১৯৯৬ সালে অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ছিলেন রুপা খাতুন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ একদিন বিয়ে হয়ে যায় তার। বইখাতা আঁকড়ে সফলতার স্বপ্ন দেখা কিশোরী হাঁড়ি-কড়াই হাতে মন দেন ঘর-সংসারে। কিন্তু বইখাতা ছাড়লেও স্বপ্ন ছাড়েননি রুপা খাতুন। সেই হাঁড়ি-কড়াইকে সম্বল করেই স্বপ্ন পূরণের পথে এগিয়ে চলেছেন।
যশোরের অজপাড়া গাঁয়ের সেই রুপা খাতুন এখন পরিচিত ‘কাঁঠাল চিপসের কারিগর’ হিসেবে। শুধু এই কাঁঠালের চিপসেই মাসে ২০ হাজার টাকা উপার্জন তার। এক সময় যারা নাক সিটকে সমালোচনা করতেন, এখন তারাই রুপা খাতুনের কাজ দেখতে আসেন, আসেন পরামর্শ নিতে।
যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামের ইখতার আলীর স্ত্রী রুপা খাতুন (৪২)। অজপাড়া গাঁয়ের বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন ‘রেইনবো এগ্রো ফুড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। অনেকদিন ধরেই তিনি বাড়িতে নানা রকমের আচার, জ্যাম-জেলি, কুমড়োর বড়ি, গুড়-পাটালিসহ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করে আসছেন। এবছরই তিনি শুরু করেছেন, কাঁঠালের চিপস তৈরি।
গত তিনমাস ধরে তিনি এই চিপস তৈরি করে বাজারজাত করছেন। কাঁঠাল প্রসেসিং করে ফ্রিজে সংরক্ষণের মাধ্যমে আরও তিনমাস এই চিপস বাজারে ছাড়া সম্ভব বলে তিনি জানান।
কাঁঠালের চিপসে বাজিমাত করা রুপা খাতুনের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে তার নিষ্ঠা ও একাগ্রতা। গল্পে গল্পে শুনিয়েছেন তার হাল না ছাড়া সংগ্রামের কথা।
রুপা খাতুন বলেন, তার বাবার বাড়ি মাগুরার শালিখা উপজেলার পুশখালি গ্রামে। বাবা শামসুর রহমান বিশ্বাস কাঠের ব্যবসা করতেন। ১৯৯৬ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় হঠাৎ করেই বাবা-মা তাকে বিয়ে দিয়ে দেন। সাত ভাই বোনের সংসারে কিছু টানাপড়েন আর ভালো ছেলে পাওয়ার সুবাদে বিয়ে হয়ে যায় তার। চলে আসেন স্বামীর বাড়ি যশোর সদর উপজেলার লেবুতলা ইউনিয়নের কোদালিয়া গ্রামে। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বইখাতার ভাঁজে ফেলে রেখে সংসারের হাল ধরতে হয় তাকে।
এরইমধ্যে একে একে তিনটি সন্তানের মা হয়ে যান। ফলে সংসারের চক্রে ঘুরতে থাকা রুপা খাতুন অন্যদিকে ফিরে তাকানোরও ফুসরত পাননি। তবে স্বামী কাপড়ের ব্যবসায়ী ও টেইলর মাস্টার হওয়ায় এক সময় তিনিও সেলাইয়ের কাজ শেখেন। যদিও সেলাইয়ের কাজ তাকে খুব বেশি টানতে পারেনি। এরপর নিজের আগ্রহের জায়গাটি খুঁজে পান রুপা খাতুন। ২০১৯ সালের দিকে তিনি খাদ্যপণ্য উৎপাদনের দিকে ঝোঁকেন।
রুপা খাতুন বলেন, আমি লক্ষ্য করি বিভিন্ন মৌসুমী ফল সিজনের কয়েক মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় যেমন এর দাম পাওয়া যায় না, তেমনি বড় একটি অংশ অপচয়ও হয়। এই ভাবনা থেকে বিভিন্ন ধরনের আচার তৈরি শুরু করি। এই সময় উন্নয়ন সংস্থা ‘সুশীলন’ থেকে প্রশিক্ষণ নিই। প্রশিক্ষণের পর আম-তেঁতুলের আচার, সস, জ্যাম-জেলি ইত্যাদি তৈরি শুরু করি। পরবর্তীতে সুশীলন-বন্ধন’র মাধ্যমে ঢাকাতেও প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এরপর পুরোদমে খাদ্যপণ্য উৎপাদনে লেগে যাই।
রুপা খাতুন বলেন, এরইমধ্যে তরুণ ও নারী উদ্যোক্তাদের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পার্টনার প্রোগ্রামের আওতায় অন দ্যা জব প্রশিক্ষণের খবর পাই। ‘প্রিজম এগ্রো এন্ড ফুড’ থেকে এই প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করি কাঁঠালের চিপস্ তৈরি। কাঁঠালের চিপসের কথা শুনে প্রথম দিকে সবাই হাসতো, নাক সিটকাতো। কিন্তু এখন এই চিপস্ বেশ সাড়া ফেলছে।
চিপস্ তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে রুপা খাতুন জানান, প্রথমে কাঁঠাল কেটে কোষগুলো ছাড়িয়ে নিয়ে আঁটি বের করে ফেলতে হয়। এরপর কাঁঠাল চিপসের আকারে কেটে তেলে ভাজতে হয়। পরে মসলা মিশিয়ে প্যাকেট করে দেন। প্রতি প্যাকেট দোকানে খুচরা ২০ টাকা করে বিক্রি হয়। প্রতিদিন গড়ে তিনি তিনশ প্যাকেট চিপস্ তৈরি করেন। এক কেজি কাঁঠাল থেকে ১০ প্যাকেট চিপস হয়। গত তিন মাস ধরে তিনি চিপস্ তৈরি করে বিক্রি করছেন। খরচ বাদে গড়ে প্রতি মাসে এই চিপস্ থেকেই তার ২০ হাজার টাকা উপার্জন হচ্ছে।
তবে রুপা খাতুন আরও জানান, তিনি হাতে ভাজলেও এই প্রক্রিয়াটি মেশিনেও করা সম্ভব। সেজন্য তার ভ্যাকুয়াম প্রাইম, ডি অয়েলিং এবং প্যাকেজিং মেশিন দরকার। এছাড়া কাঁঠালের কোষ কেটে প্রসেসিং করে ফ্রিজে রেখে আরও তিনমাস এই চিপস্ উৎপাদন ও বাজারজাত করা সম্ভব।
রুপা খাতুনকে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে যশোরে ‘প্রোগ্রাম অন এগ্রিকালচারাল এন্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন, এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ইন বাংলাদেশ (পার্টনার-ডিএএম অঙ্গ)’ শীর্ষক প্রকল্পে তরুণ ও নারী উদ্যোক্তার প্রশিক্ষণ প্রদান করছে প্রিজম এগ্রো এন্ড ফুড।
প্রিজম হোটেল ম্যানেজমেন্ট স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইন্সটিটিউটের চেয়ারম্যান বশির আহমেদ চন্দন জানান, দেশব্যাপী বিশেষ করে তরুণ ও নারীদের মধ্যে কৃষি ব্যবসায় উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে এই প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। তারা নিবিড়ভাবে এই তরুণ উদ্যোক্তাদের গড়ে তুলতে চেষ্টা করছেন। এখানে খাদ্যপণ্যের অনেকগুলো আইটেমের মধ্যে রুপা খাতুন কাঁঠালকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে সফল হয়েছেন।
প্রিজম এগ্রো এন্ড ফুড’র ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুসলিমা খাতুন জানান, প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে উঠে এসে রুপা খাতুন উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। শুধু কাঁঠালের চিপস্ বিক্রি করে তিনি প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা উপার্জন করছেন। এছাড়া তার অন্যান্য খাদ্যপণ্য তো রয়েছেই। শুধু নিজেই তৈরি করছেন তা নয়, তিনি চিপস্ তৈরির জন্য প্রায় ১৮শ কেজি প্রসেসিং কাঁঠালও আমাদের সরবরাহ করেছেন।
কৃষি বিপণন অধিদপ্তর যশোরের সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা কিশোর কুমার সাহা বলেন, শুধু রুপা খাতুন না, এমন অসংখ্য উদ্যোক্তার পাশে দাঁড়িয়েছে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। তরুণ ও নারী উদ্যোক্তাদের কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের পার্টনার প্রোগ্রামের আওতায় অন দ্যা জব প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও ব্যবসা পরিচালনার সঙ্গে জড়িত যাবতীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। রুপা খাতুন কাঁঠালের চিপসে সফল হয়েছেন। চিপস্ তৈরির জন্য যেসব মেশিন প্রয়োজন সেগুলো যাতে তিনি পেতে পারেন, সে ব্যাপারেও তারা ভাবছেন।
এফএ/জিকেএস