গৌরীপুরের সেই জমিদার বাড়ি এখন জরাজীর্ণ ছাত্রীনিবাস

সালাহ উদ্দিন জসিম
সালাহ উদ্দিন জসিম সালাহ উদ্দিন জসিম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক গৌরীপুর (ময়মনসিংহ) থেকে ফিরে
প্রকাশিত: ১১:০৬ এএম, ১৮ মার্চ ২০২২

ময়মনসিংহ শহর থেকে সড়কপথে ২০ কিলোমিটার ভেতরে গৌরীপুর উপজেলা। ছোট্ট এ উপজেলা শহরে ঢুকতেই চোখে পড়বে কয়েকশো বছরের পুরোনো সব স্থাপনা। এসব ঐতিহ্যবাহী ভবনে এখন স্কুল-কলেজ, প্রেস ক্লাব, সরকারি কার্যালয়, এমনকি সিনেমা হলও রয়েছে। যে কোনো আগন্তুক শহরটিতে পা রেখেই জমিদারি আমলের পরশ পাবেন। কৌতূহলী চিত্তে হয়তো খুঁজতে চাইবেন, ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বহুবর্ষী এসব ভবনের নেপথ্যের গল্প।

jagonews24

সরেজমিনে গৌরীপুর সদরে পৌঁছেই পশ্চিম দিক ধরে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ে একটি পুরোনো স্থাপনা। এটি এখন প্রেস ক্লাব। পাশ দিয়ে একটি তোরণ। ভিতরে রয়েছে পুরোনো আমলের একটি মন্দির। মন্দিরের পাশ দিয়ে হেঁটে কিছুদূর এগোলে চোখে পড়ে জরাজীর্ণ একটি পুরোনো বাড়ি। উত্তর দিকে কলেজের নতুন ভবন। এগিয়ে গিয়ে জানা গেলো এটিই গৌরীপুর ডিগ্রি মহিলা কলেজ। কলেজ মাঠের দক্ষিণ বরাবর একটি পুরোনো দোতলা ভবন। নিচতলায় টিমটিমে আলো আর সোঁদা গন্ধ। এর মধ্যেই বসে আছেন কলেজের কয়েকজন সহকারী-পিয়ন, আয়া। কিছু দাপ্তরিক কাজ চলে এখানে। ভিতরে ঢুকে দেখা গেলো পূর্ব দিক দিয়ে একটি সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলায়। দক্ষিণে একটি উঠোন বা লন। তাতে সবুজ লম্বা ঘাস-গুল্ম। একেবারে দক্ষিণ প্রাচীর ঘেঁষে আরেকটি জরাজীর্ণ ভবন। প্রথম দেখায় যে কেউ এটিকে ‘ভুতের বাড়ি’ মনে করতেই পারেন। জনবিরল সেই বাড়ি ঘিরে গভীর এক নির্জনতা আর নিস্তব্ধতা। আরেকটু এগোতেই ভেতর থেকে কী যেন একটা শব্দ ভেসে আসে। কৌতূহলে আরও এগিয়ে দেখা যায় এগুলো বাদুড়ের চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ। খানিক দাঁড়াতেই গন্ধে শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম। যেন বহু বছর মানুষের পায়ের ছাপ পড়েনি এখানে। আলগা হয়ে গেছে ছাদ। লতাগুল্মে আচ্ছাদিত জমিদার বাড়ির সেই অন্ধকার জনশূন্য ভবনের একাংশ যেন এখন নিশাচর বাদুড়ের দখলে!

jagonews24

উঠোনের উত্তরপাশের দোতলা মূল ভবনে কিছুদিন আগেও ক্লাস-পরীক্ষা হতো। সে ছাপ রয়ে গেছে এখনো। নিচতলার কয়েকটি কক্ষে রয়েছে বিভাগের নাম লেখা। বেঞ্চও আছে কিছু। এ ভবনটি ঘিরেই গৌরীপুর মহিলা কলেজের যাত্রা শুরু। বর্তমানে ভবনটির নিচতলায় বসেন মহিলা কলেজের প্রধান সহকারী শহীদুল্লাহ। বহুবর্ষী সেই ভবনের দোতলায় ছাত্রীনিবাস। একসময় এ ভবনেই চলতো ক্লাস ও প্রশাসনিক কার্যক্রম। পরবর্তীকালে নতুন একাডেমিক ভবনে ক্লাস ও প্রশাসনিক কার্যক্রম স্থানান্তর হয়। জমিদারি আমলের এ ভবনগুলোর গল্প শুনতে কলেজের প্রধান সহকারীর সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, এ ভবনগুলো অন্তত দেড় থেকে দুইশো বছরের পুরোনো বলে তার ধারণা। তবে এ নিয়েও রয়েছে দ্বিমত। ইতিহাসবেত্তাদের কেউ কেউ মনে করেন, সতেরশো শতকের দিকে এ অঞ্চলে জমিদারি প্রথার গোড়াপত্তন। শহীদুল্লাহর কথায়, মহিলা কলেজ ছাত্রীনিবাস ভবনটি ব্যবহারের অনুপযোগী। সেখানে দিনরাত বাদুড়ের উৎপাত।

অনুমতি নিয়ে দোতলার ছাত্রীনিবাসটিতে গিয়ে গা ছমছম করে ওঠে। বুঝি এখনই ভেঙে পড়বে! বেশ কয়েকটি অন্ধকার কক্ষ। তার ভিতরে থাকেন ১৫-২০ জনের মতো ছাত্রী। কক্ষগুলোতে টিমটিমে বাতি জ্বালিয়ে পড়ছিলেন কেউ কেউ। ছাদের উপরেই শৌচাগার। একটি কক্ষ থাকার অনুপোযোগী হওয়ায় সেটা রয়েছে পরিত্যক্ত অবস্থায়। ভবনের কেয়ারটেকার ও ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানকার পরিবেশ-প্রকৃতির সঙ্গে তারা মানিয়ে নিয়েছেন। এখন আর তাদের ভয় লাগে না। দেওয়ালের আস্তর উঠে গেলেও তেমন শঙ্কা নেই। ভবন ভেঙে পড়বে না। কারণ এভাবেই কেটে গেছে দীর্ঘ ৪০ বছর। এখনো চলছে পড়াশোনা-থাকা। তাদের বিশ্বাস, দেখতে জরাজীর্ণ হলেও ভবনটি খুবই মজবুত।

jagonews24

শহীদুল্লাহর ভাষ্য, এটি মূলত জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর চৌধুরীর বাড়ি। তিনি নিজেই এ ভবন নির্মাণ করেছিলেন। ব্রিটিশ শাসন ভেঙে পাক-ভারত উপমহাদেশে নিজস্ব শাসন হবে, এমন আভাস পেয়ে জমিদাররা পরিবার নিয়ে আগেই এ অঞ্চলে চলে আসেন। তাদের কোনো উত্তরাধিকারও ছিল না।

জমিদার বাড়ির যে অংশটিতে মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় সেটির প্রকৃত গোড়াপত্তনকারী কে, ইতিহাস বিশ্লেষণে এ নিয়েও রয়েছে মতান্তর। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে, জমিদার আনন্দ কিশোরের বাড়িটিই বর্তমান গৌরীপুর মহিলা কলেজ। তবে স্থানীয় সাংবাদিক, গবেষক ও ইতিহাস সন্ধানী মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকারের দাবি, যুগলকিশোর রায়চৌধুরীই বর্তমানে গৌরীপুর মহিলা কলেজের জমিদার বাড়ির গোড়াপত্তনকারী। তার মতে, এই যুগলকিশোর মাধবী তথা আলেয়ার গর্ভজাত, অর্থাৎ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পুত্র। যাকে দত্তক নিয়েছিলেন তৎকালীন মোমেনসিং পরগনা (উত্তর-পূর্ব ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা) ও জফরশাহীর পরগনার (জামালপুর) জমিদার শ্রীকৃষ্ণ রায়চৌধুরীর পরিবার। দত্তক নেওয়ার পর সিরাজপুত্রের নতুন নাম রাখা হয় যুগলকিশোর রায়চৌধুরী। রায়হান উদ্দিন মনে করেন, ঠিক এখান থেকেই নতুন করে যাত্রা শুরু নবাব সিরাজের বংশের।

jagonews24

সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মহিলা কলেজ ছাড়াও জমিদার সুরেন্দ্র প্রসাদ লাহিড়ীর বাড়িটি এখন গৌরীপুর সরকারি কলেজ। এছাড়া রাজেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরীর বাড়িটি বর্তমান আর কে হাইস্কুল। দুই-আড়াইশো বছর আগে জমিদাররা এ অঞ্চলে পাড়ি জমিয়ে নিজেদের জমিদারির গোড়াপত্তন করলেও শুরুতে তারা ছিল অখণ্ড। পরবর্তীকালে সম্পত্তির ভাগাভাগিসহ পারিবারিক নানা অন্তর্কলহে তাদের মধ্যে ভাঙন ধরে। তারা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। তবে গৌরীপুরের অখণ্ড জমিদার পরিবারের ভাঙন ও বিস্তারের ইতিহাস বর্ণনা এ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নয়। মুহাম্মদ রায়হান উদ্দিন সরকার মনে করেন, নতুন প্রজন্মকে ইতিহাসের প্রকৃত সত্য জানানো দরকার। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে গবেষণার তাগিদ তার।

যে জরাজীর্ণ ভবনটিতে এখন মহিলা কলেজের শিক্ষা কার্যক্রম চলছে এর যাত্রা ১৯৮১ সালে। কলেজের প্রধান সহকারী শহীদুল্লাহ জানান, শুরুতে ইন্টারমিডিয়েট কলেজ হিসেবে কার্যক্রম চালু হলেও পরে ডিগ্রি কলেজ পর্যন্ত উন্নীতকরণ হয়। বর্তমানে পাঁচটি বিষয়ে অনার্স চালু হয়েছে। ১৯৮৬-৮৭ সাল থেকে চালু হয় ছাত্রীনিবাসও। উত্তর ময়মনসিংহে নারীদের একটা বৃহৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে গৌরীপুর জমিদার বাড়ির এ মহিলা কলেজ। শিক্ষা কার্যক্রম এখন চলে নতুন ভবনে। তবে অফিসিয়াল কিছু কার্যক্রম আর ছাত্রীনিবাসটি এখনো বহাল তবিয়তে।

jagonews24

ব্রিটিশ আমলের এসব ভবন শিক্ষার্থীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কি না, জানতে চাইলে শহীদুল্লাহ বলেন, যেহেতু জরাজীর্ণ ভবন, ফলে ছাত্রীদের মধ্যে আশঙ্কা তো থাকতেই পারে। আমরা সংস্কার করে বসবাস উপযোগী করে নিয়েছি। এটা ড্যাম বিল্ডিং, বসবাস না করাই ভালো। আমরা নিরূপায়, ছাত্রীদের নিরাপদ নিবাসের জন্য আলাদা সংস্থান কোথায় পাবো? সরকারিভাবে যদি এখানে আলাদা ছাত্রীনিবাস হয়, সেটাই হবে মঙ্গলজনক। এছাড়া আমাদের প্রশাসনিক ভবনও নেই।

তিনি বলেন, ছাত্রীনিবাস ও প্রশাসনিক ভবন আলাদা করার উদ্যোগ আছে। মেয়েদের কলেজ তো, অবৈতনিক। আয়ের আর কোনো রাস্তাও নেই। অ্যাকাডেমিক ভবনটা সরকারিভাবে করে দেওয়া হয়েছে। বাকিগুলোর জন্যও চেষ্টা চলছে।

jagonews24

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের অনেকেই অন্যান্য অঞ্চল থেকে বহু বছর আগে এখানে এসে বসবাস শুরু করেন। যারা এখন স্থানীয় হিসেবেই পরিচিত। দিন দিন শহরের ব্যাপ্তি বাড়ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও যোগাযোগের প্রসার হচ্ছে। ফলে জমিদারি আমলের ভবনগুলো যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করা গেলে শিক্ষাক্ষেত্রেও এগিয়ে যাবে এ অঞ্চল। পুরোনোকে ভিত্তি করে নতুন সৌন্দর্যে হাসবে জমিদারদের ছায়াসিঞ্চিত গৌরীপুর।

এই কলেজ ছাত্রীনিবাস ছাড়াও উপজেলার অনেক স্থাপনা জমিদার আমলের। জমিদার ডি কে লাহিড়ীর জমিদার বাড়িটি এখন এসি (ল্যান্ড) বা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয়। ব্রজেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরীর নাট্যশালা এখন পরিত্যক্ত সিনেমা হল। জমিদারি আমলের ভবনগুলো ঘিরেই চলছে মফস্বল এ শহরটির প্রশাসনিক কার্যক্রম।

এসইউজে/এমকেআর/এএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।