জাতীয়

সবুজা খালা শুধু জানতে চাচ্ছেন ‘স্কুলের বাচ্চারা কেমন আছে?’

প্রতিদিনকার মতো ক্লাস শেষ। একটু পরেই বের হয়ে যাবে সব শিক্ষার্থী। সেই অপেক্ষায় হায়দার আলী ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বহুদিনের পরিচর্যাকারী (আয়া) সবুজা বেগম।

হঠাৎ এক বিকট শব্দ! কিছু বুঝে ওঠার আগেই নিচে তাকিয়ে আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে পান তিনি। দ্রুত নিচে নামতে যান, কিন্তু তখনই তার চোখে পড়ে কয়েকজন ছোট ছোট শিশু শিক্ষার্থী।

এক মুহূর্তের জন্য থমকে যান। সিদ্ধান্ত নেন—বাঁচতে হলে তাদের নিয়েই বাঁচবেন। সামনেই থাকা তিন-চারজন শিশুকে জড়িয়ে ধরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করেন সবার প্রিয় সবুজা খালা। কিন্তু এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান তিনি। এরপর আর কিছু বলতে পারেন না। পোড়া ক্ষত নিয়ে এখনো চিকিৎসাধীন বার্ন ইউনিটে। কথা বলছেন কম। বারবার শুধু জানতে চাচ্ছেন, স্কুলের বাচ্চারা কেমন আছে?

প্রতিষ্ঠানটির শুরু থেকে গত ১৬ বছর ধরে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে প্লে-গ্রুপের শিশুদের দেখভালের দায়িত্ব পালন করছেন সবুজা। তাই নিজের জীবনের পরোয়া না করে আগুনের ভয়াল থাবা থেকে শিশুদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালান। তবে আগুনের ভয়াবহতা এতটাই ছিল যে শেষ পর্যন্ত তিনি নিজেই মারাত্মক দগ্ধ হন।

তার সঙ্গে বেরিয়ে আসা শিশুদের কেউ কেউ পেছন দিক থেকে আগুনে আক্রান্ত হয় এবং তারা এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। এক সময় সবুজা খালা পড়ে যান একজন উদ্ধারকারীর গায়ের ওপর। এর পরের ঘটনা তিনি আর মনে করতে পারেননি।

সবুজা বেগম বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। তিনদিন আইসিইউতে ছিলেন। জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফেরা সবুজা বেগমকে দুদিন আগে ওয়ার্ডে শিফট করা হয়েছে।

হাসপাতাল থেকে মেয়ে রুমানা খানম এসব কথা জানান। রুমানা বলেন, ‘মা যখন পড়ে জ্ঞান হারায় তখনও একটি বাচ্চা তার হাতে ছিল। এটুকু বলতে পেরেছেন। মা জ্ঞান হারানোর পরে হয়তো মায়ের সঙ্গে তাকেও কেউ উদ্ধার করেছিল।’

আরও পড়ুন

মায়ের দেওয়া শেষ খাবারটিও শেষ করতে পারেনি নুসরাত ট্রমা কাটেনি শিক্ষার্থীদের, চলতি সপ্তাহেও বন্ধ থাকবে মাইলস্টোন দোলনায় দোল খেতে খেতে হারিয়ে গেলো আয়মান চিরনিদ্রায় শায়িত ছোট্ট রাইসা মনি, কাঁদছে পুরো গ্রাম

সবুজা বেগমের শরীরের প্রায় ৮ শতাংশ পুড়েছে। মুখমণ্ডল, পা, হাতসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ দগ্ধ হয়েছে।

‘তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার মুখ—চোখ-মুখের চামড়া উঠে গেছে। কথা খুব একটা বলতে পারছেন না, তবে কয়েকবার জিজ্ঞাস করেছেন, ‘স্কুলের বাচ্চারা কেমন আছে?’ বলেন রুমানা খানম।

জানা যায়, দুর্ঘটনার মাত্র ২০-২২ দিন আগে স্বামী হারান সবুজা বেগম। প্রায় আট বছর আগে একমাত্র মেয়ে রুমানাও স্বামী হারান। কিডনি রোগে আক্রান্ত সবুজা বেগমের স্বামীর একটি পা আগেই কেটে ফেলতে হয়েছিল। সংসারের হাল ধরার মতো কেউ ছিল না বলেই সবুজা বেগম ছিলেন পুরো পরিবারের ভরসা। দুই ছেলেও তেমন কিছু করেন না। সেই পরিবার আজ দাঁড়িয়ে আছে চরম অনিশ্চয়তার মুখে।

রুমানা বলেন, ‘মা সেদিনের কথা মনে করলে কেঁপে উঠছেন। ভীষণ ভয় পান। তাই আমরা তেমন কিছু জিজ্ঞাস করি না।’

‘আমার মায়ের কাছে স্কুলটাই তার জগৎ। এই বাচ্চাদের দেখাশোনাই তার দায়িত্ব। মা জীবন দিয়ে সেই দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করেছেন।’

রুমানা আরও বলেন, ‘ঘটনার আধাঘণ্টার মধ্যে আমার ভাই আম্মাকে উদ্ধার করে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখান থেকে তাকে বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে নেওয়া হয়। এরপর বার্ন ইউনিটে আনা হয়।’

সবুজা বেগম যে ওয়ার্ডে ভর্তি আছেন, সেখানে মাইলস্টোনের আরও অনেক শিক্ষার্থী তার মতো চিকিৎসাধীন। তিনি এখন বুঝতে পারছেন অনেক শিক্ষার্থী হতাহত হয়েছে।

পোড়া শরীর নিয়ে বাচ্চাদের আহাজারি সবুজা বেগমকে কাঁদায় বলেও জানান তার মেয়ে।

রুমানা বলেন, ‘আমাদের ধারণা মা বিমান বিধ্বস্তের পরপরই বের হতে পেরেছেন। সিঁড়ি দিয়ে নেমেও বেঁচে আছেন—এটা আসলেই অলৌকিক। কারণ, আমরা শুনেছি সিঁড়ির কাছেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়েছিল। হয়তো মা কয়েকজন বাচ্চাকে বিমানের জ্বালানি ট্যাংক বিস্ফোরণের আগেই বের করে ফেলতে পেরেছিলেন।’

সবুজা বেগমের ভাগিনা হৃদয় মির্জা জাগো নিউজকে বলেন, ‘খালা বেঁচে আছেন—এটাই আমাদের জন্য অনেক। তবে তিনি খুব ভয় পাচ্ছেন। তিনি সুস্থ হয়ে ফিরলেও কবে মনের এই ভয় দূর হবে জানি না।’

শনিবার (২৬ জুলাই) ঢাকার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন আরেক আয়া মাসুমা মারা গেছেন। ৩৮ বছর বয়সী মাসুমা শ্বাসনালিসহ শরীরের ৯০ শতাংশ দগ্ধ হয়ে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।

এ নিয়ে মাইলস্টোনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় সবমিলিয়ে মৃত্যু হলো ৩৫ জনের।

গত সোমবার (২১ জুলাই) দুপুরে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয়। দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় এ সামরিক বিমান দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত যে ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে তাদের বেশির ভাগই শিশু।

জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে এখন চিকিৎসাধীন ৩৬ জন, যাদের মধ্যে চারজনের অবস্থা এখনো ‘আশঙ্কাজনক’ বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

জেপিআই/এএসএ/এমএফএ/এমএস