জমিদার রায় বাহাদুরের বাড়ি এখন পোল্ট্রির খামার

উপজেলা প্রতিনিধি উপজেলা প্রতিনিধি মিরসরাই (চট্টগ্রাম)
প্রকাশিত: ১২:৫২ পিএম, ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩

চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে জমিদার রায় বাহাদুর পুরাকীর্তির স্মৃতিচিহ্ন। ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক ‘রায় বাহাদুর’ উপাধিপ্রাপ্ত মিরসরাই উপজেলার জমিদার গোলক চন্দ্র চৌধুরীর বাড়িটিতে এখন গড়ে উঠেছে পোল্ট্রি ও গরুর খামার।

বর্তমান প্রজন্ম প্রায় ভুলেই গেছে উপজেলার ধুম ইউনিয়নের মহাজনহাট এলাকায় রায় বাহাদুরের একটি বাড়ি ছিলো। ১৯ শতকের মাঝামাঝিতে নির্মিত ওই পুরাকীর্তি দেখার জন্য একযুগ আগেও দেশ বিদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকরা ভিড় জমাতেন।

আরও পড়ুন: ৬ বছরেই দেশের ৬৪ জেলা ঘুরেছেন সাফাত-শিখা দম্পতি

তবে গত কয়েক বছরে রায় বাহাদুরের পুরাকীর্তিটি ভেঙে গড়ে উঠেছে বিশাল বিশাল পোল্ট্রি খামার। জানা গেছে, তৎকালীন সময়ে জমিদার গোলকচন্দ্র চৌধুরী (রায় বাহাদুর) ফেনী থেকে মিরসরাইয়ের ধুম ইউনিয়নে এসে বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন।

নান্দনিক স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত এই বাড়িটির দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৫০ ফুট ও ৪০ ফুট করে প্রস্থের দুই ভাগে নির্মিত। দোতলা এই বাড়ি নির্মাণে কোনো লোহা ব্যবহার করা হয়নি। ইট ও কাঠ দিয়ে পুরো বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিলো বলে মত স্থানীয়দের।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রায় বাহাদুরের বাড়ির কোনো চিহ্ন এখন নেই। স্থানীয় পোল্ট্রি ব্যবসায়ী জাবেদ ইকবাল ক্রয় সূত্রে মালিকানা নিয়ে বাড়িটিতে একাধিক পোল্ট্রি ও গরুর খামার গড়ে তুলেছেন।

jagonews24

আরও পড়ুন: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর আলতাদিঘি

জাবেদ ইকবাল জানান, তিনি সম্পত্তিগুলো কিনে নেওয়ার আগেই পুরাকীর্তিটি জায়গার আগের মালিকরা ভেঙে ফেলেছেন। এখন এখানে রায় বাহাদুরের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।

নিশান নামে মহাজনহাট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রাক্তন ছাত্র জানান, রায় বাহাদুরের বাড়িটি ভাঙাচুরা হলেও ছিলো দেখার মতো। এক সময় অনেক পর্যটক বাড়িটি দেখতে আসতেন।

তবে সরকার বা স্থানীয় প্রশাসন এ পুরাকীর্তিটি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া দুঃখজনক। ফলে আগামী প্রজম্ম জানতেই পারবে না মহাজনহাট এলাকায় একটি পুরাকীর্তি ছিল।

জানা গেছে, রায় বাহাদুরের পৈতৃক নিবাস ছিলো ফেনী জেলায়। তৎকালীন সময়ে রায় বাহাদুর স্বপরিবারে ফেনী থেকে মিরসরাইয়ের ৪ নং ধুম ইউনিয়নে চলে আসেন ও একক প্রচেষ্টায় সেখানে একটি হাট তথা ‘বাণিজ্যিক কেন্দ্র’ গড়ে তোলেন।

আরও পড়ুন: ঢাকার কাছেই ঘুরে আসুন শাপলার রাজ্যে

রায় বাহাদুর নিজের তত্ত্বাবধায়নে তার পাইক পেয়াদাদের মাধ্যমে সেই বাণিজ্যিক কেন্দ্র কলকাতাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দ্রব্য সামগ্রী পাইকারি দামে আমদানি করে চট্টগ্রাম শহরের পাহাড়তলি, কুমিরাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খুচরা দামে সরবরাহ করতেন।

এছাড়া ওই হাটে মিরসরাই সীতাকুণ্ড ও ফেনীর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ক্রেতা বিক্রেতারা পন্য দ্রব্য কেনা বেচা করতেন । পরবর্তীতে তিনি (রায় বাহাদুর) সেখানে মহাজনী ব্যবসা (সুদে টাকা ধার দেওয়া) শুরু করেন।

পরে তার নামানুসারেই এই বাণিজ্যিক কেন্দ্রটির নামকরণ হয় ‘মহাজনহাট’। উপজেলার ৪ নং ধুম ইউনিয়নে অবস্থিত সেই মহাজন হাটের সামান্য দক্ষিণে গেলে একযুগ আগেও চোখে পড়ত গোলকচন্দ্র চৌধুরী প্রকাশ রায় বাহাদুরের স্মৃতি বিজড়িত একটি বাড়ি।

আরও পড়ুন: ঢাকার কাছেই ঘুরে আসুন গোলাপের রাজ্যে

খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, রায় বাহাদুরের সময়কাল থেকে বর্তমান সময়কাল পর্যন্ত বাড়িটির হাত বদলের কাহিনী। ১৯০৫ সালে রায় বাহাদুর মৃত্যুকালে তার পাইক পেয়াদাদেরকে তার সম্পত্তির কিছু অংশ ও বাড়িটি বিভিন্ন ভাগে ভাগ করে দিয়ে যান।

jagonews24

পরে ভারতের বোম্বে থেকে আসা আন্ধারমানিক চা বাগানের মালিক সালাম সাহেবের কাছে তার (রায় বাহাদুর) পাইক পেয়াদারা বাড়িটি বিক্রি করে দেয়। পরে সালাম সাহেবের বংশধররা বাড়িটির একটি অংশ স্থানীয় মনির আহমেদ ও অন্য একজনের কাছে বিক্রি করেন।

দুই পরিবারেই দীর্ঘদিন ধরে বাড়িতে বসবাস করেছে। তার মধ্যে মনির আহমদের পরিবার ১৯৯০ সালের দিকে নতুন বাড়ি করে অন্যত্র চলে যান। ২০১১ সাল পর্যন্ত আইনুল ইসলাম নামে একব্যক্তি পরিবার নিয়ে বাড়িটিতে বসবাস করেছে। পরে বাড়িটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠায় তারাও সম্পত্তি বিক্রি করে অন্যত্র চলে যায়।

আরও পড়ুন: একদিনেই কীভাবে ঘুরে আসবেন মহামায়া লেক থেকে?

বর্তমানে রায় বাহাদুরের অধিকাংশ সম্পত্তি রয়েছে পোল্ট্রি ব্যবসায়ী জাবেদ ইকবালের নামে। এ অঞ্চলের মানুষের গর্বের মহামূল্যবান পুরাকীর্তিটি সংরক্ষণের অভাবে নিচিহ্ন হয়ে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মিরসরাই ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক ডা. জামশেদ আলম।

গোলকচন্দ্র চৌধুরী কীভাবে ‘রায় বাহাদুর’নামে পরিচিতি লাভ করেন? জানা যায়, ১৯৭০ সালের দিকে চট্টগ্রাম কলেজ প্রতিষ্ঠার পর বিংশ শতাব্দির দ্বারপ্রান্তে এসে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিলো কলেজটি।

আরও পড়ুন: হাউজবোটে টাঙ্গুয়ার হাওর ভ্রমণে কীভাবে যাবেন, খরচ কত?

চট্টগ্রামের বিখ্যাত বাজার মিরসরাইয়ের মহাজন হাটের মহাজন গোলক চন্দ্র চৌধুরী তৎকালীন সময়ে নগদ ‘দশ হাজার’ টাকা দিয়ে কলেজটিকে বাঁচিয়ে রাখেন। কালের বিবর্তনে বর্তমানে কলেজটি চট্টগ্রামের সেরা কলেজ গুলোর একটি।

কলেজটিকে বাঁচিয়ে রাখার পুরষ্কার স্বরূপ, তৎকলীন ব্রিটিশ সরকার গোলকচন্দ্র চৌধুরীকে ‘রায় বাহাদুর’ উপাধি দেয় । সে থেকে গোলকচন্দ্র চৌধুরী ‘রায় বাহাদুর’ নামে পরিচিত ।

জেএমএস/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।