বকুল ফুলের নীরব সৌন্দর্য

তানজিদ শুভ্র
সব ঝরা মানেই ক্ষয় নয়; কখনো কখনো তা হয়ে ওঠে সৌন্দর্যের প্রতীক। অনেক ফুল সকালবেলা ফোটে, সন্ধ্যায় ঝরে। কিন্তু বকুল যেন অন্যরকম। রাতের নিঃশব্দতায় ফোটে আর শিশিরভেজা সকালে ঝরে পড়ে পথিকের চলার পথে। এরপর দিনভর টুপটাপ ঝরতে থাকে। কোনো জাঁকজমক নেই, তবু সে উপস্থিতির ছাপ রেখে যায়। যেন ধীর, শান্ত, নরম মেজাজের কেউ; যাকে ভুলে যাওয়ার চেয়ে মনে রাখা সহজ।
বকুল ফুল আমাদের জীবনের খুব চেনা একটি নাম। শৈশবের সকাল, দুপুর কিংবা বিকেল সব সময়েই কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে ছিল ছোট্ট সুন্দর ফুলটি। তারার মতো ছোট্ট সাদা ফুল, পাঁপড়িতে মিশে থাকা হালকা হলুদ আভা। ঝরে পড়া ফুলগুলো দেখে মনে হতো, যেন প্রকৃতি নিজের হাতে বিছিয়ে দিয়েছে একটি ফুলেল চাদর। কারো উঠোনে কিংবা স্কুলের আঙিনায় তারার মতো ফুটে থাকতো বকুল।
শিশুরা মালা গাঁথতো বকুল ফুল দিয়ে। কেউ ডায়েরির পাতায় রেখে দিতো শুকিয়ে যাওয়া একটি ফুল। যার মধ্যে হয়তো লুকিয়ে থাকতো এক টুকরো সময়, কিছু না-বলা কথা আর অজস্র স্মৃতি। বকুলের মালা শুকিয়ে গেলেও তার ঘ্রাণ যেন স্মৃতিতে থেকে যেত দীর্ঘদিন।
শুধু রবীন্দ্রনাথ, নজরুল নয়; বিভিন্ন কবি, সাহিত্যিক এমনকি গীতিকারের লেখায়ও বকুল ফুল উঠে এসেছে। প্রেম, স্মৃতি কিংবা অপেক্ষার প্রতীক হয়ে সে জায়গা করে নিয়েছে সাহিত্যের পাতায়। কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন, ‘তুমি যে গিয়াছ বকুল বিছানো পথে।’ এই ফুল যেন এক চিরচেনা বিষাদেরও নাম। কবি বিনয় মজুমদার লিখেছেন, ‘বকুলের মতো শেষে/ শুকিয়ে খয়েরি হয়ে, দীর্ঘস্থায়ী হয়ে মালিকায়/ কোনদিন আসবে কি?’
বকুল গাছের বৈজ্ঞানিক নাম Mimusops elengi। গাছটি মাঝারি আকারের, ঘন পাতায় আচ্ছাদিত। শীতকাল ছাড়া সারাবছরই ফুল ফোটে, ফুল ঝরে। সাধারণত বর্ষাকালে বকুল ফুল বেশি ফোটে। তবে ফুল না থাকলেও সে ক্লান্ত পথিককে ছায়া দেয় অকাতরে। শুধু ফুলই নয়, এ গাছের পাতা, বাকল ও ফলও বহু উপকারে আসে। আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় বকুল ব্যবহৃত হয় দাঁতের যত্ন, মুখের দুর্গন্ধ ও হজমের সমস্যা দূর করতে।
আজকের কংক্রিটের শহরে বকুল গাছের দেখা পাওয়া দুষ্কর। পুরোনো কোনো ক্যাম্পাস, পরিত্যক্ত কোনো সরকারি ভবনের পাশে হয়তো এখনো দাঁড়িয়ে আছে এক-দুটি বকুল গাছ। তবে তারা যেন সময়ের ফ্রেমে আটকে থাকা এক টুকরো মায়া হয়ে গেছে।
এই ফুল শুধু স্মৃতির গাছ হয়ে থাকুক না কেন, তবু বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা আমাদের থাকা উচিত। বিভিন্ন বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিতে বকুল গাছ হতে পারে অন্যতম পছন্দ। ব্যক্তিগত উদ্যোগেও বকুল গাছ রোপণ করা যেতে পারে। যাতে নতুন প্রজন্ম জানে এ ফুলের গল্প।
বকুল আমাদের হৃদয়ে, স্মৃতিতে, গল্পে চিরজীবী হয়ে থাকে। বকুল ফুলের মতো হোক আমাদের জীবন ও ভালোবাসা; নীরব, নিরহংকার কিন্তু গভীর। পৃথিবী যদি আরেকটু বকুলের মতো হতো, হয়তো ক্লান্তি কমে যেত, সময়ের গায়ে নামতো নরম ছায়া।
লেখক: শিক্ষার্থী, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগ, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর।
এসইউ/জিকেএস