উগান্ডার স্মৃতি: আবেগঘন ভ্রমণকাহিনি

তানভীর অপু
তানভীর অপু তানভীর অপু , বিশ্ব পর্যটক
প্রকাশিত: ০২:১৮ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বিদায়ের মুহূর্তে উগান্ডার স্মৃতি, ছবি: লেখকের সৌজন্যে

বিদায়ের মুহূর্তে উগান্ডার স্মৃতি, আমার এক আবেগঘন ভ্রমণকাহিনি। অবশেষে সেই মুহূর্ত এসে গেছে; যখন আমাকে বিদায় নিতে হবে উগান্ডা থেকে। যার মাটি-মানুষের সৌজন্য, প্রকৃতির সৌন্দর্য আর আবহাওয়া আমার হৃদয়ের সঙ্গে এমনভাবে মিশে গেছে। মনে হচ্ছে এখানকার প্রতিটি ধূলিকণা, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি হাসি আমার সঙ্গে থেকে যাবে। আমার ভ্রমণ শুরু হয়েছিল কেবল একটি স্বপ্নের মতো কিন্তু শেষ হলো হৃদয়ের মধ্যে গভীর ছাপ রেখে। আমি চাই এই অভিজ্ঞতার প্রতিটি মুহূর্তকে রেকর্ড করতে। যেন এই স্মৃতি চিরকাল জীবন্ত থাকে।

উগান্ডার মানুষের জীবনধারা সত্যিই এক অনন্য অভিজ্ঞতা। এখানে কেউ কারো ব্যক্তিগত বিষয়ে যেমন- ধর্ম সম্পর্ক বা ব্যক্তিগত পছন্দ; এমনকি কারা মদপান করছে, কারা কোন ধর্মের অনুসারী, কারা ট্যাটু করেছে বা কার বন্ধু এবং প্রেমিক আছে—এসব বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। মানুষ নিজস্ব স্বাধীনতায় জীবন যাপন করছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে থাকলেও অন্যরা তাদের মতো জীবন যাপন করছেন। এই ভিন্নতায়ও একসাথে থাকার মধ্যে যে সৌন্দর্য, তা আমাকে মুগ্ধ করেছে।

আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল কেনিয়ার নাইরোবি থেকে। প্রথমেই আমি পাড়ি দিয়েছিলাম লরুগম হয়ে লকিরয়ামা হয়ে মরা বর্ডার ক্রস করে। সীমান্ত পেরোনোর পর আমি পৌঁছলাম উগান্ডার মোরোত শহরে। এখান থেকে সরাসরি রওয়ানা দিয়েছিলাম আমার বন্ধুর ফার্মের উদ্দেশ্যে কাপেলেবিয়ং। জাহিদ ভাইয়ের ফার্মে পৌঁছলে এমন একটি শান্ত পরিবেশ দেখলাম, যা আমার শহরের কোলাহল থেকে একেবারে আলাদা। ফার্মটি সবুজে ভরা, চারপাশে পল্লিজীবন এবং কৃষি কর্মকাণ্ডের এক অনন্য ছন্দ। জাহিদ ভাই শুধু ফার্ম পরিচালনা করছেন না, তিনি বাঙালি কৃষিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। এখানে বিভিন্ন জাতের সবজি চাষের পাশাপাশি মাছ চাষের মতো প্রকল্পেও মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে। সত্যিই এটি দেখে মনে হলো, আমাদের দেশেও এমন সব উদ্ভাবনী এবং সৃজনশীল উদ্যোগ প্রয়োজন।

উগান্ডার স্মৃতি: আবেগঘন ভ্রমণকাহিনি

কাপেলেবিয়ং থেকে আমার পরবর্তী গন্তব্য ছিল কারুমা ব্রিজ হয়ে মাসিন্দি। এই রাস্তাঘাট এবং পরিবেশ আমাকে দারুণভাবে মুগ্ধ করেছিল। উগান্ডার রাস্তা-ঘাট অত্যন্ত উন্নত এবং সুপরিচ্ছন্ন, যা সাধারণত আফ্রিকান দেশগুলোর জন্য অপ্রত্যাশিত। দিনের বেলা গরম থাকলেও আবহাওয়া মোটামুটি তাজা এবং আরামদায়ক ছিল। সত্যিই আমি কোনো ফ্যান বা এসি ছাড়া যাত্রা করেছি, তবুও স্বস্তি অনুভব করেছি।

মাসিন্দি থেকে ভোরের যাত্রা শুরু করে আমি পৌঁছলাম মার্চিসন ফলস ও মার্চিসন ন্যাশনাল পার্কে। পার্কের প্রকৃতি সত্যিই মন্ত্রমুগ্ধকর। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী এবং গাছপালা যেন এক জীবন্ত জঙ্গলকে নির্দেশ করছিল। চারপাশের সবুজ নদীর কোলাহল এবং মুক্ত বাতাস—সবকিছু মিলিয়ে আমার অন্তরকে আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছে। রাতের বিশ্রামের পর আমরা রাত ১১টার সময় রওয়ানা দিয়েছিলাম কাম্পালার উদ্দেশ্যে।

কাম্পালা পৌঁছানোর পর আমার নজর প্রথমেই পড়েছিল শহরের সুন্দর প্রাকৃতিক অবস্থানের ওপর। কাম্পালা একটি পাহাড়ের ওপর গড়ে উঠেছে। মোটামুটি চার-পাঁচটি পাহাড়ের ওপরে। শহরটি শুধু উচ্চতায় নয়, তার পাশে অবস্থিত বিশাল ভিক্টোরিয়া লেকও শহরের সৌন্দর্যকে দ্বিগুণ করেছে। এখানে হাঁটতে গিয়ে মানুষদের হাসি, বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ এবং আতিথ্য আমাকে চমৎকৃত করেছে। যে কোনো প্রশ্নের উত্তর তারা সব সময় আন্তরিকভাবে দেয় এবং হাত নেড়ে স্বাগত জানায়। এমন আচরণ আমাকে বারবার মনে করিয়েছে যে, মানুষের আন্তরিকতা এবং সৌজন্যই জীবনের সবচেয়ে বড় ধন।

উগান্ডার স্মৃতি: আবেগঘন ভ্রমণকাহিনি

আরও পড়ুন

পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী জলপ্রপাতের সঙ্গে দেখা
জিঞ্জা শহর: নীল নদের উৎসের সন্ধান

কাম্পালা থেকে পরের দিন আমি রওয়ানা দিয়েছিলাম জিঞ্জা শহরের উদ্দেশ্যে। জিঞ্জা বিখ্যাত সোর্স অব নাইলের জন্য। এখানে পৌঁছে আমি অনুভব করলাম বিশ্বের দীর্ঘতম নদীটির উৎসস্থলের মাধুর্য। নদীর ধারা পরিবেশ এবং আশেপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য এক অনন্য প্রশান্তি দিচ্ছিল। এখান থেকে ফেরার পথে আমি আবারও অনুভব করলাম উগান্ডার মানুষের জীবনধারা কতটা স্বাধীন এবং সুখী।

উগান্ডায় আসার আগে অনেক মানুষ নেগেটিভ মন্তব্য করেছিল দেশটি নিয়ে। তারা বলেছিল, উগান্ডা নিরাপদ নয়। মানুষের মানসিকতা খারাপ এবং দেশটা উন্নয়নশীল নয়। কিন্তু বাস্তবে এসে আমি দেখেছি এসব কথার কোনো সত্যতা নেই। উগান্ডার মানুষ শান্ত, বন্ধুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। তারা জীবনকে উপভোগ করছে। প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে জীবনযাপন করছে। তাদের স্বাভাবিক সৌজন্য এবং শান্তিপ্রিয় আচরণে আমি মুগ্ধ।

উগান্ডার স্মৃতি: আবেগঘন ভ্রমণকাহিনি

উগান্ডার মাটি সত্যিই উর্বর। জাহিদ ভাইয়ের ফার্মে আমি দেখেছি কীভাবে তিনি সঠিক পরিকল্পনা এবং যত্নের মাধ্যমে সবজি চাষ এবং মাছ চাষের মতো কার্যক্রমের মাধ্যমে একটি স্থায়ী এবং ফলপ্রসূ উদ্যোগ তৈরি করছেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝতে পেরেছি কৃষি শুধু খাদ্য উৎপাদন নয় বরং একটি সৃজনশীল এবং আন্তর্জাতিকভাবে মূল্যবান উদ্যোগ হতে পারে।

বিদায়ের মুহূর্তে আমার মনে এসেছে, আমি যত দূরই যাই না কেন; উগান্ডার মানুষ এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য আমার সঙ্গে থেকে যাবে। প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি পাহাড়, প্রতিটি নদী, প্রতিটি হাসি—সবই স্মৃতির পাতায় স্থায়ী হয়ে থাকবে। মানুষ, প্রকৃতি, ফার্ম, ন্যাশনাল পার্ক, লেক, শহর—সবকিছু মিলিয়ে উগান্ডার ভ্রমণ আমার জীবনের এক অনন্য অধ্যায় হয়ে গেছে।

উগান্ডা শুধু একটি দেশ নয়; এটি একটি অনুভূতি, একটি অভিজ্ঞতা, একটি শিক্ষা। এখানে আমি শিখেছি মানুষের আন্তরিকতা, স্বাধীনতা, সৌজন্য এবং প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে জীবনযাপন করার গুরুত্ব। এখানকার আবহাওয়া, রাস্তা, শহর, ফার্ম—সবকিছুই এক অসাধারণ সমন্বয়। প্রতিটি মুহূর্তে আমি অনুভব করেছি যে, জীবনের প্রকৃত সুখ মানুষের সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে এবং নিজস্ব স্বাধীনতা এবং আনন্দে লুকিয়ে থাকে।

উগান্ডার স্মৃতি: আবেগঘন ভ্রমণকাহিনি

শেষমেষ যখন আমি নাইরোবির উদ্দেশ্যে উগান্ডা ছাড়লাম; হৃদয় ভারী হলেও মনে শান্তি ছিল। দেশটিতে কাটানো প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত আমাকে ভীষণভাবে অনুপ্রাণিত করেছে। আমি জানি, এই বিদায় চিরকাল একটি মিষ্টি ব্যথা রেখে যাবে এবং আবারও ফিরে আসার আকাঙ্ক্ষা জাগাবে। উগান্ডা, তোমার মানুষ, তোমার প্রকৃতি, তোমার আবহাওয়া—সবকিছুই আমার অন্তরে চিরস্থায়ী হয়ে থাকবে।

বিদায় উগান্ডা। তোমার প্রতিটি গলি, প্রতিটি পাহাড়, প্রতিটি নদী, প্রতিটি হাসি, প্রতিটি মানুষের মুখ—সবকিছুই আমার হৃদয়ের সঙ্গে মিশে আছে।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, ধর্ম, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।