কলকাতা ভ্রমণ: পর্ব-৭

মির্জা গালিব স্ট্রিটের গেস্ট হাউজ

ভ্রমণ ডেস্ক
ভ্রমণ ডেস্ক ভ্রমণ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১:০৩ পিএম, ২৩ এপ্রিল ২০২৪

সাইখ আল তমাল

দুপুরের খাবারটা এখানেই সেরে নিলাম। আহামরি কিছুই নয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের খাবারের দোকান আর ফুডকোর্টে যেমন খাবার খাই—তেমনই। আমি চিকেন চাওমিন আর কাবাব নিয়েছিলাম। অনিকদা শুধু চাওমিন খেলো। তবে এখানকার খাবারের মান ভালো। ততক্ষণে বিকেল হতে চললো। অনিকদা আমাকে এখান থেকে বিদায় দিয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে পড়বে আর এখানেই আমাদের শেষ দেখা এবারের মতো। আমার গন্তব্য এখন পার্কস্ট্রিট। দমদম মেট্রো স্টেশন পর্যন্ত অনিকদার সঙ্গেই এলাম। তাকে বিদায় দিয়ে আর বাকি পথ চলার মতো নির্দেশনা নিয়ে আমি পার্কস্ট্রিটের মেট্রোতে চড়লাম। নামতে হবে এক নম্বর গেটে। সেখান থেকে গুগল ম্যাপ দেখে দেখে রহমান গেস্ট হাউজের ঠিকানা বের করতে হবে। এখন থেকে পরদিন বেলা ১১টা পর্যন্ত আমাকে একাই চলতে হবে। এই পথ আমার সম্পূর্ণ অচেনা। গুগল ম্যাপই আমার ভরসা। পার্কস্ট্রিটে ট্রেন থামতেই দ্রুত নেমে গেলাম। মেট্রো পুলিশের কাছে এক নম্বর গেটের লোকেশন জেনে নিলাম। কিন্তু এখানকার পুলিশ বাংলা বোঝে না, হিন্দিতে কথা বলে। কলকাতার নিউমার্কেট এলাকাসহ পুরো কলকাতার মুসলমান সম্প্রদায়ও উর্দুতে কথা বলে। বাংলা বলে না যতটুক শুনেছি। আমার হিন্দি বা উর্দু বুঝতে সমস্যা হয় না, শুধু বলতে গেলেই আটকে যাই। এ নিয়ে অবশ্য কোনো ঝামেলায় পড়তে হয়নি।

এক নাম্বার গেট দিয়ে বের হয়ে ম্যাপ দেখে হেঁটে চলেছি। আশপাশে নতুন পরিবেশ। ততক্ষণে দিনের আলো নিভে গেছে। অন্ধকার নেমে এসেছে শহরে। অচেনা গলি দিয়ে হেঁটে চলেছি। মোড়ে মোড়ে পরিত্যক্ত পুরোনো বাড়ি। অনেকটা গল্পের পোড়া জমিদার বাড়ির মতো। পুরোনো কংক্রিটের দেওয়াল চিঁড়ে বট গাছ গজিয়েছে।

ভেতরটায় ঘুটঘুটে অন্ধকার, রাস্তায় আলো জ্বলছে—জায়গাটা শহর না হয়ে মফস্বল কিংবা অজপাড়াগাঁ হলে এতক্ষণে ভয়ে গা ছমছম করে উঠতো! আমার আবার এসবে ভয়টয় কম শৈশব থেকেই। কম বলে যে ভয় একদম পাই না তেমনটা নয়! ভূতের ভয় হয়তো নেই কিন্তু মানুষের ভয় তো আছে অচেনা পথে। ছোটবেলায় কাকডাকা ভোরের আগেই বন-জঙ্গল মাড়িয়ে কত আমতলা আর তালতলা দাপিয়ে বেরিয়েছি, এখন ভাবলে নিজেই অবাক হয়ে যাই। এতটা দুঃসাহসী ছিলাম! শিশু বয়সে যেখানে যেখানে গিয়েছি, এখনো কোনো কিশোর কিংবা যুবক সেখানে অন্ধকারে একা যাওয়ার সাহস করবে না। আমার গ্রামটা এখনো সেই আগের মতোই আছে। রাস্তার দুপাশে ঘন জঙ্গল, ভেতরে ভেতরে নতুন-পুরোনো কয়েকটি কবর। সন্ধ্যা নামার আগেই শেয়ালের দল রাস্তায় হাজির। ‘হুক্কা হুয়া’ ডাকে অজানা আতঙ্ক নামে গ্রামজুড়ে।

ম্যাপ দেখে হাঁটার অদ্ভুত একটা দিক হলো—মাঝে অনেকটা পথ ঘুরে যেতে হয়। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। অনেক গলি ঘুরে শেষ পর্যন্ত পেলাম রহমান গেস্ট হাউজ। কিন্তু ঠিকানা অনুযায়ী এসে এই নামের কোনো হোটেল দেখতে না পেয়ে ভড়কে গেলাম। জায়গাটা মির্জা গালিব স্ট্রিট—এখানেই অধিকাংশ হোটেল বা গেস্ট হাউজ। মুসলমান কিংবা বাংলাদেশি পর্যটকরা এই এলাকাতেই বেশি আসে। পথে অনেক বাংলাদেশিকেই চোখে পড়েছে। পরিবার নিয়ে ঘুরতে এসেছেন বেশিরভাগ। এখানে স্থানীয় মুসলিমও বেশি। এখানে এসে মির্জা গালিবের স্মরণ হলো বেশ।

চলতি সংকলনে ২৩৪ গীতিকাব্য নিয়ে উর্দু কাব্যে যে আসন তিনি দখল করেছেন তা ঈর্ষণীয় বটে। লোকে বলে কাব্য যদি ধর্ম হয় তবে গালিবকে না বোঝা এই ধর্মে কাফের হওয়ার সমতুল্য।
‘‘বন্দেগি মে ভি ও আযাদ-ও-খুদবি হ্যায় কি হাম
উলট ফির আয়ে দরে কাবা আগার ওয়া না হুয়া—
অর্থাৎ
‘বন্দেগি করার ক্ষেত্রে আমরা এতটাই স্বাধীন আর অহংকারী যে
উলটো ফিরে আসি যদি কাবার দরজা বন্ধ থাকে।’
‘যদি বিশ্বাস থাকে খোদা তোমার প্রার্থনা কবুল করবেন,
তবে তার কাছে কিছুই চেয়ো না,
যদি কিছু চাইতেই হয় তবে একটি হৃদয় চেয়ো
যার কোনো ভয় নেই, লক্ষ্য নেই এবং কামনা নেই—’’

পার্কস্ট্রিটের রহমান গেস্ট হাউজ

মির্জা গালিব বেঁচে আছেন যমুনা নদীর প্রবাহে। যতদিন যমুনার বুকে তাজমহলের ছায়া পড়বে; মির্জা গালিব ততদিন অমর থাকবেন। এখানে এসে কবিকে মনে পড়লো। যেন সুরার পেয়ালা হাতে মুশায়রা মাতাচ্ছেন কবি। দিল্লির অভিজাতরা মাতাল হয়ে শুনছেন গালিবের শায়েরী। আগ্রার আকাশে গালিব যে ঘুড়ি উড়িয়েছেন তা আজও উড়ছে। নাটাই তিনি নিজের কাছেই রেখেছেন। কাব্যপ্রেমীদের ইচ্ছা হলেই নাচান, ইচ্ছা হলেই আবার ভোকাট্টা। গোত্তা খেয়ে উলটে পড়ে যমুনার বুকে। পৃথিবীর সাদা পৃষ্ঠা ভরে ওঠে গালিবের বন্দনায়।
‘হে গালিব তুমি আমার বসন্ত!
তোমাকে আলিঙ্গন করি পরম ভক্তিতে
হে গালিব তুমি প্রেয়সীর যাতনা ভোলার মহৌষধ,
তোমাকে সেবন করে প্রেমিক হয় কবি—’
দুনিয়ার খাতায় নিজেকে কখনো বাড়তি হরফ মনে হয় না। মহাজনী প্রেমিকার সুদের ঋণ আজ পাহাড় সম। যে প্রেম তাকে দিয়েছি; সে প্রেম তার শোধ করার সাধ্য নেই। সে বোকা প্রেমিকা কবির মর্ম বুঝলো না।

সন্ধ্যার আলো প্রায় নিভে গেছে।
হোটেল লাগবে?—ভেসে আসে অচেনা কণ্ঠ।
না বলার অভ্যেস নেই তাই চুপচাপ এগিয়ে যাই। কিন্তু অচেনা কণ্ঠ নাছোরবান্দা।
বাধ্য হয়েই মুখ খুললাম, রহমান গেস্ট হাউজ কোনদিকে?
সিঁড়ি দেখিয়ে পাঁচতলায় যেতে বললেন। পাঁচতলায় যেতেই চোখে পড়লো মাঝারি আকারের সাইনবোর্ড ঝোলানো। বড় করে লেখা ‘রহমান গেস্ট হাউজ’। ঢুকতেই বিশালদেহী লম্বা চুল, ছোট চোখ আর নাক বোচা ফর্সা চেহারার লোকের সামনে পড়লাম। লোকটা দেখতে অনেক কনফুসিয়াসের মতো।

কনফুসিয়াসকে আমি দেখিনি। তবে তার বেশকিছু চিত্র দেখেছি। লোকটা চীনা নিশ্চিত ধরে নিলাম। কলকাতায় চীনাদের উপস্থিতি মন্দ নয়। ১৯৬২ সালে ইন্দো-চীন যুদ্ধের পর কর্মসংস্থানের খোঁজে ভারতে চলে আসেন বহু চীনা পরিবার। তখন থেকে আজ অবধি কলকাতায় বেশ কিছু চীনা পরিবার থেকে গিয়েছে। এমনকি কলকাতা থেকে গত পাঁচ দশক ধরে প্রকাশিত হয়ে আসছিল সিওং পাও নামক চীনা দৈনিক। এ ছাড়া অনেকগুলো চীনা দৈনিকই ভারত থেকে প্রকাশিত হতো। তবে কালক্রমে সবগুলো বন্ধ হয়ে টিকেছিল শুধু সিওং পাও। সেটিও ২০২৩ সালে বন্ধ হয়ে যায়।

লোকটির নাম আমি জানি না, জিজ্ঞাসাও করা হয়নি। শুধু বললাম হোয়াটসঅ্যাপে একটি কামরা আমি ঠিক করে এসেছিলাম। সেটিতে উঠতে চাই। বলতেই সে প্রমাণ দেখতে চাইলো। দেখানোর পর নির্ধারিত কামরায় নিয়ে গেল। আর আমার পাসপোর্টের নাম্বার খাতায় টুকে নিলো। আপাতত দু-রাত থাকা হবে এখানে, তারপর ফেরা। এখন থেকে পরদিন সকাল এগারোটা পর্যন্ত আমি সম্পূর্ণ একা। ফোনে অবশ্য অনিকদাকে জ্বালাতে হচ্ছে, কিন্তু উপায় নেই। গোসল সেরে বের হলাম নিউমার্কেটের উদ্দেশ্যে। আসার সময় কয়েকজন ফর্দ ধরিয়ে দিয়েছিল। এগুলোর ঝামেলা এখন মেটাতে হবে।

অনিকদা বলেছিল, নিউমার্কেটে আমিনিয়া নামে একটা রেস্তোরাঁ আছে। এখানকার মাটন বিরিয়ানির স্বাদ না নিয়ে যেন ঢাকায় না ফিরি। তাই নিউমার্কেট ঢুকেই আগে আমিনিয়ার খোঁজ করলাম। খুঁজতে বেগ পেতে হয়নি। তারপর নিউমার্কেট ঢুকে কেনাকাটার ঝামেলা শেষ করে আরেক বিড়ম্বনায় পড়লাম। ক্যাশ রুপি সব ততক্ষণে শেষ। এখন কার্ড পেমেন্টই ভরসা। আমিনিয়াতে মাটন বিরিয়ানি খেলাম। তবে এখানে সালাদ কিনতে হয়। এর জন্য গুনতে হয় বাড়তি পঞ্চাশ থেকে ষাট রুপি। এটাই হয়তো প্রথমবার রেস্তোরাঁয় খেতে এসে আমার সালাদ কেনার ঘটনা। খাবারের স্বাদের কথা বলতে গেলে ঢাকাই কাচ্চির কাছে এ কিছুই নয়। তবে খেতে ভালো।

খাওয়া শেষে কার্ডেই বিল পরিশোধ করে এটিএম খুঁজতে বের হলাম। কিন্তু এখানে এসেও দিতে হলো আক্কেল সেলামি। পাঁচশ রুপি বের করতে গিয়ে বাড়তি তিনশ রুপি টারমিনাল চার্জ কেটে নিলো কার্ড থেকে। দশ হাজার রুপি বের করলেও একই চার্জ নিতো। তাই আটশ রুপি খরচ করে পাঁচশ রুপি ক্যাশ নিয়েই গেস্ট হাউজের পথ ধরলাম। রাতে আর কোথাও বের হবো না, এখন শুধু ঘুম।

আগের পর্ব পড়ুন

ট্রেনে চেপে চলে এলাম কলকাতা 
হাবড়া শহরের অচেনা অতিথি 
ডাফ লেনের শতবর্ষী বাড়ি 
১৭৫ বছরের বেথুন কলেজিয়েট স্কুল 
বিপ্লবী প্রীতিলতার বাঁশি 
সরোদের সুরে বিরহের গান 

এসইউ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।