শীত পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামাঞ্চলে খেজুরের রসসহ বিভিন্ন ধরনের রস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। বিশেষ করে প্রত্যন্ত অঞ্চলে শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই খেজুরের স্বাদ আরও মিষ্টি ও মনোমুগ্ধকর হয়ে ওঠে।
তবে মনে রাখতে হবে, কাঁচা খেজুরের রস থেকে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকতে পারে। তাই খেজুরের রস খাওয়ার সময় সতর্ক থাকা জরুরি।
নিপাহ ভাইরাস কীনিপাহ ভাইরাস একটি মারাত্মক ভাইরাসজনিত রোগ, যা মানুষের জন্য প্রাণঘাতী হতে পারে। এটি একটি জুনোটিক ভাইরাস, অর্থাৎ পশু থেকে মানুষে সংক্রমিত হয়। বাংলাদেশে এর প্রধান উৎস হলো খেজুরের রস খাওয়ার সময় থাকা বাদুড়। খেজুরের রস খাওয়ার সময় বাদুড়ের মুখ থেকে নিঃসৃত লালা রসের সঙ্গে মিশে দূষণ সৃষ্টি করে। ফলে ভাইরাস মানুষের শরীরে প্রবেশ করতে পারে।
সংক্রমণ হলে সাধারণত জ্বর ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ দেখা দেয়। মারাত্মক ক্ষেত্রে এটি মস্তিষ্কের প্রদাহ বা এনকেফালাইটিস পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে, যা প্রায় শতভাগ মৃত্যুর কারণ হয়ে থাকে।
কীভাবে ছড়ায়নিপাহ ভাইরাস প্রধানত বাদুড় ও শূকরের দেহ থেকে মানবদেহে ছড়ায়। এছাড়া সংক্রমিত ব্যক্তির শরীর থেকে সুস্থ ব্যক্তির মধ্যে এটি রক্ত, প্রস্রাব এবং সর্দির মাধ্যমেও সংক্রমিত হতে পারে। ভাইরাসটি শরীরে সংক্রমিত হলেও কখনো কখনো ৪ থেকে ১৪ দিন পর্যন্ত, কিছু ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ৪৫ দিন পর্যন্ত সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে, যা সংক্রমণ শনাক্ত করতে আরও কঠিন করে তোলে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর সাধারণত নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যায়।
লক্ষণগুলো কীনিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হলে প্রথম দিকে জ্বর, মাথাব্যথা, খিঁচুনি, পেশিতে ব্যথা, গলাব্যথা এবং বমির মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে। সংক্রমণ মস্তিষ্কে পৌঁছালে সাধারণত ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে রোগী অচেতন হয়ে পড়েন। কিছু ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টও দেখা দিতে পারে, যা রোগটিকে আরও বিপজ্জনক অবস্থায় ফেলতে পারে।
সচেতন থাকতে যা করবেননিপাহ রোগ থেকে রক্ষা পেতে কিছু সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। প্রথমত, খেজুরের কাঁচা রস খাওয়া উচিত নয়, হিমায়িত খেজুরের রসও এড়িয়ে চলা ভালো। এছাড়া কোনো ধরনের আংশিক খাওয়া ফলও নিরাপদ নয়; ফলমূল সবসময় পরিষ্কার পানি দিয়ে ভালোভাবে ধুয়ে খাওয়া উচিত।
যদি কোনো ব্যক্তিতে নিপাহ রোগের লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে তাকে অতিদ্রুত কাছাকাছি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। আক্রান্ত রোগীর সংস্পর্শে আসার পর অবশ্যই সাবান ও পানি দিয়ে দুই হাত ভালোভাবে ধুয়ে নেওয়া উচিত।
রোগ নির্ণয়ের উপায়এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা করানো প্রয়োজন। এর জন্য সাধারণত গলার সোয়াব, রক্ত, সিএসএফ এবং প্রস্রাবের আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করা হয়। এছাড়া রক্তের ওমে আর আইজিএম পরীক্ষা এবং মৃত ব্যক্তির নির্দিষ্ট টিস্যুর অটোপ্সির মাধ্যমে ইমিউনোহিস্টোকেমিস্ট্রি পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাস নিশ্চিতভাবে শনাক্ত করা যেতে পারে।
চিকিৎসানিপাহ ভাইরাসের এখনোকোনো টিকা বা কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত হয়নি। তাই এই রোগের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা হলো সচেতনতা। সমাজে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি, যাতে সবাই নিরাপদ পদ্ধতিতে খেজুরের রস খায় এবং সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে পারে। মৃত্যুঝুঁকি রোধে সঠিক পদক্ষেপ নিতে পারে।
সর্তকতা হবেন যেভাবেনিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সুস্থ ব্যক্তিদেরও সংক্রমিত করতে পারেন। খেজুর সংগ্রহের সময় গাছিরা কতটুকু নিরাপত্তা বজায় রেখেছে বা নিয়েছে, তা বোঝার কোনো সহজ উপায় নেই। তাই শুধুমাত্র দূষিত খেজুরের রস নেওয়ার নয়, ইতোমধ্যে নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত গাছির মাধ্যমেও সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে খেজুরের রস নেওয়ার পর ভালো করে গোসল করা বা যতটা সম্ভব শারীরিক সংস্পর্শ এড়িয়ে খেজুর রস কিনে নেওয়া উচিত।
খেজুরের রস নিঃসন্দেহে একটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু পানীয়। তবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন, কারণ দূষিত খেজুরের রস মৃত্যুর কারণও হতে পারে।
সূত্র: বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিক
আরও পড়ুন: প্রেশার বেড়ে গেলে প্রাথমিকভাবে যা জানা দরকার ওজন কমাতে সাহায্য করে লাউ
এসএকেওয়াই/