ইস্তাম্বুলের তাকসিম স্কয়ারে ‘ধান্দাবাজ’ থেকে সাবধান!

সিরাজুজ্জামান
সিরাজুজ্জামান সিরাজুজ্জামান , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক ইস্তাম্বুল থেকে ফিরে
প্রকাশিত: ০৩:৪৯ পিএম, ২৯ জুলাই ২০২২

ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক তাকসিম স্কয়ার। যা পৃথিবীর সব দেশের পর্যটকের জন্য একটি আকর্ষণীয় ও দর্শনীয় স্থান। দিনের তুলনায় রাতের আলোয় আরও বেশি প্রস্ফুটিত হয় এর সৌন্দর্য। নগরীর ইউরোপীয় অংশে অবস্থিত স্বাধীনতার স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। এর আশপাশে আছে অনেক হোটেল এবং রেস্তোরাঁ। যেখানে পাওয়া যায় স্থানীয় নানা স্বাদ ও ঘ্রাণের খাবার। তবে এলাকাটি কিছুটা অপরাধপ্রবণ। তাই পর্যটকদের সতর্ক থাকা জরুরি।

এটি বেয়োগলুতে অবস্থিত। এখানে আছে মসজিদ, স্বাধীনতার ভাস্কর্য, পার্কসহ নানা ধরনের স্থাপত্য। মসজিদটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। তাকসিম স্কয়ারে এ ধরনের মসজিদ এই প্রথম নির্মিত হয়েছে। তুরস্কের স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের স্মরণে আধুনিক মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছে। আধুনিক সব সুবিধা রেখে উসমানীয় স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি মসজিদটি। এটি এমন এক স্থানে অবস্থিত, যার আশপাশে বহু খ্রিষ্টান গির্জা আছে।

এটি নির্মাণের জন্য তুরস্ককে অনেক চড়াই-উৎরাই পার হতে হয়েছে। ১৯৫২ সালে প্রথম মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তৎকালীন ব্যবসায়ীদের একটি গ্রুপের বিরোধিতার কারণে সে উদ্যোগ ভণ্ডুল হয়ে যায়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইনি বিরোধের শেষপ্রান্তে বর্তমান প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের বিশেষ উদ্যোগে অপূর্ব নির্মাণশৈলীর মসজিদটি খুলে দেওয়া হয়।

মসজিদটি এমনভাবে নির্মাণ করা হয়েছে, যার সাথেই আছে খোলা চত্বর। যেটিকে ঐতিহাসিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের প্রতীক মনে করা হয়। মূলত এটি তুর্কি প্রজাতন্ত্র এবং এর প্রতিষ্ঠাতা মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের একটি স্মারক হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই মসজিদটি নির্মাণে সেক্যুলার গোষ্ঠী আপত্তি তুলেছিল।

jagonews24

১৪৫৩ সালে রোমানদের হাত থেকে চলে যায় মুসলমান তুর্কি অটোমান সম্রাটদের হাতে। তারপর তার নাম হয় ইস্তাম্বুল। এ শহর মিলনের শহর, সহাবস্থানের শহর, ইউরোপের সঙ্গে এশিয়ার। খ্রীষ্ট ধর্মের সঙ্গে ইসলামের, পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের, ইউরোপীয় ক্লাসিক্যাল ও ইসলামিক স্থাপত্যের।

ঐতিহাসিক নানা মসজিদ আর মুসলিম প্রধান দেশ হওয়ায় আমরা তুরস্ককে বাইরে থেকে যেভাবে দেখি বা চিন্তা করি, তার উল্টো চিত্র সে দেশে দেখা যায়। খুব কম মুসলমানই ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলেন। বরং ইউরোপীয় স্টাইলে তরুণ-তরুণীরা ঘুরে বেড়ান। তাদের পোশাকও পাশ্চত্য রীতির। প্রকাশ্যে নারী-পুরুষ চুম্বন কোনো বিষয়ই নয়।

তাকসিম স্কয়ারে আছে শত শত কবুতর। গম কিনে সেই কবুতরকে খাওয়ানোর ব্যবস্থাও আছে। রাষ্ট্রীয় ভাস্কর্য, আতাতুর্ক সংস্কৃতি কেন্দ্র, মারমারা হোটেলসহ দেখার মতো অনেক কিছু।

আমি ইস্তাম্বুল সফর করার সময় তিন দিন তাকসিম স্কয়ারে গিয়েছিলাম। আমার হোটেলইট ছিল সেখান থেকে বেশ খানিকটা দূরে। শহরের অন্যপ্রান্তে বলা চলে। এ জন্য একবার গেলাম উবারের মাধ্যমে। বয়স্ক উবার চালক আমার নাম বুঝেই টের পেয়েছিলেন আমি মুসলমান। তাই তিনি বেশি আন্তরিকতা দেখাচ্ছিলেন। যা অন্য উবার বা ট্যাক্সিক্যাবের চালকরা দেখাননি। বরং তাদের ব্যবহার ছিল রীতিমতো খারাপ। তাকসিম স্কয়ারে নামার সময় তিনি আকারে ইঙ্গিতে সতর্ক করে দিলেন, মানি ব্যাগ যেন সাবধানে রাখি এবং অপরিচিত কারো সঙ্গে কথা না বলি।

jagonews24

দ্বিতীয়বার মেট্রোরেল ও মেট্রোবাসে। সেখানকার কেউই ইংরেজি না বোঝার কারণে এবং রাস্তায় কোনো ইংরেজি সাইন না থাকার কারণে অনেক অসহায় লাগছিল। মেট্রোরেলে চলাচল করার জন্য সহযোগিতা করেছিলেন ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক ছাত্র। এদের আবার একজন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। তবুও ইংরেজি বোঝেন না। বলতে তো পারেনই না। ইংরেজি সাহিত্যও হয়তো তারা তাদের ভাষায় অনুবাদ করে পড়ান। ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে সাহায্য করেছিলেন তারা। বিশেষ করে আমি একজন সাংবাদিক জানার পর আরও বেশি উচ্ছসিত হয়ে ওঠেন। তারা যাচ্ছিলেন সেখানে আরবি একটি কনসার্টে অংশ নিতে। অন্যদের মধ্যে পর্যটকদের সাহায্য করার তেমন আগ্রহ দেখিনি। অনেকে বিরক্ত হয়েছেন। তরুণদের মধ্যে সেটা দেখা যায়নি। আসলে পৃথিবীর সব তরুণের চরিত্রই হলো কম-বেশি অন্যকে সাহায্য করা। এ জন্য তরুণদের প্রতি আমার আগে থেকেই অনেক ভরসা।

তরুণরাও আমাকে বলেছিলেন তাকসিম স্কয়ারে মানি ব্যাগ সাবধানে রাখতে। আমিও সাবধানী ছিলাম। আমাকে একা দেখে অনেক ‘ধান্দাবাজ’ একে একে এগিয়ে আসতে লাগল। এর একজন ছিল হয়তো নারীদের সন্ধান দেয়। চেহারা দেখে ইউরোপীয় মনে হলো। দ্বিতীয় জন হলো আফ্রিকান। সাথে একজন কিশোরী। তিনি এসেই জিজ্ঞেস করলেন, আমি কোথা থেকে এসেছি। আমি দেশের নাম বলার পর উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। বললেন, ও ঢাকার গুলশান? আমি তো চিনি। অথচ আমি গুলশানের নাম উল্লেখ করিনি।

তার মুখে গুলশান এলাকার নাম শুনে আমিও উৎফুল্ল হলাম। এরপর তিনি নিজেকে ব্যবসায়ী পরিচয় দিলেন। বললেন, তিনি ব্যবসার কাজে ঢাকা যাবেন এবং গুলশান থাকবেন। কিন্তু এরপরের প্রশ্নটা আজব। আমাকে বললেন, তিনি তো ব্যবসা করেন। ঢাকায় এসে ব্যবসা করবেন। তাই আমার কাছে থাকা ডলার দেখতে চান। আসলে তিনি বললেন, বাংলাদেশের ডলার দেখতে কেমন? তিনি সেটা দেখতে চান।

jagonews24

লোকটির উদ্দেশ্য বুঝলাম। আমেরিকান ডলার আবার কেমন হয়? এত বড় ব্যবসায়ী হয়েও কি তিনি জানেন না?
আমার কাছে ডলার থাকা সত্ত্বেও অনেকটা বিরক্ত হয়েই বললাম, আমি ডলার ব্যবহার করি না। আমার কাছে ক্রেডিট কার্ড কাছে। আমার মুখ দেখে তিনি তাড়াতাড়ি কেটে পড়লেন। সঙ্গের শিশুটিকে প্রশ্ন করারও সুযোগ দিলেন না।

পরে বুঝলাম মানুষের মধ্যে বিশ্বাস স্থাপনের জন্য তার এই কৌশল। তাই সেখানে সবাইকে এসব ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। কারণ তিনি হয়তো মানি ব্যাগ নিয়ে চম্পট দিতেন কিংবা কৌশলে আসল ডলার রেখে নকল ডলার বদলে দিতেন। একটু চোখ-কান খোলা রাখলে ভয়ের কিছু নেই। সেখানে পুলিশ অনেক তৎপর। যদিও সেই সময় আশপাশে কোনো পুলিশ পাইনি। থাকলে অবশ্যই পুলিশ ডেকে এ ধান্দাবাজকে জেরার মুখোমুখি করতাম।

এইচএস/এসইউ/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।