খেলাধুলা

ক্রিকেটারদের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, কাউন্সেলিং করাতে চায় বিসিবি

সোমবার সকালের পর থেকে হঠাৎ গরম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ক্রিকেট অনুরাগীদের যারা ফেসবুকে নিয়মিত থাকেন, পোস্ট দেন, পড়েন, কমেন্ট করেন- তাদের মধ্যে হঠাৎ কানাকানি, গুঞ্জন। জাতীয় দলের এক নম্বর পেসার তাসকিন আহমেদ নাকি তার এক বন্ধুকে মারধর করেছেন এবং সেই বন্ধু তার বিপক্ষে মিরপুর থানায় অভিযোগও করেছেন।

খুব স্বাভাবিকভাবেই ফেসবুকে এমন খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তাসকিন ভক্ত ও সাধারণ ক্রিকেট অনুরাগী সবার মধ্যেই একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। এক পক্ষ বিশ্বাস করে বলতে শুরু করেন, সে কি! তাসকিনের মত ক্রিকেটারও তাহলে এমন অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত? তাহলে আর নাসির, রুবেল, শাহাদাত ও সাব্বির রহমানদের সাথে তার পার্থক্য থাকলো কোথায়?

ওপরে যে চার জাতীয় ক্রিকেটারের কথা বলা হলো তারাও তো বিভিন্ন সময় অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে বিতর্কিত হয়েছিলেন। তাসকিনও কি তাহলে সেই অন্যায় পথে হাঁটলেন?

অনেকের মনেই সে প্রশ্ন উঁকিঝুকি দিচ্ছিল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামার আগে তাসকিনকে নিয়ে নেতিবাচক পোস্ট আর তার সমালোচনায় মুখর ছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। আবার কারো কারো একটাই কৌতুহলি প্রশ্ন, ‘আচ্ছা তাসকিন কি সত্যিই এমন ঘটনা ঘটিয়েছেন? তিনি কি আদৌ সেই ঘটনার সাথে জড়িত?’ দুপুর গড়িয়ে বিকেল নামার আগেই বিসিবি কর্মকর্তাদের কাছে তাসকিন সে অভিযোগ অস্বীকার করে উত্তপ্ত পরিস্থিতি অনেকটাই শীতল করে দেন। দেশের প্রধান স্ট্রাইকবোলার তাসকিন আহমেদ বিসিবিকে জানিয়ে দেন, ‘আমি এ ঘটনার সঙ্গে সরাসরি জড়িত নই। আমার বন্ধুদের মধ্যে দুই গ্রুপে মারামারি হয়েছে। এক পক্ষ আমাকে থানাতে ফোন করতে অনুরোধ করে। আমি মিরপুর থানার ওসিকে ফোন করি। তাতে অপর পক্ষ আমার ওপর ক্ষুদ্ধ হয়ে উল্টো ঘটনায় আমাকে জড়িয়ে থানায় (মিরপুর থানা) জিডি করেছে।’ এদিকে আজ সোমবার সন্ধ্যার পর নিজের ফেসবুক আইডিতে এক পোস্ট দিয়ে দেশের এক নম্বর পেসার ও বিসিবির এ প্লাস ক্যাটাগরির একমাত্র ক্রিকেটার তাসকিন আহমেদ সবার উদ্দেশ্যে জানিয়েছেন, ব্যাপারটা মোটেই সত্য নয়। মিথ্যা, গুজব।

তামিম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, ‘সবাইকে অনুরোধ, গুজবে বিভ্রান্ত হবেন না। আমি আমার ছোটবেলার বন্ধুর গায়ে হাত তুলেছি এমন একটা ঘটনায় অনেক কিছুই ঘটে যাচ্ছে। আমার মনে হয়, এমন গুজবে কান দিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না এবং অন্যকেও বিভ্রান্ত করবেন না। এটা আমার, আমার পরিবার ও আমার বন্ধুর জন্য সম্মানজনক নয়। যা ঘটেছে সে জন্য, বন্ধু ও আমার মধ্যে কথা হয়েছে। এটা যে পর্যায়ে গেছে কোনোভাবে এমনটা হওয়ার কথা নয়। শুধু একটা কথাই বলতে চাই, বিষয়টা অন্য, বাস্তবতা ভিন্ন। (মিথ্যা বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত) আশাকরি, সত্য-এর সাথেই থাকবেন, সত্য কখনো মিথ্যা হয় না।’ তাসকিন তার অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন এবং ধরেই নেয়া যায় বেশির ভাগ ক্রিকেট ভক্ত ও তাসকিন সাপোর্টার তা সত্য বলেই বিশ্বাস করেছেন। তার ভক্ত ও ক্রিকেট অনুরাগীরাও তা বিশ্বাস করে মেনেও নিয়েছেন যে, তার বন্ধুদের কেউ আক্রোশ মেটানোর জন্য তাসকিনকে ফাঁসাতে চেয়ে থানায় অভিযোগ করে থাকবেন। ধারনা করা হচ্ছে, ঘটনাটি আর ডালপালা গজাবে না।

কিন্তু তারপরও কথা থেকে যায়। কিছু প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। এটাও তো সত্য যে, বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের বিপক্ষে কোনো অভিযোগ নতুন নয়। অতীতে প্রায় হাফ ডজনের বেশি ক্রিকেটার কোনো না কোনো অনৈতিক ঘটনা, অসদাচরণ, শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন।

তাতে করে তারাই যে শুধু বিতর্কিত হয়েছেন, তাদের ইমেজ নষ্ট হয়েছে, তারাই সমালোচিত ও নিন্দিত হয়েছেন- এমন নয়। দেশের ক্রিকেটের ভাবমূর্তিও ক্ষুন্ন হয়েছে। ক্রিকেটারদের শৃঙ্খলাভঙ্গের পাশাপাশি মাঠের বাইরের কোনো অসামাজিক ঘটনা, অনৈতিক কর্মকাণ্ডর দায় যে প্রকারান্তরে বিসিবির ওপরও বর্তায়!

খুব স্বাভাবিকভাবেই ওই নিন্দিত ও সমালোচিত ঘটনায় জড়িয়ে পড়া সাব্বির রহমান রুম্মন, রুবেল হোসেন, শাহাদাত হোসেন রাজীব, নাসির হোসেনদের অভিভাবক সংগঠন হিসেবে বিসিবিও হয়েছে বিব্রত। এখন প্রশ্ন হলো, বারবার এমন ঘটনা ঘটার পরও বিসিবি কি সত্যিই বিব্রত বোধ করেছে?

ক্রিকেটারদের কড়া নিয়ম ও অনুশাসনের মধ্যে আনার কি কোন কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে বিসিবি? উত্তর আসবে, ‘না, নেয়নি।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আসলে বিসিবির সাথে ক্রিকেটারদের চুক্তির মধ্যে সত্যিকার অর্থে কোন ‘কোড অব কন্ডাক্ট’ নেই।

ক্রিকেটাররা মাঠে খেলবেন। জাতীয় দলের সব নিয়ম-কানুন মেনে চলবেন। সেটাই শেষ কথা নয়। তাদের যে সামাজিক দায়বদ্ধতাও আছে। তারা দেশের ক্রিকেটের একজন ব্র্যান্ড অ্যাম্বসেডর। সবাই জাতীয় পতাকা বহন করেন। তাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবন যাপন, আচার আচরণ, কথা-বার্তা ও কর্মকাণ্ড সবাই অনুসরণ করে। তারা সেলিব্রেটি। তাদের জীবন হওয়া উচিৎ শৃঙ্খলিত। তারা ইচ্ছে করলেই কোনো অসামাজিক কার্যক্রমে জড়িত হতে পারবেন না। ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে কোনোরকম বিতর্কের জন্ম নেয়া ঘটনা ঘটানো থেকে সম্পূর্ন নিরাপদ দূরত্বে থাকাটাও তাদের খেলোয়াড়ী জীবনের অন্যতম পূর্বশর্ত বলে পরিগণিত হবে।

বিসিবির সাথে ক্রিকেটারদের যে চুক্তি হয়, সে চুক্তিপত্রে ওপরে উল্লেখিত বিষয়ের কিছুই লেখা নেই। তাই ক্রিকেটারদের মধ্যে সামাজিক দায়বদ্ধতা কম। তারা কি করবেন, কি করতে পারবেন, আর কি করা যাবে না- এসব বিষয়ে অনেক ক্রিকেটারের ধারণাও নেই।

অনেক দেরিতে হলেও বিসিবির মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান ইফতিখার রহমান মিঠু আজ সোমবার রাতে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, ‘আসলে আমাদের কোড অব কনডাক্টে ওসব কিছু লিখা নেই। তবে আমরা ক্রিকেটারদের নিয়মের মধ্যে আনার আগে সচেতন করে তোলার কথা ভাবছি।’

সেটা কি রকম? মিঠুর জবাব, ‘আমাদের বিসিবি পরিচালক ও জাতীয় দল পরিচালনার দায়িত্বে থাকা ক্রিকেট অপারেশন্স চেয়ারম্যান নাজমুল আবেদিন ফাহিমের সাথে কথা হয়েছে। আমরা খুব শিগগিরই ক্রিকেটারদের নিয়ে কাউন্সিলিং করানোর ব্যবস্থা করবো। তাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন করে তোলার সম্ভাব্য সব কিছুই করার চেষ্টা থাকবে।’ কাউন্সিলিং করলে হয়ত সচেতনতা বাড়বে। কিন্তু ক্রিকেটারদের অসামাজিক ও অনৈতিক কর্মকান্ড থেকে বিরত রাখতে হলে চাই কঠোর আইন। তার যথাযথ প্রয়োগ। বিসিবি সকল জাতীয় ক্রিকেটারের সাথে চুক্তির সময় তাদের কোড অব কনডাক্ট-এর আওতায় আনতে হবে। চুক্তিপত্রে পরিষ্কার লিখা থাকবে, জাতীয় দলের ক্রিকেটার হিসেবে আপনার কিছু সামাজিক দায়বদ্ধতা আছে। আপনি ইচ্ছেমত যা কিছু করতে পারবেন না। জাতীয় দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়, দেশের ক্রিকেট ও ইমেজ ক্ষুণ্ন হয় এমন কোন কাজ করা চলবে না। তাহলেই ক্রিকেটাররা সতর্ক ও সাবধানী হবেন। তাদের সাজিক দায়বদ্ধতা ও সচেতনতাও বাড়বে। শুধু কাউন্সিলিংয়ে কাজের কাজ কিছু হবে, মনে হয় না।’

বিসিবির সিনিয়র পরিচালক মাহবুব আনাম জাগোনিউজকে তাসকিনের এই ঘটনার বিষয়ে বলেন, ‘তাসকিন ইস্যুতে আমরা ভালো করেই খবর নিয়েছি। মূলতঃ এ ইস্যুতে ক্রিকেট বোর্ডের কিছু করার নেই, বলারও নেই। আমরা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছি যে, তাসকিন খারাপ কিছু করেনি। সে নিরপরাধ। বন্ধুদের আক্রোশের শিকার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিসিবি বিব্রত কি না, তা বলতে পারছি না। তবে এ ধরনের অভিযোগ যদি বারবার বিসিবিতে আসে, তাহলে সেটা অবশ্যই বিব্রতকর হয়।’

এআরবি/আইএইচএস