অনিয়ন্ত্রিত ইউরিয়ায় হুমকিতে কৃষি ও পরিবেশ

ইউরিয়া একটি সাদা ও দানাদার রাসায়নিক পদার্থ; যা সাধারণত কৃষিক্ষেত্রে নাইট্রোজেন সরবরাহের জন্য ব্যবহার করা হয়। এতে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় নাইট্রোজেন সার। ইউরিয়া সারের উপাদান হলো—নাইট্রোজেন থাকে ৪৬%। এটি একটি উচ্চ নাইট্রোজেনযুক্ত সার, অর্থাৎ ১০০ কেজি ইউরিয়ায় প্রায় ৪৬ কেজি নাইট্রোজেন থাকে। ইউরিয়া সার একটি জনপ্রিয় নাইট্রোজেন ভিত্তিক রাসায়নিক সার, যা ফসলের দ্রুত বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। এটি কৃষিক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হলেও অতিরিক্ত বা অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
নিজস্ব উৎপাদন ও আমদানি নির্ভরতা
বাংলাদেশে প্রতিটি বছরে ২.৬-২.৭ মেট্রিক টন ইউরিয়া ব্যবহার হয়, যার মাত্র প্রায় ০.৫ মেট্রিক টনই উৎপাদিত হয় দেশে। বাকি প্রায় ৮০% (১.৬৬ মেট্রিক টন) আমদানির ওপর নির্ভর করে। বর্তমান দর অনুযায়ী এর অর্থনৈতিক মূল্য প্রায় ৪৪-৪৫ হাজার কোটি টাকা। নিচে ইউরিয়া সারের পরিবেশগত প্রভাব বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হলো।
মাটির গুণাগুণ নষ্ট হওয়া
ইউরিয়া সারে উচ্চমাত্রায় নাইট্রোজেন থাকে, যা মাটিতে জমে গিয়ে মাটির পিএইচ পরিবর্তন করে। অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহারে মাটির জৈব উপাদান কমে যায়, মাইক্রোবিয়াল (অণুজীব) জীববৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দীর্ঘমেয়াদে মাটি শক্ত হয়ে যায় ও উর্বরতা কমে যায়।
ফসলের ক্ষতি
অধিক পরিমাণ ইউরিয়া ব্যবহার ক্ষতিকর। পোকামাকড় আক্রমণ বেশি করে, রোগ বালাই বেশি হয়, সর্বশেষ ফলন কমে যায়।
পানিদূষণ
অতিরিক্ত ইউরিয়া বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে নদী-নালা বা ভূগর্ভস্থ পানিতে মিশে যায়। এতে পানিতে নাইট্রেটের মাত্রা বেড়ে যায়, যা পানির প্রাণীদের জন্য ক্ষতিকর এবং মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি ‘ব্লু বেবি সিন্ড্রোম’ বা ‘মেথেমোগ্লোবিনেমিয়া’ সৃষ্টি করতে পারে।
বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন
ইউরিয়া সারে থাকা নাইট্রোজেন মাটির সঙ্গে বিক্রিয়া করে নাইট্রাস অক্সাইড (এন২ও) গ্যাস তৈরি করে, যা একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস। নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের চেয়ে প্রায় ৩০০ গুণ বেশি তাপ ধারণ করতে পারে। এ গ্যাস বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও জলবায়ু পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
জলজ প্রাণীর ক্ষতি
পানিতে নাইট্রোজেন বেশি থাকলে শ্যাওলা বা অ্যালগি দ্রুত বাড়ে, যা ইউট্রোফিকেশন তৈরি করে। এ অবস্থায় জলাশয়ে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়, ফলে মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণী মারা যেতে পারে। এতে মৎস্যসম্পদ হ্রাস পায় এবং জলের বাস্তুতন্ত্রে বিপর্যয় ঘটে।
জৈব কৃষির জন্য বাধা
ইউরিয়া সারের ওপর নির্ভরতা কৃষকদের জৈব কৃষি থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। এতে জমির প্রাকৃতিক সার তৈরির ক্ষমতা কমে যায় এবং সার নির্ভরতা বাড়ে, যা টেকসই কৃষির পথে বাধা সৃষ্টি করে।
সমাধান ও করণীয়
ইউরিয়া ব্যবহারে সুষম সার ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করা উচিত। জৈব সার, কম্পোস্ট ও ভার্মি কম্পোস্ট ব্যবহার বাড়াতে হবে। ইউরিয়া প্রয়োগের সময় মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজন বুঝে প্রয়োগ করা উচিত। কৃষকদের পরিবেশবান্ধব কৃষিপদ্ধতি বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। অতিরিক্ত ইউরিয়া ব্যবহার করলে মাটির গুণমান নষ্ট হতে পারে। গাছের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বা ফলন কমে যেতে পারে। পানির সংস্পর্শে এলে দ্রুত নাইট্রোজেন হারাতে পারে।
উপকারিতা
পরিমিত ইউরিয়া সার, গাছের সবুজ পাতা গঠন ও বৃদ্ধিতে সহায়ক। ক্লোরোফিল তৈরিতে সাহায্য করে। যার মাধ্যমে গাছ খাদ্য তৈরি করে। শস্যের ফলন ও গুণমান বৃদ্ধি করে। দ্রুত কাজ করে এবং সহজে মাটিতে মিশে যায়। প্রয়োজন অনুযায়ী সঠিক মাত্রায় ও সঠিক সময় ইউরিয়া প্রয়োগ করলেই ফসলের জন্য এটি খুবই উপকারী।
ইউরিয়া সার ফসলের উৎপাদনে তাৎক্ষণিক সুবিধা দিলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি মাটি, পানি, বায়ু ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। টেকসই কৃষি ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে ইউরিয়া সারের ব্যবহার সঠিক নিয়ন্ত্রণ ও বিকল্প পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি গ্রহণ এখন সময়ের দাবি।
এসইউ/জেআইএম