালু করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব আহরণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

পাশাপাশি ব্যবহৃত মোবাইল ফোনের চুরি ও অবৈধ ব্যবহার রোধ হবে। এনইআইআরের কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গ রূপে চালু করতে শিগগির অবৈধ মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক হতে বিচ্ছিন্ন করা হবে। এ পরিস্থিতিতে সবাইকে মোবাইল হ্যান্ডসেট কেনার আগে বৈধতা যাচাই করে নিতে হবে।’

অনিবন্ধিত মোবাইল ফোন বন্ধে কী করছে বিটিআরসি

প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণা, বিটিআরসির তোড়জোড়ে জনমনে রীতিমতো ভীতির সঞ্চার করে। সবাই নিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নিবন্ধিত নাকি অনিবন্ধিত তা জানতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। বিটিআরসির দেওয়া পদ্ধতিতে নিজের মোবাইল ফোনের বৈধতা যাচাইয়ে এসএমএস করে তথ্য জানার চেষ্টা করেন। অনেকে এসএমএস পাঠিয়ে ফিরতি এসএমএসে নিশ্চিত হয়েছেন, আবার অনেকে ফিরতি এমএসএস পাননি।

ঘোষণায় সীমাবদ্ধ অনিবন্ধিত মোবাইল ফোন বন্ধের ‘তোড়জোড়’

অবৈধ মোবাইল ফোন বন্ধে বিটিআরসির সঙ্গে প্রতিমন্ত্রীর বৈঠক

বিটিআরসি ও প্রতিমন্ত্রীর ঘোষণার তিন মাস পেরিয়েছে। অনিবন্ধিত মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করার পদক্ষেপ কতদূর এগিয়েছে- জানতে চাইলে বিটিআরসির কমিশনার প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘হ্যাঁ, আমরা একটা সিস্টেম দাঁড় করাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সিস্টেমটা তো এখনো পুরোপুরি তৈরি করা সম্ভব হয়নি। সেটা করতে আরও দেরি হবে।’

আরও পড়ুন

তিনি বলেন, ‘দেখুন, আমাদের প্রধান কাজ হলো—গ্রাহকের যেন কোনো রকম ভোগান্তি না হয়। গ্রাহক যেন কোনো ঝামেলাপূর্ণ পরিস্থিতিতে না পড়েন। সেই কাজটি আমরা করছি। সেজন্য হুটহাট সব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নও করা সম্ভব হয় না। এটা নিয়েও আমি একই কথা বলবো। তবে কাজ চলমান, এটুকু বলতে পারি।’

দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন কেমন, আমদানি কত

দেশে মোবাইল ফোনের উৎপাদন ও আমদানি নিয়ে প্রতি মাসে তথ্য প্রকাশ করে থাকে বিটিআরসি। সর্বশেষ গত ৩ মার্চ জানুয়ারি মাসের তথ্য প্রকাশ করে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। বিটিআরসির প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের নভেম্বরে দেশে মোবাইল ফোন উৎপাদন হয়েছিল ২৪ লাখ ৩২ হাজার। ডিসেম্বরে উৎপাদন হয়েছিল ২১ লাখ ১০ হাজার। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সেই সংখ্যা নেমেছে ১৮ লাখ ৯২ হাজারে। অর্থাৎ তিন মাসে ৫ লাখ ৪০ হাজার মোবাইল ফোন উৎপাদন কমেছে।

সর্বশেষ তিন মাসে স্মার্টফোনের উৎপাদন বেশি কমেছে। গত নভেম্বরে দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোনের ২৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ ছিল স্মার্টফোন। জানুয়ারিতে সেই অনুপাত কমে ১৮ দশমিক ৮০ শতাংশে নেমেছে। একই সময়ে ফিচার ফোন (টু-জি) উৎপাদন বেড়েছে। নভেম্বরে ফিচার ফোনের উৎপাদনের হার ছিল ৭১ দশমিক ৫৭ শতাংশ। জানুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮১ দশমিক ২০ শতাংশ।

অন্যদিকে বিদেশ থেকে আমদানি করা মোবাইল ফোনের সবই স্মার্টফোন। বিটিআরসির প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী—২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ৯টি ফোর-জি এবং ১০ হাজার ফাইভ-জি স্মার্টফোন আমদানি করা হয়েছিল। চলতি বছরের জানুয়ারিতে তা আরও কমেছে। ওই মাসে মাত্র পাঁচ হাজার ৫০টি ফাইভ-জি মোবাইল ফোন আমদানি করা হয়েছে।

অবশ্য ফেব্রুয়ারি ও মার্চের তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি বিটিআরসি। তবে দেশে উৎপাদন ও আমদানির যে তথ্য বিটিআরসি প্রকাশ করে থাকে, এর বাইরে যত মোবাইল ফোন দেশে আসছে, তা অবৈধ বা অনিবন্ধিত।

‘চোরাইপথে আসা মোবাইল ধরা বিটিআরসির কাজ নয়’

চোরাইপথে দেশে আনা মোবাইল ফোন ধরা এবং তা বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া বিটিআরসির কাজ নয় বলেও মনে করেন নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও এনবিআরকে এসব বিষয়ে কাজ করতে হবে বলে মনে করেন তারা।

ঘোষণায় সীমাবদ্ধ অনিবন্ধিত মোবাইল ফোন বন্ধের ‘তোড়জোড়’

গাজীপুরের একটি মোবাইল হ্যান্ডসেট তৈরির কারখানা

বিটিআরসির প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদের ভাষ্য, ‘বিভিন্ন চ্যানেলে দেশে মোবাইল ফোন আসে বলে অভিযোগ রয়েছে। কখনো চোরাইপথে দেশে মোবাইল ফোন আনা হয়। চোরাইপথে ফোন আসা ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। আবার কখনো ভ্যাট ফাঁকি দিয়েও বিপুলসংখ্যক মোবাইল ফোন দেশে ঢোকানো হয়। এগুলো দেখার দায়িত্ব জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর)। যে যার জায়গা থেকে কাজ করছে, ভূমিকা রাখছে। এটা বিটিআরসির কাজ নয়।’

তাহলে বিটিআরসি কী কাজ করছে—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যে মোবাইল ফোনগুলো দেশে উৎপাদন হচ্ছে, যেগুলো বৈধপথে দেশে আসছে। অর্থাৎ আমদানি করে আনা হচ্ছে, সেগুলোর রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছি আমরা। সেগুলোর ডাটাবেজ সংগ্রহে রাখছি। এটা বিটিআরসি দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকেই করে আসছে।’

আরও পড়ুন

মোবাইল ফোন ইন্ডাস্ট্রি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এমআইওবি) নেতাদের দাবি, মোবাইল ফোনের অবৈধ বাজারের কারণে দেশীয় উৎপাদন ক্রমাগতভাবে কমছে। সংগঠনটির সভাপতি জাকারিয়া শহীদ বলেন, ‘অবৈধ মোবাইল ফোনের বাজার বেশ রমরমা। ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে মোবাইল ফোন আনা হচ্ছে। চোরাইপথে আসছে। এটা নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি। তা না হলে দেশীয় উৎপাদকরা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়বে।’

দেশে আসা সব মোবাইল ফোনই এখন ‘বৈধ’

অবৈধভাবে আনা হোক, আর বৈধভাবেই আনা হোক, দেশে সক্রিয় এখন সব মোবাইল ফোনই ‘বৈধ’। এসব ফোন যদি অবৈধভাবেও দেশে আনা হয়ে থাকে, তবুও তা নিবন্ধনের আওতায় চলে এসেছে। নতুন করে নিবন্ধন করাও লাগবে না। বিটিআরসির কর্মকর্তারা এ তথ্য জানিয়েছেন।

ফলে মোবাইল হ্যান্ডসেট বৈধ নাকি অবৈধ, নেটওয়ার্কে চলবে নাকি, চলবে না—এ নিয়ে ব্যবহারকারীর কোনো দুশ্চিন্তা থাকছে না। বিটিআরসি সূত্র জানায়, দেশের মোবাইল নেটওয়ার্কে আসা কোনো হ্যান্ডসেটই বন্ধ হচ্ছে না। আগের মতো বিটিআরসির ন্যাশনাল ইকুইপমেন্ট আইডেন্টিটি রেজিস্টারে (এনইআইআর) মোবাইল নেটওয়ার্কে আসা সব হ্যান্ডসেট স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিবন্ধন হয়ে যাবে।

ঘোষণায় সীমাবদ্ধ অনিবন্ধিত মোবাইল ফোন বন্ধের ‘তোড়জোড়’

নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ের আলোচনায় উঠে আসে, মোবাইল হ্যান্ডসেট বা প্রযুক্তিপণ্য ব্যবহারে জনগণের কোনো ভোগান্তি হতে দেওয়া যাবে না। বিটিআরসি দেশে সচল সব হ্যান্ডসেটের বিস্তারিত ডাটাবেজ সফলভাবে রাখছে। অন্যদিকে দেশের বাইরে থেকে কোনো হ্যান্ডসেট এলে সেটির ওপর ভ্যাট-ট্যাক্স আদায়ের কাজটি এনবিআরের। আর হ্যান্ডসেটটি কীভাবে এসেছে সেটি প্রয়োজন মনে করলে এনবিআর ও আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী যাচাই করতে পারে।

আরও পড়ুন

বিটিআরসি, ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগসহ সরকারের উচ্চপর্যায়ের এক বৈঠকে সম্প্রতি এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানান কমিশনার প্রকৌশলী শেখ রিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘নতুন সিদ্ধান্ত হয়েছে, যে মোবাইল ফোনগুলো অলরেডি নেটওয়ার্কে ঢুকে গেছে, সেগুলো অটোমেটিক রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছে বলে ধরে নেওয়া হবে। কোনো মোবাইলের নেটওয়ার্ক আলাদা করে বিচ্ছিন্ন করা হবে না।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক জাগো নিউজকে বলেন, ‘অবৈধ মোবাইল ফোনের প্রবেশ ঠেকাতে হবে। এ বিষয়ে আমরা যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, তা বাস্তবায়নে অটল রয়েছি। যে মোবাইল ফোনগুলো এখন মানুষের হাতে হাতে, সেগুলো তো হঠাৎ নৈটওয়ার্ক থেকে বিচ্ছিন্ন করা যায় না। অবৈধভাবে দেশে মোবাইল ফোন আনার দায় তো ব্যবহারকারীর না। যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পদক্ষেপ থেকে আমরা পিছপা হবো না।’

এএএইচ/ইএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।