মতামত

শেয়ারবাজারে সফলতার মূলমন্ত্র: ধৈর্য ও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি

খারাপ সময়ে শেয়ারবাজারে একজন ইনভেস্টর হিসেবে কেমন আচরণ করা উচিত—এই প্রশ্নটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীদের কাছে এক চিরন্তন দ্বিধা। ২০১০ সালের ভয়াবহ ধসের পর প্রায় দেড় দশক পেরিয়ে গেছে, শেয়ারবাজারে হাজারো মানুষ প্রবেশ করেছে, আবার অনেকে ক্ষতির হতাশা নিয়ে বাজার ত্যাগ করেছে। বাজার সেই আগের জৌলুস এখনো পুরোপুরি ফিরে পায়নি—এটাই বাস্তবতা। কিন্তু একই বাস্তবতায় থেকেও কেউ কেউ নিয়মিত মুনাফা করেছে, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ করে সম্পদ বৃদ্ধি করেছে। পার্থক্য ছিল তাদের আচরণ, মনোভাব এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতায়। শেয়ারবাজারে খারাপ সময় মানেই সুযোগ—এ কথাটি সত্য হলেও, অধিকাংশ বিনিয়োগকারী ভয়, গুজব এবং অস্থিরতার কারণে এই সময়েই ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। তাই পতনের সময় একজন বিনিয়োগকারী কীভাবে আচরণ করবে তা নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী আলোচনা প্রয়োজন মনে করেই আমার আজকের এই লেখা।

২০১০ সালের ধস বাংলাদেশি শেয়ারবাজার ইতিহাসে একটি মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। তখন মূল্যস্ফীতির হার ছিল উচ্চ, বাজার ছিল অতিমূল্যায়িত, এবং অনেক বিনিয়োগকারী কেবল শর্ট-টার্ম লাভের আশায় দৌড়াচ্ছিল। লিভারেজ এবং মার্জিন ট্রেডিংয়ের অতিরিক্ত ব্যবহার বাজারকে আরও দুর্বল করে তোলে। ফলাফল—হাজার হাজার মানুষ সঞ্চয় হারায়, বাজারে বিশ্বাস কমে যায়। কিন্তু একই সময়ে যারা গবেষণা করেছে, প্রতিষ্ঠানগত শেয়ারে দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি রেখেছে, তারা ধীরে ধীরে রিটার্ন পেয়েছে। মার্কেট ক্র্যাশের পরও গ্রামীণফোন, স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস ও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর মতো কোম্পানিগুলো ১৫ বছরে ডিভিডেন্ডসহ উল্লেখযোগ্য রিটার্ন দিয়েছে। এর মানে বাজার ধসে গেলেও শক্তিশালী কোম্পানি থেকে আয় থেমে থাকে না, বরং সেখানেই হয় পুনরায় দাঁড়িয়ে ওঠার ভিত্তি।

বিশ্ববাজারের ইতিহাসও একই কথা বলে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৯২৯ সালের গ্রেট ডিপ্রেশন, ২০০০ সালের ডটকম ক্র্যাশ, ২০০৮ সালের আর্থিক মন্দা—প্রতিটি ধসেই বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্য উড়ে গেছে। কিন্তু ওয়ারেন বাফেটের মতো কিংবদন্তি বিনিয়োগকারীরা এই সময়গুলোকে সুযোগ হিসেবে দেখেছেন। তিনি বলেছিলেন, “Be fearful when others are greedy, and be greedy when others are fearful.” তার দর্শন ছিল, পতনের সময় মূল্যবান শেয়ার কম দামে সংগ্রহ করা। তাই ২০০8 সালের সঙ্কটের সময় তিনি কোকাকোলা, ব্যাংক অব আমেরিকা, গিলেটসহ বহু কোম্পানিতে বড় বিনিয়োগ করেন, যা পরবর্তী দশকে তাকে বিপুল মুনাফা দেয়। একইভাবে পিটার লিঞ্চ, বেঞ্জামিন গ্রাহামের মতো বিনিয়োগগুরুদের অভিজ্ঞতা বলছে—মন্দা বাজারে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করে বিনিয়োগ করাই সাফল্যের মূল চাবিকাঠি।

শেয়ারবাজারে টিকে থাকতে জ্ঞান, গবেষণা, ধৈর্য এবং দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টি—এই চারটি গুণ অপরিহার্য। বাজার সাময়িকভাবে ভেঙে পড়তে পারে, তবে মৌলভিত্তি শক্ত কোম্পানি সময়ের সাথে আবার উঠে দাঁড়ায়। আজ যারা বাজার ছেড়ে গেছে, তারা হয়তো আগামী উত্থান মিস করবে। আর যারা থেকে যাবে, শিখবে, হিসাব করবে—তারা একদিন লাভবান হবে। বিনিয়োগের আসল সৌন্দর্য এখানেই।

বাংলাদেশের অনেক ভালো বিনিয়োগকারীও একই পথ অনুসরণ করেছেন। ২০১০–২০১২ সালের দুর্যোগে যখন অধিকাংশ ছোট বিনিয়োগকারী আতঙ্কে শেয়ার বিক্রি করে বেরিয়ে যাচ্ছিল, তখন অভিজ্ঞ বিনিয়োগকারীরা ধীরে ধীরে শক্ত মৌলভিত্তি সম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার কিনে সঞ্চয় করছিলেন। এক বিনিয়োগকারী বলেন, “আমি তখন দাম কমার ভয় পাইনি, বরং হিসাব করেছি কোম্পানি কী লাভ করছে, ভবিষ্যৎ কেমন। দাম পড়লে আরও কিনেছি। পাঁচ বছর পর দেখলাম পুরো পোর্টফোলিও দ্বিগুণ হয়েছে।” তার এই বক্তব্য আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—শেয়ারবাজার শুধু আজকের লেনদেন নয়, এটি ভবিষ্যতের সম্পদ তৈরির জায়গা।

খারাপ সময়ে বিনিয়োগকারীর মানসিকতা সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখে। পতনের বাজারে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে ক্ষতি অনিবার্য। অধিকাংশ নতুন বিনিয়োগকারী লস দেখে শেয়ার বিক্রি করে দেয়, পরে দাম বাড়লে আবার কিনতে দৌড়ায়। ফলে তারা লো-সেল, হাই-বাই এর বিপরীত চক্রে পড়ে যায়। অথচ শেয়ারবাজারে আসল সাফল্য আসে ধৈর্য থেকে। ধৈর্য না থাকলে বাজারের প্রতিটি ওঠানামা ভয় তৈরি করবে, আর ভয় সিদ্ধান্ত নষ্ট করবে। বিখ্যাত ব্রিটিশ বিনিয়োগকারী জন টেম্পলটন বলেছিলেন, “The four most dangerous words in investing are: ‘This time it’s different’.” অর্থাৎ মানুষ সংকটে ভাবে বাজার আর উঠবে না, সুযোগ হারিয়ে ফেলে, আবার উত্থানে ভাবে বাজার কখনো পড়বে না, অতিমূল্যায়নে কেনে—দুই ক্ষেত্রেই ক্ষতি।

তথ্য বিশ্লেষণও খারাপ সময়ে পথ দেখায়। শুধু গুজব, গ্রুপ-চ্যাট বা সোশ্যাল মিডিয়া দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া আত্মঘাতী। একজন সচেতন বিনিয়োগকারী কোম্পানির আয়, রিজার্ভ, ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, সেক্টরের অবস্থা, ডিভিডেন্ড ইতিহাস যাচাই করে সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন, ব্যাংক, টেলিকম, ফার্মা—এ ধরনের স্থিতিশীল সেক্টর মন্দার সময় তুলনামূলকভাবে কম ঝুঁকির। আবার ই-কমার্স বা আইটি সেক্টর দীর্ঘমেয়াদে দ্রুত বাড়তে পারে, যদিও অস্থিরতা বেশি। তাই ভারসাম্যপূর্ণ পোর্টফোলিও গঠন জরুরি, যেন ক্ষতির চাপ একদিকে কেন্দ্রীভূত না হয়। বিদেশে পেনশন ফান্ড, ETF বিনিয়োগকারীরা এই কারণেই বৈচিত্র্য বজায় রাখে এবং পতনের সময় ধারাবাহিকভাবে SIP (Systematic Investment Plan) এর মাধ্যমে বিনিয়োগ চালিয়ে যায়।

শেয়ারবাজারে খারাপ সময়কে যদি আমরা শীতকাল ধরি, তবে বলা যায়—শীতের পরে বসন্ত আসবেই। কিন্তু সেই বসন্তের ফুল দেখতে হলে শীত পেরিয়ে থাকতে হয়। কেউ শীতের রাতে ঘরে বসে অভিযোগ করে, কেউ আগুন জ্বালিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করে। বিনিয়োগও একই। আজ বাজার দুর্বল, কিন্তু প্রযুক্তি, অবকাঠামো, আমদানি-রপ্তানি, কর্পোরেট গভর্ন্যান্স—সব খাতে বাংলাদেশ এগোচ্ছে। নতুন প্রজন্ম আর্থিক জ্ঞান অর্জন করছে, উদ্যোক্তা বাড়ছে, স্টার্ট-আপ বাড়ছে। সময় প্রয়োজন, আস্থা প্রয়োজন।

শেয়ারবাজারে টিকে থাকতে জ্ঞান, গবেষণা, ধৈর্য এবং দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টি—এই চারটি গুণ অপরিহার্য। বাজার সাময়িকভাবে ভেঙে পড়তে পারে, তবে মৌলভিত্তি শক্ত কোম্পানি সময়ের সাথে আবার উঠে দাঁড়ায়। আজ যারা বাজার ছেড়ে গেছে, তারা হয়তো আগামী উত্থান মিস করবে। আর যারা থেকে যাবে, শিখবে, হিসাব করবে—তারা একদিন লাভবান হবে। বিনিয়োগের আসল সৌন্দর্য এখানেই। খারাপ সময় বিনিয়োগকারীর চরিত্র পরীক্ষা করে, আর ভালো সময় তাকে পুরস্কৃত করে। তাই পতন হলে হতাশা নয়, সচেতনতা ও দৃঢ়তা প্রয়োজন। ইতিহাস বলে, অন্ধকার রাত যত গভীর হোক, ভোর আসবেই। শেয়ারবাজারও তেমনি—ঝড় থামবে, স্থিরতা ফিরবে, তারপর উত্থান আসবে। প্রস্তুত থাকাটাই কেবল আমাদের কাজ।

লেখক : “দ্য আর্ট অব পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট, আমি কি এক কাপ কফিও খাবো না, দ্য সাকসেস ব্লুপ্রিন্ট ইত্যাদি বইয়ের লেখক, করপোরেট ট্রেইনার, ইউটিউবার এবং ফাইনান্স ও বিজনেস স্ট্র্যাটেজিস্ট।

hossain.shaiful@gmail.com

এইচআর/এএসএম